করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে লকডাউনের মধ্যে সংক্রমণের হার ২০ মার্চের পর থেকে কমে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমেছে।
গত এক সপ্তাহ ধরে শনাক্তের হার ক্রমাগত নিম্নমুখী থাকাকে লকডাউনের সুফল হিসেবে দেখছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। লকডাউন আরও কার্যকর থাকলে সংক্রমণ আরও কমত বলে মনে করেন তারা।
গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে পরীক্ষার বিবেচনায় করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ। গত ২০ মার্চও পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ছিল একই রকম।
গত বছরের মার্চে দেশে সংক্রমণ ধরা পড়ার পর গত নভেম্বর থেকে কমতে শুরু করে। শীতে দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাত নিয়ে সরকার শঙ্কায় থাকলেও ওই মৌসুমে ছিল উল্টো চিত্র।
জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারিতে এক পর্যায়ে টানা বেশ কিছুদিন সংক্রমণের হার পাঁচ শতাংশের নিচে চলে আসে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী এই পর্যায়কে করোনা নিয়ন্ত্রণও বলা যায়।
বাংলাদেশ যখন স্বস্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল তখন মার্চ থেকে আবার তৈরি হয় উদ্বেগ। বাড়তে থাকে সংক্রমণ।
প্রথম ঢেউয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর আবার পরীক্ষার বিবেচনায় সংক্রমণের হার টানা দুই সপ্তাহ পাঁচ শতাংশের উপরে থাকলে তখন তাকে বলে দ্বিতীয় ঢেউ।
৬ মার্চ এই শনাক্তের হার ৫ শতাংশের ওপরে আসে। এরপর থেকে সেটি আরও বাড়তে থাকে। আর ২০ মার্চ সেটি পৌঁছায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি। এরপর তা আরও বাড়তে থাকে।
আর এই পরিস্থিতিতে সরকার ২৯ মার্চ থেকে জনসমাগমে বিধিনিষেধ দেয়। এতেও কাজ না হওয়ায় ৫ এপ্রিল থেকে দেয়া হয় লকডাউন। তার আগের দিন ৪ এপ্রিল পরীক্ষার বিবেচনায় রোগী শনাক্তের হার বেড়ে হয় ২৩.২৮ শতাংশ।
তবে প্রথম দিকে লকডাউন ছিল শিথিল। বেসরকারি অফিস খোলা থাকায় লকডাউন প্রথম দিন থেকেই কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে।
এই অবস্থায় ১৪ এপ্রিল শুরু হয় কঠোর লকডাউন। শুরুর দিকে রোগীর সংখ্যা কমে আসলেও পরীক্ষার বিবেচনায় শতকরা হারের দিকে কমেনি খুব একটা। লকডাউনে যাতায়াতের অভাবে পরীক্ষা করাতে ঝামেলা এর একটি কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কঠোর লকডাউনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শতকরা হিসেবেও রোগীর হার টানা কমতে থাকে।
লকডাউনের প্রথম সপ্তাহের চিত্র
গত ৫ এপ্রিল এক সপ্তাহের লকডাউন শুরু হয়। সেদিন যারা নমুনা দিয়েছেন, তাদের ফল আসে পরদিন। ৬ এপ্রিল শনাক্তের হার ছিল ২১.০২ শতাংশ।
৭ এপ্রিল এটি ছিল ২২.০৪ শতাংশ, ৮ এপ্রিল ২০.২৬ শতাংশ. ৯ এপ্রিল ২৩.৫৭ শতাংশ, ১০ এপ্রিল ২০.৪৯ শতাংশ, ১১ এপ্রিল ১৯.৮১ শতাংশ, ১২ এপ্রিল ২০.৫৯ শতাংশ, ১৩ এপ্রিল এটি ছিল ১৮.২৯ শতাংশ, ১৪ এপ্রিল ২০.৮৯ শতাংশ।
কঠোর লকডাউনে শনাক্তের হার
১৪ এপ্রিল শুরু হয় কঠোর লকডাউন। সেদিন যারা নমুনা জমা দিয়েছেন, তাদের ফলাফল পাওয়া যায় পরদিন।
১৫ এপ্রিল শনাক্তের হার ছিল ২১ শতাংশ, ১৬ এপ্রিল তা আবার বেড়ে হয় ২৩.১৬ শতাংশ, ১৭ এপ্রিল ২১.৪৬ শতাংশ, ১৮ এপ্রিল ১৯.০৬ শতাংশ, ১৯ এপ্রিল ১৭.৬৮ শতাংশ, ২০ এপ্রিল ১৬.৮৫ শতাংশ।
কমতে শুরু করে ২১ এপ্রিল থেকে
সেদিন পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ছিল ১৫.০৭ শতাংশ, ২২ এপ্রিল তা ছিল ১৪.৬৩ শতাংশ, ২৩ এপ্রিল ১৪ শতাংশ, ২৪ এপ্রিল আরও কমে হয় ১৩.৯৫ শতাংশ।
২৫ এপ্রিল শনাক্তের হার ছিল ১৩.৯৪ শতাংশ, ২৬ এপ্রিল ১২.৮২ শতাংশ, ২৭ এপ্রিল ১২.৫১ শতাংশ, ২৮ এপ্রিল ১৩.৯৫ শতাংশ।
লকডাউনের আগে লাফিয়ে বাড়ে সংক্রমণ
করোনা নিয়ন্ত্রণে আসার পর দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রথমবারের মতো সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের বেশি হয় ২১ মার্চ। সেদিন পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার বেড়ে হয় ১০.২৯, পরের দিন হয় ১১.১৯ শতাংশ।
২৩ মার্চ এটি দাঁড়ায় ১৪ শতাংশে, যা ২৪ মার্চ হয় ১২.৯৭ শতাংশ। ২৫ ও ২৬ মার্চ শনাক্তের হার ছিল যথাক্রমে ১৩.২৬ ও ১৩.৬৯ শতাংশ।
২৭ মার্চ সংক্রমণের হার আরও বেড়ে হয় ১৪.৯০ শতাংশ, যা পরদিন হয় ১৭.৬৫ শতাংশ। ২৯ মার্চ কিছুটা কমে সংক্রমণের হার দাঁড়ায় ১৬.৬৫ শতাংশ। ৩০ মার্চ এটি আবার বেড়ে হয় ১৮.৯৪ শতাংশ। মাসের শেষের দিন ৩১ মার্চ সংক্রমণের হার ছিল ১৯.৭ শতাংশ।
১ এপ্রিল থেকে টানা কয়েকদিন সংক্রমণের হার ২০ শতাংশের বেশি ছিল। মাসের প্রথম দিন পরীক্ষার বিবেচনায় হার ছির ২২.৯৪ শতাংশ। ২ এপ্রিল তা আরও বেড়ে হয় ২৩.২৮, ৩ এপ্রিল ২৩.১৫, ৪ এপ্রিল ২৩.০৭ শতাংশ, ৫ এপ্রিল ২৩.৪ শতাংশ।
অবশ্য পরীক্ষার বিবেচনায় সংক্রমণের হারের রেকর্ড হয়েছে প্রথম ঢেউয়ে। গত বছরের ৩১ জুলাই থেকে ১ আগস্ট পর্যন্ত যত পরীক্ষা হয়, তাদের মধ্যে ২৪ দশমিক ৮৯ শতাংশের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ে।
বিশেষজ্ঞ মত
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চলামান লকডাউনের কারণে সংক্রমণ কমেছে।
করেনা প্রতিরোধে গঠিত কারিগরি কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে করোনা সংক্রমণ আর কমে আসত। তবে যেটা কমে আসছে সেটা অবশ্যই লকডাউনের সুফল।’
জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন বলেন, ‘লকডাউনের কারণেই করোনা সংক্রমণ নিম্নগামী হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মাস্ক পরা, নিয়মিত হাতধোয়া, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসা সম্ভব এটা আবার প্রমাণ হলো। অর্থাৎ করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই।’
এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর জাহিদ মালেক স্বপন বলেন, ‘জনগণ সচেতন হয়েছে। মাস্ক বেশি পরছে। দেশে এখন করোনা রোগীর জন্য নির্ধারিত বেডের অর্ধেক ফাঁকা রয়েছে।’
ভয় ভারতকে নিয়ে
করোনা সংক্রমণ কমে আসতে থাকলেও সরকার লকডাউন আরও এক সপ্তাহ বাড়িয়েছে মূলত ভারতের পরিস্থিতি দেখে।
প্রতিবেশী দেশটিতে করোনার বিস্তার লাফিয়ে বাড়ছে। প্রতিদিনই শনাক্তের সংখ্যায় বিশ্ব রেকর্ড হচ্ছে। বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও।
সেখানে করোনার নতুন এক ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে, যার নাম দেয়া হয়েছে বেঙ্গল ভ্যারিয়েন্ট। এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীর অক্সিজেন লাগছে দ্রুত। আর লক্ষণ ছাড়াই রোগী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে গত সোমবার থেকে ভারত সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে দুই সপ্তাহের জন্য। ভারতে আটকে পড়া বাংলাদেশিরা বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেশে ফিরতে পারছেন। তবে সীমান্তেই তাদের করোনা পরীক্ষা হচ্ছে। আর সেখানে ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনেও থাকতে হচ্ছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘ভারতের ভাইরাস আমাদের দেশে যাতে না আসে সেই কারণে আমরা এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। আমরা আশা করছি আগামী কিছু দিনের মধ্যেই করোনা ভাইরাস আবার নিয়ন্ত্রণ চলে আসবে।’
প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রণ যেভাবে
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা শনাক্তের কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরপর মে মাসের মাঝামাঝিতে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে।
জুন থেকে আগস্ট- এই তিন মাসে করোনার সংক্রমণ ছিল তীব্র। এরপর থেকে তা কমতে থাকে।
টানা দুই সপ্তাহ সংক্রমণ পাঁচ শতাংশের নিচে এসে করোনা নিয়ন্ত্রণে আসে ২ ফেব্রুয়ারি। এরপর আরও তিন সপ্তাহের বেশি এই পরিস্থিতি বজায় থাকে। এক পর্যায়ে পরীক্ষার বিবেচনায় সংক্রমণের হার ২ শতাংশে নেমে আসে।