গত বছরের ৯ মে রংপুর ১০০ শয্যার শিশু হাসপাতালকে করোনা আইসোলেশন হাসপাতাল হিসেবে উদ্বোধন করেন তখনকার রংপুর বিভাগীয় কমিশনার কে এম তারিকুল ইসলাম। ৬৪ জন জনবল দিয়ে হাসপাতালটির কার্যক্রম শুরু হয়।
প্রথম ধাপে ১০টি আইসিইউ শয্যা ও ১০টি ভেন্টিলেটর দিয়ে কার্যক্রম শুরু হলেও ধীরে ধীরে তা ৫০ শয্যায় উন্নীত করা করার কথা ছিল। কিন্তু এক বছরে ওই ১০টির বাইরে একটি আইসিইউ বেডও বাড়েনি।
এ হাসপাতাল উদ্বোধনের আগের মাসে গত বছরের এপ্রিলে এখানে ৫০টি আইসিইউ বেড স্থাপনের বরাদ্দ দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এক বছরে কেন আইসিইউ বেডসংখ্যা বাড়ল না, এমন প্রশ্নে রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক আহাদ আলী নিউজবাংলাকে জানান, ‘আমরা বাড়ানোর প্রস্তাব দিইনি। এ নিয়ে সিভিল সার্জনরাও কোনো মিটিংয়ে কথা বলেননি। আগামী সপ্তাহে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানানো হবে।’
রংপুরের এই বিশেষায়িত হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন রোগী আছেন ৪২ জন। ১০টি আইসিইউতেই রোগী ভর্তি। রোগীর অবস্থা অনুযায়ী আরও ১৫টি আইসিইউ প্রয়োজন।
দিনাজপুরের সিভিল সার্জন ডা. আব্দুল কুদ্দুস নিউজবাংলাকে জানান, দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একটি অংশ করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল করা হয়েছে। ১০০ বেডের এই হাসপাতালটিতে ১৮টি আইসিইউ বেড। নতুন করে গত সপ্তাহে আরও ৩০টি বেড চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন তারা।
দিনাজপুরের এই হাসপাতালে ৫৩ জন রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে করোনা পজিটিভ আছেন ১৯ জন। তাদের ১৮ জনই আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। এ কারণে সেখানে দ্রুত আইসিইউ বেড বাড়ানো জরুরি মনে করেছেন তিনি।
করোনায় সংকটাপন্ন রোগীদের জন্য রংপুর বিভাগের আট জেলায় আইসিইউয়ের সংকট দেখা দিয়েছে। মুমূর্ষু রোগীদের জন্য স্বজনদের দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে।
কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা সদর হাসপাতালে এখন পর্যন্ত কোনো আইসিইউ বেড স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়নি। এই জেলাগুলোর মুমূর্ষু রোগীদের ভরসা এখন রংপুর আর দিনাজপুর হাসপাতাল।
রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় সূত্র জানায়, আট জেলায় বিশেষায়িত ১২টি হাসপাতাল রয়েছে। এসব হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য আইসোলেশন ওয়ার্ডে বেড ৫০৬টি। এ ছাড়া বিভাগের ৫৮টি উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোকে করোনা রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে রংপুর বিভাগকে রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এই বিভাগে এখন সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের কার্যালয় সূত্র জানায়, এ বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৬০ জনের বেশি করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এখন পর্যন্ত ১৭ হাজার ৪৩০ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
২০ এপ্রিল পর্যন্ত বিভাগে মারা গেছেন ৩৩১ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন দিনাজপুরে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর (মার্চ ২০২১ থেকে) সংক্রমণের হার ২ ভাগ থেকে ২৪ ভাগে উঠে এসেছে, যা আশঙ্কার কারণ। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের আইসোলেশনে রাখার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না স্বাস্থ্য বিভাগসহ প্রশাসন। ফলে সংক্রমণের হার বাড়ছে।
রংপুর বিভাগের আট জেলার কোথাও বুথ খুলে করোনার নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে না। ফলে নমুনা দেওয়ার জন্য মানুষকে বিভিন্ন স্থানে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। রিপোর্টও পাওয়া যাচ্ছে দেরিতে। করোনা হয়েছে কি হয়নি, এটা জানতে জানতেই সংক্রমিত হচ্ছে পুরো পরিবার।
রংপুর স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, চার জেলার জন্য রংপুর মেডিক্যাল কলেজে একটি পিসিআর বসানো হয়েছে। মঙ্গলবার সেখানে ১৮৮টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এখনও ১০০টির বেশি নমুনা পরীক্ষার জন্য অপেক্ষমাণ।
দিনাজপুর অঞ্চলের চার জেলার করোনায় আক্রান্ত মানুষদের নমুনা পরীক্ষার জন্য দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একটি পিসিআর মেশিন বসানো হয়েছে। সেখানে সর্বোচ্চ ১৮৮টি নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব। এখনও সেখানে ১৫০টির বেশি নমুনা পরীক্ষা করা যায়নি।
প্রতিদিন নমুনার সংখ্যা বাড়লেও পরীক্ষা করা যাচ্ছে মাত্র ৩৭৬টি। ফলে নমুনা সংগ্রহ ও ফলাফলের দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন।
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আরও একটি পিসিআর মেশিন বসানোর প্রস্তুতি চলছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে এই পিসিআর চালুর আশা করছেন অধ্যক্ষ নুরুন্নবী লাইজু।
জানা গেছে, নমুনা সংগ্রহের বুথও কমে গেছে। রংপুর বিভাগে শুরুতে ৭৪টি বুথে করোনার নমুনা সংগ্রহ করা হতো। এখন ৫৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, রংপুর ও দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ আর রংপুর সিটি করপোরেশনের একটি বুথে নমুনা সংগ্রহ চলছে।
নমুনা দেওয়ার পর ফলাফল জানতে লেগে যাচ্ছে সপ্তাহখানেক। এর মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।
রংপুরের কামালকাছনা নতুন পাড়ার বাসিন্দা ফজলে রাব্বি শুভ জানান, তিনি ১০ এপ্রিল শনিবার নমুনা দিয়েছেন আর ১৭ এপ্রিল তাকে ফলাফল দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার সব উপসর্গই ছিল। খুব টেনশনে ছিলাম। পাঁচ দিন ফোন করার পর সাত দিনের দিন ফলাফল পাই। তাতে রেজাল্ট নেগেটিভ আসে।’
করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করে বলেন, মুমূর্ষু রোগী যাদের আইসিইউ দরকার তা পাওয়া যাচ্ছে না। দ্রুত আইসিইউ বেড ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তা না হলে মৃত্যুহার আরও বেড়ে যাবে।
রংপুর করোনা প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, ‘নতুন করে নমুনা পরীক্ষার কোনো বুথ আমরা দেখছি না। ঠিকমতো নমুনা সংগ্রহ করা হলে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর যারা বাসায় অবস্থান করছেন তাদের বাড়িসহ আশপাশের এলাকা এর আগে যেভাবে লালপতাকা উড়িয়ে দিয়ে লকডাউন ঘোষণা করা হতো এবং পুলিশ দিয়ে খোঁজখবর নেয়া হতো, এবার তা করা হচ্ছে না। ফলে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
তিনি বলেন, আক্রান্তদের কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে। এতে করে কিছুটা হলে সংক্রমণ কমে যাবে।
রংপুরের সিভিল সার্জন ডা. হেরম্ব কুমার বলেন, ‘রংপুর শহরে রংপুর সিটি করপোরেশন নমুনা সংগ্রহ করছে। আমরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে নমুনা সংগ্রহ করে পিসিআর ল্যাবে পাঠাচ্ছি। আমরা বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তারাই দেখছে।’
রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. আহাদ আলী বলেন, ‘করোনা আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। অনেক আক্রান্ত রোগী হাসপাতালগুলোতে আসছেন। কিন্তু আইসিইউ বেডের সংকটের কারণে কোথাও কোথাও চিকিৎসা দিতে সমস্যা হচ্ছে। আমরা আইসিইউ বেড বাড়ানোসহ করোনা রোগীদের চিকিৎসার সব সুযোগসুবিধার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আশা করছি আরও কিছু আইসিইউ বেড পাওয়া যাবে।’