বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের সামলাতে হিমশিম হাসপাতাল

  •    
  • ২১ এপ্রিল, ২০২১ ১৪:৩৮

ডায়রিয়া ওয়ার্ডের সামনে থেকে শুরু করে পুরুষ সার্জারি ওয়ার্ড ও পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডের বারান্দার মেঝেতে দুই সারিতে শুয়ে আছেন রোগী। কেউ আবার মেঝেতে জায়গা না পেয়ে শুয়ে আছেন ট্রলিতে।

বরিশাল বিভাগের ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েই চলছে। পর্যাপ্ত শয্যার অভাবে গুরুতর অসুস্থদের হাসপাতালেও ঠাঁই হচ্ছে না।

একটি জেলার চিকিৎসা কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, সেখানে রোটা ভাইরাসের প্রকোপ দেখা গিয়েছে। একটি জেলায় গবেষণা করে দেখা গেছে, নদী ও পুকুরের পানি না ফুটিয়ে পান করার কারণে বেড়েছে প্রকোপ। আর একটি জেলায় গরম বাড়ার কারণে রোগের প্রকোপ হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ভোলায় রোগী সামলাতে হিমশিম

ভোলায় গত দুই মাস ধরে ক্রমেই বাড়ছে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। সদর হাসপাতালে প্রতিদিন আসছেন গড়ে প্রায় দেড় শতাধিক রোগী। একসঙ্গে এত রোগীর চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে নার্স ও ডাক্তারদের।

হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডের ১০টি শয্যার বিপরীতে এত রোগী ভর্তি হওয়ায় হাসপাতালের বারান্দার মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন বেশিরভাগ রোগী।

সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় পুরো হাসপাতালের বারান্দার দুই পাশে শুয়ে আছেন শতাধিক রোগী। এদের একটি বড় অংশ শিশু।

ডায়রিয়া ওয়ার্ডের সামনে থেকে শুরু করে পুরুষ সার্জারি ওয়ার্ড ও পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডের বারান্দার মেঝেতে দুই সারিতে শুয়ে আছেন রোগী। কেউ আবার মেঝেতে জায়গা না পেয়ে শুয়ে আছেন ট্রলিতে।

মাত্র দুই জন নার্স এত রোগীর সেবা দিচ্ছেন। কাজের চাপে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তারা।

ওয়ার্ড বয় ও ঝাড়ুদাররাও দিনভর পরিশ্রম করছে। ডাক্তার ও নার্সদের পাশাপাশি তারাও রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

সদর উপজেলার পশ্চিম ইলিশা ইউনিয়নের মো. ইউছুফ তার স্ত্রী নাজমা বিবি ও ১০ বছর বয়সী ছেলে নুরনবীকে নিয়ে এসেছেন। অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শয্যা না পেয়ে মা-ছেলেকে হাসপাতালের বারান্দার মেঝেতে রেখেই স্যালাইন দিচ্ছিলেন ইউছুফ।

বোরহানউদ্দিন উপজেলার বাসিন্দা মো. শাহিন জানান, তার স্ত্রী আমেনা বেগম ও তিন বছর বয়সী ছেলে নাফিজ গত ছয় দিন ধরে বমি ও ডায়রিয়া আক্রান্ত। প্রথমে তাদেরকে বোরহানউদ্দিন হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে জায়গা না পেয়ে ভোলা সদর হাসপাতালে নিয়ে আসেন। এখানেও সিট না পেয়ে হাসপাতালের বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা।

সিনিয়র স্টাফ নার্স জাকিনুর জানান, রোববার সকাল আটটা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ১৬৯ জন রোগী ভর্তি হয়। একই সময়ে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে যান ১৮৯ জন।

দুই মাস ধরেই ডায়রিয়ার এই প্রকোপ দেখা গেলেও এক সপ্তাহ ধরে দিনে দেড় শতাধিক রোগী ভর্তি হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

এদের মধ্যে নারী রোগীর সংখ্যা বেশী।

ভোলার সিভিল সার্জন সৈয়দ রেজাউল ইসলাম আশঙ্কা করছেন, রোগী যেভাবে বাড়ছে তাতে স্যালাইন স্বল্পতা দেখা দিতে পারে।

তার ধারণা, গরমের কারণে ডায়রিয়া বেড়েছে।

পটুয়াখালীতে করোনার চেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে ডায়রিয়া রোগী

পটুয়াখালী জেলার সিভিল সার্জন অফিস থেকে জানা গেছে, ১ জানুয়ারি থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ৭ হাজার ৩৪১ জন মানুষ। এর মধ্যে সদরেই ২ হাজার ২২৩ জন।

গত এক মাসে আক্রান্ত ৩ হাজার ৮৬৭ জন এবং গত সাত দিনের আক্রান্ত সংখ্যা ১ হাজার ৮৬৩ জন।

তবে বেসরকারি হিসাবে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ।

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, আশঙ্কাজনক হারে রোগী বাড়তে থাকায় হাসপাতালের মেঝে পর্যন্ত ফাঁকা নেই। হাসপাতাল ভর্তি ডায়রিয়া রোগীতে। তার ওপর তৈরি হয়েছে স্যালাইন ও ওষুধ সংকট।

সদর উপজেলার চান্দখালী গ্রামের নয়ন নামের ১০ বছরের এক শিশুকে এই হাসপাতালে ভর্তি করেছে তার বাবা বাদল মিয়া। গত তিনদিন ধরে বাইরে থেকে স্যালাইন এনে দেয়া হচ্ছে।

সদর উপজেলার নন্দিপাড়া গ্রামের জব্বার খলিফা জানান, মঙ্গলবার সকালে তার দুই বছর বয়সী নাতি মো. জুনায়েদ ও আট বছরের নাতনি আফরোজাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু হাসপাতাল থেকে কোনো স্যালাইন দেয়া হচ্ছেনা। অতিরিক্ত দামে বাইরের দোকান থেকে স্যালাইন কিনে আনতে হচ্ছে।

তার অভিযোগ, প্রতিটি স্যালাইনের স্বাভাবিক মূল্য ৯০ থেকে ৯২ টাকা হলেও বাইরের দোকানে সেগুলো নেয়া হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা।

অন্য উপজেলার চিত্রও এক।

মির্জাগঞ্জ উপজেলার উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দেখা গেছে, হাসপাতালের সামনে শামিয়ানা টাঙিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ওয়াহিদুজ্জামান শামিম নিউজবাংলাকে জানান, নারী, শিশু ও বয়স্কদের পাশাপাশি গর্ভবতী মায়েরাও এ বছর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেনযা খুবই চিন্তার বিষয়।

এর জন্য তীব্র গরম ও বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার না করাকেই দায়ী করেন এই শিশু বিশেষজ্ঞ। গরমে পানির পাশাপাশি খাবার স্যালাইন খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

এই হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ আবদুল মতিন জানান, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মাঝে ডায়রিয়া সংক্রমণ মারাত্মক আকারে বেড়ে যাওয়ায় ডায়রিয়াকেই এখন বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

জেলা সিভিল সার্জন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম শিপন জানান, জেলার সব কয়টি উপজেলায় ডায়রিয়া রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে ৮৪টি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। তবে স্যালাইন সংকটের কথা উড়িয়ে দিয়ে সিভিল সার্জন জানান আগামী এক সপ্তাহ পর্যন্ত মজুত রয়েছে স্যালাইন।

বরগুনায় কারণ নদী-পুকুরের পানি ব্যবহার

বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের তথ্য বলছে, জানুয়ারি মাসে ১৭১ জন রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে হয় ২০৩ জন, মার্চে তা আরও বেড়ে হয় ৯০৩ জন।

এপ্রিলের ১২ তারিখ পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছেন ৫৪০ জন। জেলার ছয়টি উপজেলা হাসপাতালে আরও অন্তত এক হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। ভর্তি আছেন দুই শতাধিক।

এর মধ্যে শনিবার বেতাগী উপজেলার নুরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির মৃত্যুও হয়েছে।

আক্রান্তদের বেশিরভাগ নদী তীর এলাকার বাসিন্দা। তাদের বেশিরভাগই শিশু ও বৃদ্ধ। এদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। যে কারণে তারা দ্রুত আক্রান্ত হন।

বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সোহরাব উদ্দীন বলেন, উপকূলীয় এলাকার মানুষ এখনও নদী ও পুকুরের পানি পান করে। এসব পানি শতভাগ জীবাণুমুক্ত করা হয় না।

ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক উদারময় গবেষণা কেন্দ্র বা আইসিডিডিআর’বির সাত সদস্যের একটি গবেষক দল মার্চ মাসের শুরুর দিকে বরগুনায় আসে। তারা সদরের বুড়িরচর, ঢলুয়া, গৌরীচন্না ও ফুলঝুড়িসহ বরগুনা পৌরশহরের বেশ কিছু এলাকায় গবেষণা করেন।

গবেষক দলের দলনেতা বলেন, ‘আমরা হাসপাতালে কয়েকজন রোগীর পেটে কলেরা জীবাণুর উপস্থিতি পাই। ওই রোগীর বাড়িতে গিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারি, ওই পরিবারসহ এলাকার বাসিন্দারা গভীর নলকুপের পানি পান করলেও দৈনন্দিন কাজে সরাসরি পুকুরের পানি ব্যবহার করে থাকেন।

‘বিশেষ করে এ অঞ্চলে দুপুরের রান্না করা ভাত রাতে খাওয়ার পর পুকুরের পানি দিয়ে রাখা হয়। ওই ভাত (পান্তাভাত) সকালে তার খেয়ে নেন। পানি বিশুদ্ধ না করে সরাসরি ব্যবহার করার ফলে জীবাণু পাকস্থলিতে গিয়ে সংক্রমণ ঘটায়।’

পৌরশহরের উকিলপট্টি এলাকায় কয়েকটি বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সরাসরি খালের সঙ্গে টয়লেটের পাইপ দিয়ে দেয়া হয়ছে। আবার সেই খালের পানিই দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পুকুরের পানি ব্যবহার করে ২০ থেকে ২৫টি পরিবার। শুষ্ক মৌসুমে পুকুরের পানি শুকিয়ে যায়, ফলে জীবাণুর ঘনত্ব বেড়ে যায়। এসব পানি না ফুটিয়েই ব্যবহার করা হয়। আর ওই পানি দূষিত অবস্থায় পাকস্থলিতে গিয়ে সংক্রমণ ঘটায়।

জোয়ারের পানিতে লবণাক্তও ডায়েরিয়ার প্রকোপ বাড়ার একটি কারণ বলে মনে করছে আইসিডিডিআর’বি। এই লবণ পানি কোনোভাবে পেটে গেলেই হজমশক্তি নষ্ট হয়।

বরগুনার সিভিল সার্জন মারিয়া হাসান বলেন, ‘আইসিডিডিআর’বির গবেষণালব্ধ পরামর্শ আমরা পেয়েছি। এ ব্যাপারে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের সঙ্গেও আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। আশা করি সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব।’

বরিশাল বিভাগে কয়েকদিন ধরেই বাড়ছে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা। এতে খোদ স্বাস্থ্য বিভাগ উদ্বিগ্ন। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, বরিশালে এর আগে এমন ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা যায়নি।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক বাসুদেব কুমার দাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হঠাৎ করে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করেছি আমরা। শহরের মানুষ তেমন আক্রান্ত না হলেও, বেশি আক্রান্ত হচ্ছে উপকূল ও গ্রামাঞ্চলের মানুষ।’

তিনি জানান, অতিরিক্ত গরমে স্বস্তি পেতে মানুষ পান্তা কিংবা শরবত খাচ্ছে বেশি। এসব তৈরিতে দূষিত পানি ব্যবহারের কারণেই ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ছে বলে তার মত।

বাসুদেব কুমার জানান, বরিশাল বিভাগে এ বছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের ২০ তারিখ পর্যন্ত ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ৩২ হাজার ছাড়িয়েছে।

এ বিভাগের আরো খবর