কদিন ধরে অকৃপণভাবে তাপ বিলিয়ে যাচ্ছে সূর্য। ব্যতিক্রম ছিল না সোমবারও। ভ্যাপসা গরমের মধ্যে ঠিক দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটের সামনে এসে থামল একটি রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স।
করোনা রোগী বুঝতে পেরে, হাসপাতাল প্রাঙ্গণে উপস্থিত সবাই নিজেদের সরিয়ে নিলেন নিরাপদ দূরত্বে। কেউ যখন এগিয়ে আসছে না, তখন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল ছয়জন, তাদের সবাই ট্রান্সজেন্ডার।
অ্যাম্বুলেন্সে সঙ্কটাপন্ন মায়ের দিকে তাকিয়ে দিশেহারা সন্তান। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে লোনাজল। এগিয়ে আসা ছয়জনকে দেখে অনেকটাই ভরসা পায় যুবকটি। সবাই যখন নিজেদের সুরক্ষায় ব্যস্ত, তখন ওই ছয়জন ব্যস্ত রোগীর সেবায়।
অ্যাম্বুলেন্সের কাছে গিয়ে তারা জানতে পারলেন, ভেতরে থাকা রোগী করোনা আক্রান্ত হয়ে ভর্তি ছিলেন একটি প্রাইভেট হাসপাতালে। অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় তাকে আর রাখতে চায়নি ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাই করোনাভাইরাস আক্রান্ত মাকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে এসেছেন সন্তান।
এক রোগীকে করোনা ইউনিটে নিয়ে যাচ্ছেন বৃহন্নলার কর্মীরা।
ঘটনা জানা মাত্রই ট্রান্সজেন্ডার ছয়জনের কেউ গেলেন রোগীর সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির টিকিট কাটতে। কেউ ব্যস্ত হলেন রোগীকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানোর কাজে। আবার কেউ ছুটলেন অ্যাম্বুলেন্সে থাকা রোগীর আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র গোছানোর কাজে।
এভাবেই নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবায় এগিয়ে এসেছেন ট্রান্সজেন্ডাররা। তারা একটি সংগঠনের হয়ে কাজ করেন, নাম ‘বৃহন্নলা’।
কথা হয় তাদের একজন মুনমুন আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতেই আমরা কাজটি বেছে নিয়েছি।’
করোনায় আক্রান্ত মৃত একজনকে অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে দিচ্ছেন বৃহন্নলার কর্মীরা। ছবি: নিউজবাংলা
তাদের সংগঠনে ১৫ জন স্বেচ্ছাসেবী আছেন জানিয়ে মুনমুন বলেন, ‘বুধবার থেকে আমাদের স্বেচ্ছাসেবীরা মহাখালীতে অবস্থিত দেশের সবচেয়ে বড় করোনা হাসপাতালেও সেবা দেয়া শুরু করবে।’
করোনা আক্রান্তদের সেবায় ‘বৃহন্নলা’ নামের সংগঠনের ব্যানারে ট্রান্সজেন্ডাররা যে এগিয়ে এসেছেন, সেটা অনেকের অজানা। সাধারণ মানুষ যেন সেটা বুঝতে পারে সেজন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের করোনা ইউনিটের সামনে একজন প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। যেখানে লেখা রয়েছে: ‘আমি স্বেচ্ছাসেবক! কীভাবে সাহায্য করতে পারি?’
করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে মৃতদের হাসপাতাল থেকে স্থানান্তরেও সহযোগিতা করছেন তারা।
করোনা আক্রান্ত মৃত একজনকে গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছেন বৃহন্নলার কর্মীরা। ছবি: নিউজবাংলা
মানবতার সেবায় এসব কাজ করতে গিয়ে কখনও কখনও তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখেও পড়তে হচ্ছে বলে জানালেন মুনমুন।
ঢাকা মেডিক্যালে তাদের সরব উপস্থিতি আর নির্ভয়ে রোগীর কাছে ছুটে যাওয়ার কারণে দালালদের দৌরাত্ম্য কমে গেছে। ফলে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে অসহায়ত্বের সুযোগে টাকা হাতিয়ে নেয়ার সুযোগও পাচ্ছে না দালালরা। বৃহন্নলার কর্মীদের ওপর তাদের ক্ষোভ।
মুনমুন জানালেন এসব সয়েই তাদের কাজ চলছে। তবে সেবা দেয়ার পাশাপাশি করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখাটা তো জরুরি?
এমন প্রশ্নের জবাবে মুনমুন বলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবীরা নিয়মিত মাস্ক পরে থাকেন। হ্যান্ড গ্লাভস, মাথায় সার্জিক্যাল টুপি আর পিপিই ব্যবহার করেন।’
একজন রোগীকে সেবা দেয়ার পর দ্রুত তারা নিজেদের জীবাণুমুক্ত করে নেন বলেও জানান মুনমুন।
বৃহন্নলার নিজস্ব গাড়ি। এটিতে করে বিনামূল্যে করোনারোগীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া হয়। ছবি: নিউজবাংলা
অসহায় মানুষদের সেবায় বৃহন্নলার রয়েছে একটি তিন চাকার গাড়ি। তাদেরকে অবগত করলেই সেই সিএনজি দিয়ে রোগী ও রোগীর স্বজনদের যাতায়াতও নিশ্চিত করছে সংগঠনটি।
বৃহন্নলা মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক সামাজিক সংগঠন। যারা সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী ও বিত্তবানদের অনুদান নিয়ে তাদের কাজ পরিচালনা করে থাকেন।
মুনমুন বলেন, ‘সরকার লকডাউনের ঘোষণা দেয়ার দ্বিতীয় দিন থেকে আমরা কাজ শুরু করেছি। যতদিন লকডাউন থাকবে ততদিন আমরা সেবা দিয়ে যাব।’
গত বছরের মার্চে করোনা সংক্রমণের লাগাম টানতে সরকারের অঘোষিত লকডাউনে প্রথমবারের মতো মাঠে নামে ‘বৃহন্নলা’। এবারও তাই করছে।