রাজশাহী বিভাগের করোনা রোগীদের চিকিৎসা এখন রাজশাহীর একটি ও বগুড়ার দুটি হাসপাতাল ঘিরেই হচ্ছে। এই দুই জেলাতেই শুধু আইসিইউ সুবিধা রয়েছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ ও পাবনার রোগীদের আইসিইউর জন্য রাজশাহী ও বগুড়ায় নেয়া হয়। কিন্তু বগুড়া কিংবা রাজশাহী গেলেই আইসিইউ শয্যা পাওয়া যায় না। অনেক সময় পথেই মৃত্যু হচ্ছে অনেকের।
এ বিভাগের আট জেলার মধ্যে শুধু বগুড়া, রাজশাহী ও সিরাজগঞ্জে করোনা নমুনা পরীক্ষার সুযোগ আছে। এর মধ্যে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের একটি ল্যাবে পরীক্ষা চলছে। বগুড়ায় আছে দুটি পিসিআর ল্যাব। এর একটি শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজে। অন্যটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান টিএমএসএস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এ ছাড়া পরীক্ষা হচ্ছে সিরাজগঞ্জ সরকারি হাসপাতালে।
রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা ও জয়পুরহাটের নমুনা পরীক্ষা করা হয় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে। এসব জেলা থেকে সিভিল সার্জন অফিসের তত্ত্বাবধানে নমুনা পাঠানো হয় করোনা পরীক্ষার ল্যাবে। বগুড়ায় নিজ জেলার নমুনা ছাড়াও জয়পুরহাট ও পাবনার নমুনা পরীক্ষা করা হয়। সিরাজগঞ্জে নিজ জেলার নমুনা পরীক্ষার পাশাপাশি চাপ বেড়ে গেলে পাবনার নমুনাও পরীক্ষা করা হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, যে জেলায় যখন সুযোগ হয়, সেখানে নমুনা পাঠানো হয়।
আট জেলার মধ্যে ছয়টির হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) নেই। যে দুই জেলায় আইসিইউ বেড আছে, তা-ও খুবই অপ্রতুল। এ কারণে করোনায় আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীদের বেশির ভাগই আইসিইউ সেবা পাচ্ছেন না। এ কারণে লম্বা হচ্ছে মৃতের তালিকা।
রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক হাবিবুল আহসান তালুকদার বলেন, বর্তমানে বিভাগে করোনা চিকিৎসার জন্য মোট ৫৩৩টি সাধারণ বেড আছে। আইসিইউ রয়েছে ৪১টি। এর মধ্যে রাজশাহী মেডিক্যালে কলেজ হাসপাতালে ১০টি, বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৩টি, মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ৮টি এবং টিএমএসএস হাসপাতালে ১০টি আইসিইউ বেড রয়েছে।
তিনি জানান, কোভিড রোগী মানেই আইসিইউ লাগবে, এমনটি নয়। এই ধারণা পরিবর্তন করতে হবে। আইসিইউ একেবারে শেষ পর্যায়ে লাগে। তবে আইসিইউ বাড়ানোর কার্যক্রম চলছে। চলতি মাসেই রাজশাহীতে আরও ১০টি এবং বগুড়ায় আরও ২০টি আইসিইউ চালু করার কাজ চলছে।
হাবিবুল আহসান বলেন, ‘আইসিইউর জন্য আমাদের সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাগবেই। কারণ, আমরা হাই ফ্লো নেজাল দিয়ে যখন অক্সিজেন দিতে যাব, তখন সিলিন্ডার অক্সিজেন ৫ মিনিটও চলবে না। সেন্টাল অক্সিজেন ছাড়া হবে না।’
গত এক বছরেও সীমাবদ্ধতাগুলো কেন দূর করা গেল না, জানতে চাইলে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক বলেন, ‘এটা আমাদের নীতিনির্ধারকদের বিষয়। আমি বলতে পারব না।’
করোনা রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এখানকার আইসিইউর কোনো শয্যাই ফাঁকা নেই। করোনা ইউনিটে বেড আছে ১৫৩টি। চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১১০ জন।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ বেড আছে মাত্র ১০টি
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক সাইফুল ফেরদৌস জানিয়েছেন, ২০টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে ১০টি কোভিড-১৯ রোগীদের দেয়া হয়েছে। বাকি ১০টি অন্যান্য মুমূর্ষু রোগীর জন্য সংরক্ষিত আছে। ফলে চাইলেও এই ১০টি শয্যা কোভিড রোগীদের দেয়া সম্ভব হয় না। রোগীদের সাধারণ ওয়ার্ডেই থাকতে হয়। এসব ওয়ার্ডে অবশ্য অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, রাজশাহী মেডিক্যালে করোনা রোগীর চাপ অনেক বেড়ে গেছে। এখানে এখন ১৬৩টি বেডে করোনার চিকিৎসা চলছে। আইসিইউ বেড আছে ১০টি। এখানকার ২২, ২৭, ২৯ ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ড এখন করোনা ওয়ার্ড। রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখানে করোনা ওয়ার্ড বা বেড আর বেশি বাড়ানোর সুযোগ নেই। আর সর্বোচ্চ দুটি ওয়ার্ড বাড়ানো যেতে পারে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে, এই হাসপাতালের পুরোটাই কোভিড চিকিৎসার জন্য ছেড়ে দিতে হবে, অথবা সদর হাসপাতালকেও কোভিড হাসপাতাল করার বিষয়ে ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে ৯০টি অক্সিজেন লাইন লাগানো হয়েছে। এক মাসের মধ্যে আমাদের অক্সিজেনের সমস্যা নেই। হাই ফ্লো অনেকগুলো আছে। তবে এগুলোর যন্ত্রাংশের ঘাটতি আছে। এগুলোর সার্কিটগুলো ব্যবহারের পর বদলাতে হয়। এগুলো পরবর্তী সময়ে পাওয়া যায় না। এ কারণে সেই হাই ফ্লো কাজ করে না।
‘এগুলোর দামও অনেক। আমাদের ১৮টি হাই ফ্লো আছে। আরও ২১টি পাচ্ছি। ডিভিশনাল কমিশনার স্যার ৩টি দিয়েছেন। এগুলো নিয়ে সমস্যা হবে না। একটি ওয়ার্ডে হাই ফ্লো প্রতিটি বেডে দেয়া যাবে না। ২০টি বেড থাকলে ৭-৮টিতে দেয়া যায়। কারণ, এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ।’
নাটোর প্রতিনিধি নাজমুল হাসান জানিয়েছেন, নাটোরে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য সদর হাসপাতালে মোট ৩১টি বেড আছে। মোট চিকিৎসক ১৫ জন, ১৬ জন নার্সসহ আরও ৮ জন নিয়োজিত আছেন। অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে ১৭০টি।
নাটোর সদর হাসপাতালের সহকারী পরিচালক পরিতোষ রায় জানান, সদর হাসপাতালে আইসিইউ বেড ও পিসিআর ল্যাব নেই। সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট নেই। তবে সিংড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট সংযুক্ত করা হয়েছে। রোগীর অবস্থা বুঝে সদর হাসপাতালের আইসোলেশন সেন্টারে ভর্তি করা হয়। অবস্থা বেশি জটিল হলে রাজশাহী মেডিক্যালের করোনা ইউনিটে পাঠানো হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি আব্দুর রব নাহিদ জানিয়েছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনার নমুনা পরীক্ষার সুযোগ নেই। নিয়মিত রাজশাহী মেডিক্যালের করোনা ল্যাব থেকে পরীক্ষা করা হচ্ছে। নমুনা পাঠানোর ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ফলাফল পাওয়া যায়। সদর হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য করোনা ইউনিট গত বছর শুরু করা হয়েছিল। সেটিতে দীর্ঘদিন রোগী ছিল না, বর্তমানে ৭ জন রোগী ভর্তি আছেন। ১০টি অবজারভেশন বেড ও করোনা রোগীদের জন্য ২০টি বেড রয়েছে।
সিভিল সার্জন জাহিদ নজরুল চৌধুরী জানান, করোনা ইউনিট চালাতে যে বাড়তি খরচ হবে, সেই অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। অর্থ প্রাপ্তির আশ্বাসে ইউনিটটি চালু করা হয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনার নমুনা পরীক্ষা করার কোনো উপায়ই নেই
নওগাঁ প্রতিনিধি সবুজ হোসেন জানিয়েছেন, নওগাঁয় করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য মোট ২০১টি আইসোলেশন বেড রয়েছে। মোট ৭৪ জন চিকিৎসক, ৩৫ জন মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং ৮৫ জন নার্সসহ আরও ৪৯ জন স্টাফ করোনা রোগীদের সেবায় নিয়োজিত। অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে ২০১টি।
সিভিল সার্জন অফিসের মেডিক্যাল অফিসার (ডিজিজ কন্ট্রোল) আশীষ কুমার সরকার জানান, ‘এখানে আইসিইউ বেড ও পিসিআর ল্যাব নেই। আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বরাবর চিঠি দিয়েছি। তবে সদর হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট সংযুক্ত করার কাজ চলছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলে, আমাদের দেয়া হটলাইনে যোগাযোগ করলে রোগীদের প্রাথমিক পরামর্শ দেয়া হয়। পরীক্ষার পর যাদের রিপোর্ট পজিটিভ হয়, তাদের ফোনে পরামর্শ দেয়া হয়। তবে কোনো রোগীর জটিলতা দেখা দিলে, তাকে নির্ধারিত আইসোলেশন বেডে ভর্তি করে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। প্রয়োজনে রাজশাহী মেডিক্যালে পাঠানো হয়।
জয়পুরহাট আধুনিক জেলা হাসপাতালে করোনার নমুনা পরীক্ষার ফল পেতে সময় লাগে ১০ থেকে ১২ দিন
জয়পুরহাট প্রতিনিধি রাজীব হাসান জানিয়েছেন, ১৫০ শয্যার জয়পুরহাট আধুনিক জেলা হাসপাতালে ২০ শয্যার একটি করোনা ওয়ার্ড রয়েছে। পাশাপাশি চারটি উপজেলা স্ব্যস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০টি করে শয্যার করোনা ওয়ার্ড রয়েছে। জেলা হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন রয়েছে। তবে আইইসিইউ নেই। করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে ১০ থেকে ১২ দিন লেগে যায়।
বগুড়া প্রতিনিধি খোরশেদ আলম জানিয়েছেন, বগুড়ায় করোনায় সংক্রমণের হার ৩৯। এখানে দুটি পিসিআর ল্যাবে করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, গত শুক্রবার পর্যন্ত জেলায় মোট করোনা রোগীর সংখ্যা ১১ হাজার ৩৫০। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৭২ জন। শনিবার পর্যন্ত জেলায় করোনা থেকে মোট সুস্থ হয়েছেন ১০ হাজার ৬৪ জন। করোনা রোগীর চিকিৎসায় বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে রয়েছে বগুড়ার ২৫০ শয্যার মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল। তবে এখানে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা গত এক বছরেও চালু করা যায়নি। মোহাম্মদ আলীতে সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন সহবরাহ করা হয়।
মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য ৭৮টি বেড আছে। আইসিইউ বেড রয়েছে আটটি। গত বছর এই হাসপাতাল করোনা রোগীদের জন্য বিশেষায়িত করা হলেও এবার এখনও তা করা সম্ভব হয়নি বলে জানান মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শফিক আমীন কাজল।
টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়। এখানে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা আছে। কিন্তু এখানে চিকিৎসা ব্যয়বহুল। শহীদ জিয়াউর রহমান হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা রয়েছে।
করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান হাসপাতাল
গত ১৪ মার্চ বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান হাসপাতালে সৈয়দ রুহুল আমিন নামের এক করোনা রোগী মারা যান। তার ছেলে আরিফ হাসানের অভিযোগ, ‘বাবার মৃত্যুর দিন ভোরে লোডশেডিং হওয়ায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয় হাসপাতালে। ওই সময় বাবার অক্সিজেন বন্ধ থাকে। কারণ, ওই মেডিক্যালের দুজন অবেদনবিদ ছাড়া হাই ফ্লো অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা সম্পর্কে কারও ধারণা ছিল না। বিদ্যুৎ আসার পর হাসপাতালের অন্য চিকিৎসক ও নার্সরা হাই অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা চালুও করতে না পারায় বাবার মৃত্যু হয়।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যালের উপপরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ‘ওই রোগী হাই ফ্লো অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছেন হয়তো বিষয়টা এমন নয়। দুজন চিকিৎসক হাই ফ্লো অক্সিজেন সরবরাহের বিষয়ে বেশি দক্ষ। অন্য চিকিৎসক-নার্সরাও এখন ওই ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা পেয়ে গেছেন।’
পাবনা প্রতিনিধি আফ্রিদি খান মিঠু জানিয়েছেন, গুরুতর রোগীকে আইসিইউর জন্য ঢাকা বা রাজশাহীতে স্থানান্তর হয়। এ কারণে পথেই কেউ কেউ মারা যান। অন্যদিকে নমুনা পরীক্ষার জন্য পিসিআর ল্যাব না থাকায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে করোনা রোগীদের।
২৫০ শয্যার পাবনা জেনারেল হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা নেই। কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। পাবনায় পিসিআর ল্যাবের কার্যক্রম শুরু হয়নি। পাবনা জেনারেল হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি আছেন ১৩ জন ও বেডসংখ্যা ১০০।
পাবনা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক আইয়ুব হোসেন জানান, ‘আশা করছি, এক মাসের মধ্যেই আইসিইউ ইউনিট চালু করা সম্ভব হবে।’