চাহিদা অনুযায়ী করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা উৎপাদনে হিমশিম খাচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট।
মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ ভয়াবহ আকার নেয়ায় দরকার অনুপাতে টিকা উৎপাদন ও সরবরাহে পিছিয়ে পড়ছে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতি বছর স্বাভাবিক সময়ে বিশ্বজুড়ে যত টিকা বিক্রি হতো, তার ৬০ শতাংশই উৎপাদন করত সিরাম ইনস্টিটিউট।
টিকা উৎপাদনে এমন সক্ষমতার কারণেই জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিশ্বজুড়ে টিকার সুষম বণ্টন নিশ্চিতের কর্মসূচি কোভ্যাক্সে চুক্তিবদ্ধ হয় ভারত।
এ কর্মসূচির আওতায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে বিনা মূল্যে অথবা ছাড়ে এ টিকার শত কোটি ডোজ পাঠানোর কথা।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের প্রাথমিক চুক্তি অনুযায়ী ৯২টি দেশের জন্য ২০ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদনের কথা ছিল সিরামের। কিন্তু কয়েক মাসের ব্যবধানে ভারতেই করোনা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে।
মার্চ থেকে শুরু হওয়া দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রথম ঢেউয়ের সময়ের চেয়ে সংক্রমণ ও মৃত্যু অনেক বেড়েছে। যেখানে গত সেপ্টেম্বরে মহামারিতে দিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ছিল লাখ ছুঁইছুঁই, সেখানে এখন এ সংখ্যা আড়াই গুণেরও বেশি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রোববার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, শনিবার দেশটিতে দুই লাখ ৬১ হাজার ৫০০ মানুষের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে, যা দিনের হিসেবে মহামারির সোয়া এক বছরে সর্বোচ্চ। ভারতে এক সপ্তাহের কম সময়ে ১০ লাখের বেশি মানুষের দেহে ভাইরাসটি শনাক্ত হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে দিল্লিতে সাপ্তাহিক ছুটির দিন ও রাত্রিকালীন কারফিউসহ বিভিন্ন রাজ্য ও শহরে নেয়া হচ্ছে নানা ব্যবস্থা। কাজ হারিয়ে আবারও লকডাউনে আটকে পড়ার শঙ্কায় বড় বড় শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরছেন ভাসমান শ্রমিকরা।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই টান পড়েছে টিকা সরবরাহে। কমপক্ষে পাঁচটি রাজ্য জানিয়েছে টিকার তীব্র ঘাটতির কথা; টিকাদান চালু রাখতে কেন্দ্রীয় সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ারও আহ্বান জানিয়েছে।
সংকটের মুখে ভারত সরকার ও সিরাম ইনস্টিটিউট কোভ্যাক্স কর্মসূচির জন্য টিকা পাঠানোর বদলে নিজ দেশের চাহিদা মেটানোর দিকে মনোযোগী হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও টিকার বৈশ্বিক জোট গ্যাভির গত ২৫ মার্চের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ভারত থেকে সিরামের টিকা সরবরাহ মার্চ বা এপ্রিল পর্যন্ত বিলম্বিত হতে পারে। ভারতে টিকার অতিরিক্ত চাহিদা ও প্রয়োজন থাকায় এ বিলম্ব হচ্ছে।’
এখন পর্যন্ত অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা ফার্মাসিউটিক্যালসের গবেষণালব্ধ টিকার প্রায় তিন কোটি ডোজ সরবরাহ করেছে ভারত। মার্চে আরও চার কোটি আর এপ্রিলে আরও নয় কোটি ডোজ টিকা রপ্তানির কথা ছিল দেশটির।
এই বিপুল পরিমাণ টিকা সরবরাহে অনিশ্চয়তা কাটাতে ভারতীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলেও জানানো হয় গ্যাভির পক্ষ থেকে।
অবশ্য এবারই প্রথম নয়, গত জানুয়ারিতেও কোভ্যাক্সের আওতায় টিকা বিতরণ বিলম্বিত হয় ভারতের কারণে। সে সময় সিরামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আদর পুনাওয়ালা বলেছিলেন, ‘অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে এবং নিজ ভূখণ্ডে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে সময়মতো টিকা সরবরাহে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে এ বিলম্ব হচ্ছে।’
কিন্তু ভারতের এ পদক্ষেপের প্রভাব পড়ে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে।
আফ্রিকার রোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরিচালক সে সময় সতর্ক করে বলেছিলেন, টিকা রপ্তানিতে ভারত সরকারের স্থগিতাদেশ পুরো অঞ্চলের জন্য বড় বিপর্যয়ের কারণ হবে।
সে সময় কোভ্যাক্স কর্মসূচির অন্যতম টিকাগ্রহীতা দেশ পাকিস্তান বাধ্য হয়েই নিজ উদ্যোগে টিকা আমদানি করতে শুরু করে।
বন্ধ টিকাকেন্দ্র, ফিরে যাচ্ছে মানুষ
অভ্যন্তরীণভাবে দুটি টিকা উৎপাদন করছে ভারত। একটি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ‘কোভিশিল্ড’ এবং অপরটি ভারতীয় গবেষকদের নিজস্ব উদ্ভাবিত ‘কোভ্যাক্সিন’।
গত জানুয়ারিতে করোনার টিকাদান শুরু হয় ভারতে। শুরুতে কেবল স্বাস্থ্যকর্মী ও প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আগস্ট মাসের মধ্যে ৩০ কোটি ভারতীয়কে টিকার আওতায় আনারও লক্ষ্য নেয় নয়াদিল্লি।
কিন্তু টিকার স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিয়ে ভারতীয়দের মধ্যে শঙ্কা, ধীর গতির কার্যক্রমসহ নানা কারণে লক্ষ্য অর্জনে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে দেশটি।
জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত টিকার দুই ডোজই নিয়েছেন এক কোটি ৪৩ লাখ মানুষ, ১৩৩ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে যা মাত্র এক শতাংশ।
এমন বাস্তবতায় জনগণের আস্থা বৃদ্ধিতে সরকারের একের পর এক পদক্ষেপ এবং মার্চ ও এপ্রিলে সংক্রমণ-মৃত্যু বাড়তে থাকায় সম্প্রতি টিকাদানে আগ্রহ বাড়ে মানুষের। এ অবস্থাতেই কিছু রাজ্যে টিকার তীব্র ঘাটতি তৈরি হয়।
টিকা সংকটে ওড়িশায় গত সপ্তাহে বন্ধ হয়ে যায় প্রায় ৭০০ কেন্দ্র।
পাঞ্জাবের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা রাজেশ ভাস্কর সিএনএনকে জানান, রাজ্যটিতে কোভিশিল্ডের (যা উৎপাদন করে সিরাম) সাড়ে চার লাখ এবং কোভ্যাক্সিনের ৩০ হাজার ডোজ মজুত আছে। অথচ রাজ্যে বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় তিন কোটি।
দিনে এক লাখ মানুষকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে রাজ্যটিতে কার্যক্রম শুরু হলেও ঘাটতির কারণে এর ধারেকাছেও নেই প্রশাসন।
মহামারিতে সবচেয়ে বিপর্যস্ত মহারাষ্ট্রে সাময়িক বন্ধ রয়েছে টিকা কার্যক্রম। মুম্বাইতে গত সপ্তাহে বন্ধ হয়ে গেছে ৭০টি কেন্দ্র। তাও এ পর্যন্ত এক কোটি ১১ লাখ বাসিন্দা টিকা নিয়েছেন মহারাষ্ট্রে, রাজ্যের হিসেবে যা সর্বোচ্চ।
এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু দেশ কাঁচামাল রপ্তানিতে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এর প্রভাবে টিকা উৎপাদনে পিছিয়ে পড়েছে সিরাম।
এমন বাস্তবতায় সিঙ্গাপুরসহ প্রতিবেশী কিছু দেশ থেকে কাঁচামাল রপ্তানিতে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।