এক মাসের বেশি সময় ধরে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। প্রায় প্রতিদিনই সংক্রমণ নতুন রেকর্ড ছুঁচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালেও বেড সংকট দেখা দিয়েছে। কঠিন হয়ে গেছে সেবা পাওয়া।
সংকটাপন্ন রোগীদের স্বজনেরা ছুটছেন এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে। অনেক সময় অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
রাজধানীর বড় বড় পাঁচটি বেসরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিয়েছে নিউজবাংলা। হাসপাতালে দেওয়া তথ্য উঠে এসেছে উদ্বেগজনক চিত্র।
রাজধানীর বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা চিকিৎসায় গঠিত বিশেষায়িত ইউনিটে সাধারণ বেড ও নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট (আইসিইউ) সবই পরিপূর্ণ।
এমন পরিস্থিতিতে রোগীর স্বজনেরা বলছেন, চিকিৎসা পেতে একদিকে যেমন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে, অন্যদিকে চিকিৎসা না পেয়ে রোগীর মৃত্যুর শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
হিমশিম ইউনাইটেড হাসপাতাল
চার সপ্তাহ ধরে ইউনাইটেড হাসপাতালে রোগীর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। করোনা রোগীদের সেবায় গঠিত ইউনিটে ১৫০ বেড রয়েছে। দুই সপ্তাহ ধরে এসব বেড রোগীতে পূর্ণ। এই হাসপাতালে ২২টি আইসিইউ গত ১৪ দিন ধরে পরিপূর্ণ। করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে রয়েছে শতাধিক চিকিৎসক। বাড়তি চাপ সামলাতে তারা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন।
হাসপাতালটির চিফ অফিসার সাগুফতা আনোয়ার বলেন, ‘পরিস্থিতি অনেক জটিল। রোগীর সংখ্যা বিপুল বেড়েছে। সাধারণ বেডে ভর্তি করা হয়েছে আসলাম নামক রোগীকে। হঠাৎ করে তার অক্সিজেন লেভেল কমে যাওয়ায় তার এক আত্মীয় আমেরিকা থেকে আমাকে ১০০ বার ফোন করেছেন আইসিইউয়ের জন্য। তবে আমাদের হাসপাতালে আইসিইউ ফাঁকা না থাকায় আমরা দিতে পারিনি।’
সাগুফতা আনোয়ার জানান, আইসিইউ-এর ব্যবস্থা না করে দিতে পারায় অনেকের খারাপ হচ্ছে।
রোগী ফিরিয়ে দিচ্ছে এভারকেয়ার
এভারকেয়ার হাসপাতালে করোনার বিশেষায়িত ইউনিটে কোনো আইসিইউ বেড ফাঁকা নেই দু সপ্তাহ ধরে। বাধ্য হয়েই রোগী ফিরিয়ে দিচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এভারকেয়ার হাসপাতালের উপব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কাইয়ুম খান রাজু বলেন, ‘তিন-চারদিন ধরে আমরা নতুন রোগী ভর্তি করতে পারছি না। ভর্তির জন্য আগতদের প্রতিদিনই ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। হাসপাতালে বর্তমান যারা ভর্তি রয়েছেন, তাদের সবার অবস্থা সংকটাপন্ন। রোগী ভর্তির জন্য অনুরোধ এলেও আমরা ভর্তি করতে পারছি না।’
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এই হাসপাতালে এখন দুটি আইসিইউ ও ২টি সাধারণ বেড খালি। এই হাসপাতালে সাধারণ বেড ২৮টি ও আইসিইউ আছে ১৯টি।
রোগীতে পরিপূর্ণ ইবনে সিনা হাসপাতাল
মহামারি করোনা সংক্রমণ দেখা দিলে ইবনে সিনা হাসপাতালে করোনার একটি বিশেষ ইউনিট খোলা হয়। এখানে ৫২টি বেড রয়েছে, সবগুলো ভর্তি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, হাসপাতালের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগী আসছেন। খালি না থাকার কারণে তাদের ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। অনেকেই মনে কষ্ট নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
হাসপাতালটির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার তাবিবুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হাসপাতালের ৫২টা বেড ও ৭টি আইসিইউ রোগীতে পূর্ণ। প্রতিদিন হাসপাতালে রোগী আসছেন। ধারণ ক্ষমতার বেশি রোগীদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শুধু শুধু রোগী ভর্তি করে কী লাভ, যদি চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব না হয়? যেসব রোগী আসছেন, তাদের অধিকাংশেরই আইসিউ প্রয়োজন হচ্ছে।’
নতুন রোগী নিচ্ছে না আনোয়ার খান মডার্ন
মহামারির শুরু থেকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতাল। গত এক মাস ধরে রোগীর চাপ বেড়েছে। ১৫ দিন ধরে এই হাসপাতালে নতুন করে করোনা রোগী ভর্তি বন্ধ।
করোনায় গঠিত ইউনিটে সব বেড রোগীতে পূর্ণ। হাসপাতালটির জনসংযোগ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা নিতে ৮৩ বেড ও ২২টি আইসিইউ রয়েছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে নতুন রোগীর জায়গা দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। চিকিৎসকেরা আন্তরিকতার সাথে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। তবে পরিস্থিতি এভাবে চললে অনেক রোগী চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবেন।’
বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটাল
বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ৬২টি সাধারণ বেড ও ৯টি আইসিইউ এক মাস ধরে ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছে না।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, প্রতিদিনই রোগী ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। যারা ভর্তি হচ্ছেন তাদের সবাই সংকটাপন্ন।
হাসপাতালের পরিচালক মোরশেদ ইমরান নিউজবাংলাকে, ‘মানুষের অনুরোধের কারণে অনেক সময় ফোন বন্ধ করে রাখি। এর মধ্যে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনও করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। কষ্ট লাগছে তাদের চিকিৎসায় কিছু করতে পারছি না। আইসিইউ ফাঁকা না থাকলে কীভাবে ম্যানেজ করব? পরিস্থিতি এমন, একজন করোনা রোগী সাধারণ বেডে ভর্তি হলো, দুইদিন পর তার আইসিউ প্রয়োজন হচ্ছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে আইসিইউ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এই কারণে আমরা একটা তালিকা তৈরি করেছি। এভাবেই চলছে গত এক মাস।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে না পারলে শয্যা বৃদ্ধি করেও লাভ হবে না। চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধেই গুরুত্ব বেশি দিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, রাজধানীর নয়টি বেসরকারি হাসপাতালের সাধারণ বেড রয়েছে ৭৭২টি। এর মধ্যে ফাঁকা রয়েছে ১৪৫টি। ১৮০টি আইসিইউয়ের মধ্যে ফাঁকা রয়েছে মাত্র ১৪টি।