দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ছিল গত ডিসেম্বর থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। এরপর থেকে তীব্র গতিতে ছুটছে। গত দুই সপ্তাহে শনাক্তের হার বেড়েছে ১৪ শতাংশের বেশি।
২ এপ্রিল পর্যন্ত কোভিড-১৯ শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৬ লাখ ২৪ হাজার ৫৯৪ জন। এদিকে টানা ছয় দিন পাঁচ হাজারে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে।
এমন পরিস্থিতির পেছনে গণটিকাদান শুরুর পর মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতাকেই মূলত দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনাভাইরাসের নতুন ধরনও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন তারা।
হঠাৎ সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় জনগণের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। জনগণকে আতঙ্কিত না হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর জোর দিতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগে লকডাউনে যাচ্ছে সরকার। একই সঙ্গে মাস্ক পরাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে ১৮ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সংক্রমণ কমতে কমতে গত ৩ ডিসেম্বর শনাক্তের হার নেমে এসেছিল ২-এর ঘরে। চলতি সপ্তাহে তা ছাড়িয়ে গেছে ২৩ শতাংশের বেশি। গত ১৪ দিনে শনাক্তের হার বেড়েছে ১৮ শতাংশের বেশি। গত বছরের ১৬ জুলাই এর চেয়ে বেশি রোগী শনাক্তের খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেদিন শনাক্ত ছিল ৩ হাজার ৭৩৩ জন। তবে গত ছয় দিন পাঁচ হাজারের ওপরে রোগী শনাক্ত হচ্ছে তা এক বছরের মধ্যে দেখেনি বাংলাদেশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত বছর ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজনের শরীরে করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ সরকারিভাবে প্রথম মৃত্যুর ঘোষণা আসে। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকে। মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত শনাক্তের হার ছিল ২০ শতাংশের ওপরে।
এর পর ধীরে ধীরে কমতে থাকে। গত বছরের ৩ ডিসেম্বর রোগী শনাক্তের হার কমে ২ দশমিক ৯১ শতাংশে নেমে আসে। ডিসেম্বর থেকে ৮ মার্চ পর্যন্ত শনাক্তের হার ছিল ৫ শতাংশের নিচে। তবে গত ৯ মার্চ তা বেড়ে ৫ দশমিক ১৩ শতাংশে পৌঁছায়। ৩ এপ্রিল শনাক্তের সংখ্যা ছিল ২৩ শতাংশের ওপরে।
দেশে এখন পর্যন্ত করোনায় মৃত্যু হয়েছে ৮ হাজারের বেশি মানুষ। শনাক্ত হয়েছেন ৬ লাখ ৩০ হাজার ২৭৭ জন। আর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে টিকা নিয়েছেন ৫৪ লাখের বেশি মানুষ। তাদের মধ্যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে ৯৩৬ জনের শরীরে। টিকা পেতে নিবন্ধন করেছেন ৬৮ হাজারের বেশি।
হঠাৎ কেন করোনা সংক্রমণ বাড়ছে তার কারণ অনুসন্ধান করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে। এতে দেখা গেছে, গত ৭ ফেব্রুয়ারি গণটিকাদান শুরু হওয়ার পর থেকেই মানুষের মধ্যে গা-ছাড়াভাব তৈরি হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মানছে না মানুষ। বিয়েশাদি ও সামাজিক অনুষ্ঠান, ভ্রমণ বেড়েছে। এসব কারণেই রোগী বাড়ছে। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণেই করোনা বাড়ছে। এরই মধ্যে আইসিইউ সংকট দেখা দিয়েছে।
গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে করোনা সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে গত ফেব্রুয়ারি মাসে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। করোনার প্রকোপ শীতে কম কেন এমন প্রশ্নে নিউজবাংলাকে তিনি বলেছিলেন, শীতে অন্যান্য ভাইরাসের প্রকোপ বেশি থাকে। এ কারণে শীতকালে করোনা সংক্রমণ অনেকটা কমে আসে।
করোনা কেন হঠাৎ বাড়ছে এবং প্রতিরোধে করণীয় জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মানা পূর্বশর্ত। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে শিথিলতা রয়েছে। আমরা মাস্ক পরছি না। বিয়েশাদি ও সামাজিক অনুষ্ঠান স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে গেছে।
‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই। টিকা নেই আর না নেই, আমাদের মাস্ক পরতে হবে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। ৩০ মিনিট পরপর হাত ধুতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই করোনাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।’ সরকার যে নকডাউন ঘোষণা করেছে। স্বাস্থ্যবিধি মানা বিষয়ে গুরুত্ব নেয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি সারা বিশ্বে দেখা দিয়েছে, এটা শুধু বাংলাদেশে নয়। যে কারণে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে হবে। করেনা ভাইরাসের প্রথম ডোজ টিকা দেয়া বন্ধ হচ্ছে আগামী সোমবার। আগামী ৮ এপ্রিল থেকে করোনার টিকার দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ শুরু হবে। প্রথম ডোজ যারা নিয়েছেন, তাদের দ্বিতীয় ডোজের জন্য মোবাইল ফোনে এসএমএস দেয়া হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, করোনার নতুন ধরন একটু ভিন্ন। আক্রান্ত ব্যক্তি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। নতুন ধরনে কারও ক্ষেত্রে ফুসফুস, আবার কারও গ্যাস্ট্রো এন্টারোলজিক্যাল সিস্টেমগুলো মারাত্মকভাবে সংক্রমিত হয়। তখন দ্রুততম সময়ে চিকিৎসার আওতায় নেয়া প্রয়োজন। এ জন্য হাসপাতালগুলোকে জোরদার প্রস্তুতি নিতে হবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, পর্যটন কেন্দ্রগুলো থেকে করোনা বেশি ছড়াচ্ছে। হাসপাতালে যেসব রোগী ভর্তি হচ্ছেন, তারা দুই-এক মাসের মধ্যে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র ভ্রমণ করেছেন। পর্যটন কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’
যেভাবে বেড়েছে শনাক্তের হার
করোনাভাইরাস প্রথম ধরা পড়ে আট মার্চ, এরপর মার্চজুড়ে শনাক্তের হার ছিল ৩ দশমিক ১৮ শতাংশে। এপ্রিলে এই হার ১২ দশমিক ০৮-এ এসে দাঁড়ায়, মে মাসে হার ছিল ১৬ দশমিক ১৭। জুনের দিকে শনাক্তের হার একটু বেড়ে ২১ দশমিক ৪৯-এ দাঁড়ায়। জুলাইয়ে সেটা আরও বেড়ে ২২ দশমিক ৪৬ শতাংশে দাঁড়ায়। এরপর আবার কমতে থাকে করোনা শনাক্তে হার। আগস্টজুড়ে হার ছিল ২০ দশমিক ১৮। সেপ্টেম্বর শনাক্তের হার নেমে আসে ১২ দশমিক ৭০-তে।
নভেম্বরে আবার করোনার সংক্রমণ বাড়তে থাকে, এ মাসে শনাক্তের হার ছিল ১৩ দশমিক ১২। ডিসেম্বর ও জানুয়ারির শেষ দিক থেকে ফেব্রুয়ারি শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত করোনা নিয়ন্ত্রণে ছিল দেশে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে থেকে করোনা শনাক্তের হার বাড়তে থাকে। আর মার্চ শনাক্তের হার ১০ দশমিক ১৯।