করনোভাইরাসের সংক্রমণ আবার বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে করণীয় নির্ধারণে সরকারের উচ্চমহলে চলছে আলাপ-আলোচনা। প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে সাধারণ ছুটি বা ‘অঘোষিত লকডাউন’-এর বিষয়টিও। এ ব্যাপারে সরকার থেকে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত আসছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠান শেষে।
ইতিমধ্যে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করাসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে মোট ১২টি সুপারিশ পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি- সব বিবেচনায় রেখে এই মুহূর্তে লকডাউনে যাওয়া সম্ভব নয়।
সাধারণ ছুটির ঘোষণা আসতে পারে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন স্বাস্থ্যসচিব আবদুল মান্নান। রোববার তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ছুটির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে স্বাধীনতা দিবস ও সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে দেশে অনুষ্ঠান চলছে, মানুষ উদযাপন করছে যথাযোগ্য মর্যাদায়। আমাদের যদি ছুটি প্রসঙ্গে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তাহলে হয়তো অনুষ্ঠান শেষে নেয়া হতে পারে।’
সরকার স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ভাবছে উল্টো কথা। তারা যেসব প্রতিষ্ঠান খোলা আছে, সেগুলোও বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে। এ ছাড়া গণপরিবহনে যাত্রী সীমিত করা, জনসমাগম কমানোর পরামর্শও রেখেছে তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘গত বছর এই সময়ে এরকমই করোনা সংক্রমণ ছিল, সেই সময় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়নি। সেই সময়েও স্বাস্থ্যবিধি মানাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। এখনও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি।’
সভা-সমাবেশ সীমিত করার সপক্ষে ফ্লোরা বলেন, ‘যেসব সভা না করলে ভালো হয় সেগুলো এড়িয়ে যাওয়া। যদি ঘরে বসে কাজ করা সম্ভব হয়, তাহলে ঘরের বাইরে না যাওয়া ভালো।’
করোনার সংক্রমণ বাড়তির দিকে থাকলেও লকডাউনে যাওয়ার মতো বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই বলে মত বিশেষজ্ঞদের।করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম মনে করেন, ‘লকডাউনে যাওয়ার বাস্তবতা নেই বাংলাদেশে।’
নিউজবাংলাকে এই ভাইরাস বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘১২ দফার বিষয়ে শুনেছি। তাদের প্রস্তাবনা ভালো, তবে করোনার ঊর্ধ্বগতি থাকলেও বাংলাদেশের মতো দেশে লকডাউনের প্রয়োজন নেই। সর্বোচ্চ আমরা মকআপ করতে পারি।’
‘মকআপ’-এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা।’
করোনা মোকাবিলায় প্রতিবেশী ভারতসহ বিভিন্ন দেশ লকডাউনে গেলেও বাংলাদেশ কখনও ওই পথে হাঁটেনি। তবে গত বছরের মার্চে ধাপে ধাপে দুই মাসেরও বেশি সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়।
২০২০ সালের মার্চে করোনা সংক্রমণ দেখা দেয়ার পর তা নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি এক দিনে পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার কমে দাঁড়ায় ২ দশমিক ৯১ শতাংশ।
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল করোনাভাইরাস পরিস্থিতি।ফেব্রুয়ারি মাসজুড়েই করোনা শনাক্তের হার ছিল ৫ শতাংশের নিচে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নীতিমালা অনুযায়ী, টানা দুই সপ্তাহ পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে করোনা নিয়ন্ত্রণে ধরা যায়। বাংলাদেশে সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে ছিল টানা আট সপ্তাহের বেশি।
পিছু হটা করোনা গরমের শুরু থেকে বাংলাদেশে আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। দিনে ২ হাজারের আশপাশে পাওয়া যাচ্ছে নতুন রোগী, যা গত তিন মাসে দেখা যায়নি।
দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলো কি না এ ব্যাপারে সরকার থেকে এখনও কিছু বলা না হলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক নীতিমালা বলছে, বাংলাদেশে আসলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে।
সংস্থাটির নীতিমালা অনুযায়ী, যদি টানা দুই সপ্তাহ শনাক্তের হার বাড়তে থাকে তাহলে নতুন ঢেউ আসছে বলে ধরা হয়।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১০ মার্চ থেকে টানা ১০ দিন প্রতিদিন রোগী শনাক্ত হয়েছে হাজারের ওপরে। শনাক্ত হার থাকছে কখনও ১০ বা এর বেশি বা এই হারের আশপাশে। মৃত্যুর সংখ্যাও উদ্বেগজনক।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ইউরোপ-আমেরিকায় আরও বিধ্বংসী হয়েছে। প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউয়ে মানুষের মৃত্যু হয়েছে বেশি। এ কারণে স্বাস্থ্যবিধি প্রয়োগে আবারও কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
গত মঙ্গলবার অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশার মো. খুরশীদ আলমের সভাপতিত্বে এক জরুরি সভায় এসব পরামর্শসহ মোট ১২টি প্রস্তাব গৃহীত হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশার খুরশীদ আলম। ছবি: সংগৃহীত
অধিদপ্তরের একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রস্তাবগুলো সভায় আলোচনা করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ নিয়ে আজও আলোচনা হয়েছে। এসব সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার ক্ষমতা আমাদের হাতে নেই। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে নির্দেশনা দিলে সেগুলো বাস্তবায়ন করব আমরা।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিছু বিষয়ে আলোচনা করেছে নিজেদের অভ্যন্তরীণ সভায়। পরে মূল বৈঠক হয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। সেখানে বলা হয়েছে, লকডাউন এখনই নয়’।
তবে ওই সভায় স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করার বিষয়টির ওপর জোর দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন খুরশীদ আলম।
করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে করণীয় কী এমন প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মানা পূর্বশর্ত। যেটা আমাদের মধ্যে শিথিলতা দেখা দিয়েছে। আমার মাস্ক পরছি না। বিয়েশাদি ও সামাজিক অনুষ্ঠানে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাচ্ছি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।তিনি বলেন, ‘সবার কাছে একটা পরিষ্কার তথ্য থাকার দরকার- স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। টিকা নিই আর না নিই আমাদের মাস্ক পরতে হবে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। ৩০ মিনিট পরপর হাত ধুতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই করোনাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
‘করোনা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সকল প্রস্তাব মন্ত্রণালয়কে জানাচ্ছি। সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করেই করোনা নিয়ন্ত্রণে আসছে। কিছুদিন ধরে রোগী শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে গেছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মেনে কাজ করছি। তবে জীবন ও জীবিকার দুইটা বিষয় মাথায় রেখেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটা বাস্তবায়নে আমরা জোর দিচ্ছি।’