অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাস টিকা নেয়ার পর ইউরোপে বেশ কয়েকজনের মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধার খবর বেরিয়েছে সংবাদ মাধ্যমে। কয়েকজনের মৃত্যুর অভিযোগও উঠেছে।
অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দাবি টিকার সঙ্গে রক্ত জমাট বাঁধার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার সঙ্গে রক্ত জমাট বাঁধার সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়ার দাবি করেছেন ইউরোপের একদল বিজ্ঞানী। শুধু তাই নয়, রক্ত জমাট বাঁধার কারণও তারা চিহ্নিত করেছেন।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকায় রক্ত জমাট বাঁধার অভিযোগ ওঠার পর নরওয়ে ও জার্মানির গবেষকদের দুটি দল ওই টিকা নিয়ে গবেষণা করেন। এতে দেখা যায়, টিকাটি নেয়ার পর অল্প কিছু ক্ষেত্রে আপনাআপনি প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিক্রিয়া হতে পারে, যা মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধতে ভূমিকা রাখে। পুরো প্রক্রিয়াটিকেই বিরল হিসেবে বলছেন বিজ্ঞানীরা।
অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নেয়ার পর জটিলতায় পড়া কয়েকজনকে পরীক্ষা করে দেখা যায়, তারা সেরেব্রাল ভেনাস সাইনাস থ্রম্বসিস বা সিভিএসটি নামের রক্ত জমাট বাঁধাজনিত সমস্যায় ভুগছেন। আক্রান্তদের বেশির ভাগই নারী এবং তাদের বয়স ৫৫ বছরের নিচে।
ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত সপ্তাহে ইউরোপের ১৩টি দেশ এ টিকা প্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ করে। দেশগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, সতর্কতামূলক পদক্ষেপের অংশ হিসেবে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
অ্যাস্ট্রাজেনেকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের উদ্ভাবিত টিকার কারণে রক্ত জমাট বাঁধে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
প্রতিষ্ঠানটি আরও জানিয়েছে, যুক্তরাজ্য ও ইইউভুক্ত দেশের ১ কোটি ৭০ লাখেরও বেশি মানুষ এ টিকা নিয়েছে। ৮ মার্চের দিকে এদের মধ্যে কেবল ৩৭ জন ব্যক্তি রক্ত জমাটের কথা বলেছেন। যে পরিমাণ মানুষ এ টিকা নিয়েছে, সে তুলনায় এ সংখ্যা নিতান্ত কম।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউরোপিয়ান মেডিসিন্সস এজেন্সি (ইএমএ) টিকাটি নিয়ে পর্যালোচনায় বসে। বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনও প্রকাশ করে তারা। সেখানে বলা হয়, রক্ত জমাট বাঁধার সঙ্গে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার কোনো সম্পর্ক নেই।
সংস্থাটি টিকা প্রয়োগ অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে বলে, টিকার উপকারিতা এত বেশি যে এর সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলা সম্ভব।
ইএমএর বক্তব্যের পরপরই শুক্রবার জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেন অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রয়োগের ওপর স্থগিতাদেশ তুলে নেয়।
তবে টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে বলেও সতর্ক করে দেশগুলো।
ফ্রান্সে টিকা নেয়ার পর তিনজনের দেহে রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা ঘটে। শুক্রবার দেশটিতে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাদান কর্মসূচি ফের শুরু হয়। তবে ফরাসি সরকারকে ৫৫ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদেরই কেবল টিকা দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে দেশটির স্বাস্থ্যসেবা কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ডসহ অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রয়োগ স্থগিত করা ইউরোপের অন্যান্য দেশ জানিয়েছে, ফের টিকাদান কর্মসূচি শুরুর আগে এ টিকা নিয়ে তারা আরও গবেষণা করবে।
অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নেয়া জার্মানির প্রায় ১৬ লাখ মানুষের মধ্যে ১২ নারীসহ ১৩ জনের রক্ত জমাট বাঁধে। এদের মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়। নরওয়েতে তিন জনের শরীরে রক্ত জমাট বাঁধে। এদের একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়ে নরওয়ের গবেষণাকারী দলের নেতৃত্বে আছেন অধ্যাপক পাল আন্ড্রে হোম। তিনি অসলো ইউনির্ভাসিটি হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক।
হোম বলেন, টিকার কারণে সৃষ্ট অ্যান্টিবডি শনাক্ত করেছে তার দল। এর কারণেই দেহে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, টিকা নেয়ার পর কেন মানবদেহে আপনাআপনি প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, তা টিকা উদ্ভাবনকারী দলই বলতে পারবে।
অধ্যাপক হোমের গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন জার্মানির গ্রাইফসভাল্ট ইউনিভার্সিটি ক্লিনিকের অধ্যাপক আন্ড্রেয়াস গ্রাইনাকার।
তিনি বলেন, তার নেতৃত্বাধীন গবেষণা দলও নরওয়ের গবেষক দলের মতো একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে।
অস্ট্রিয়া, আয়ারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের গবেষকদের সঙ্গে কাজ করছেন জার্মানির গবেষকেরা। তারা এক বিবৃতিতে বলেন, টিকা নেয়ার চার দিনের মাথায় মাথাব্যথা, মাথাঘোরা বা চোখে কম দেখার মতো উপসর্গ দেখা দিলে রক্ত পরীক্ষা করে তা সহজে শনাক্ত সম্ভব। এরপর প্রচলিত সাধারণ চিকিৎসার মাধ্যমেই মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধা ঠেকানো সম্ভব।
গ্রাইনাকার বলেন, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘খুবই অল্পসংখ্যক মানুষের দেহে টিকা পরবর্তী জটিলতা দেখা দিতে পারে। আর এমনটা ঘটলে রোগীদের কী চিকিৎসা দেয়া উচিত, তা আমরা জানি। দ্রুত রোগ নির্ণয় করা গেলে যেকোনো মাঝারি পর্যায়ের হাসপাতাল এর চিকিৎসা দিতে পারবে।’
গ্রাইনাকার বলেন, তারা গবেষণা প্রতিবেদনটি আগামী কয়েকদিনের মধ্যে যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যানেসেটে প্রকাশের জন্য জমা দেবেন।
এদিকে অধ্যাপক গ্রাইনাকারের গবেষণা পর্যালোচনা করেছে জার্মান সোসাইটি ফর থ্রম্বসিস অ্যান্ড হেমোস্টাসিস রিসার্চ। শুক্রবার এক বিবৃতিতে সংস্থাটি রোগ নির্ণয় ও রোগের চিকিৎসা কী হতে পারে, সে বিষয়ে চিকিৎসকদের পরামর্শ দেয়।
সোসাইটি ফর থ্রম্বসিস অ্যান্ড হেমোস্টাসিস রিসার্চের ডেপুটি চেয়ারম্যান ডা রবার্ট ক্ল্যামরোথ বলেন, টিকাগ্রহীতাদের মধ্যে বিরল প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিক্রিয়া জার্মানিতে বেশি দেখা গেছে। কারণ শুরুর দিকে দেশটি ৬৪ বছরের নিচের ব্যক্তিদের টিকা দেয়। অন্যদিকে তুলনামূলকভাবে যুক্তরাজ্যে বেশি মানুষকে টিকা দেয়া হয়েছে। কিন্তু রক্ত জমাট বেঁধেছে এমন রোগীর সংখ্যা সেখানে কম। কারণ দেশটিতে বয়স্ক ব্যক্তিদেরই টিকার আওতায় আনা হয়েছিল।
ক্ল্যামরোথ বলেন, রোগ নির্ণয়ের পর রক্ত পাতলা করা ওষুধ ও জটিলতা সৃষ্টিকারী অ্যান্টিবডি মোকাবিলা করতে সক্ষম ইমিউনোগ্লোবুলিন দিয়ে রক্ত জমাট বাঁধার চিকিৎসা করা উচিত।
তিনি বলেন, ‘অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকায় আপনাআপনি প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, যা অ্যন্টিবডি তৈরি করছে। এসব অ্যান্টিবডি পরে রক্তের প্লাটিলেটে মিশছে। তবে কেন এটা হচ্ছে, তা আমরা বলতে পারছি না।’