ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) আগুনের পর সেখান থেকে রোগীদের সরিয়ে নেয়া হয়েছে। রাখা হয়েছে হাসাপাতালের পৃথক আইসিইউ ও হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ)।
হাসপাতালের নতুন ভবনের তৃতীয় তলায় বুধবার সকাল ৮টার দিকে আগুনের সূত্রপাত। এ সময় রোগী স্থানান্তরে গুরুতর অসুস্থ তিন রোগীর মৃত্যু হয়।
ওই ওয়ার্ডের বাকি রোগীদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, আগুন লেগেছিল ১৪ বেডের আইসিইউতে। ১৪ জন রোগী ছিলেন। আগুনের ঘটনায় তাদের সবাইকে করোনার জন্য আলাদা ১০ বেডের একটি আইসিইউ আছে, সেখানে স্থানান্তর করেছি। মানসম্পন্ন কিছু এসডিইউ আছে, সেখানেও কিছু রোগীকে স্থানান্তর করেছি। কেউ কিন্তু আগুনে মারা যাননি। স্থানান্তরের পর অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তিন রোগী মারা যান।’
নাজমুল হক বলেন, ‘ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আমাদের করোনার ব্যাপক কার্যক্রম। বলা যায় সারা দেশের করোনা আক্রান্ত অর্ধেক রোগীর চাপ সামলাই আমরাই। আমাদের মোট আইসিইউ ২৪ বেডের। এর মধ্যে ১৪ বেডের আইসিইউতে আগুন লাগে। এ ছাড়া আমাদের আইসিইউ মানসম্পন্ন এসডিইউ আছে।’
নাজমুল জানান, করোনা ইউনিটের আইসিইউ চালু করা হয় বিশেষ প্রয়োজনে। একটা সিট ১০ মিনিটও খালি থাকে না। ওই ইউনিটে ৫৩৩ জন রোগী রয়েছে। অতিরিক্ত রোগীর চাপে অনেক সময় সবার জন্য আইসিইউ নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না।
নিজেদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিশেষ পরিস্থিতির কারণে কিন্তু অনেকটা তাড়াহুড়া করে আইসিইউ চালু করা হয়েছিল। এই আইসিইউ ২৪ ঘণ্টা চালানোর জন্য যে ধরনের সার্বক্ষণিক সক্ষমতা, স্ট্যাবিলিটি, পারফরমেন্স দরকার সেটা আমরা পারিনি।
ক্ষতি প্রায় ২ কোটি টাকা
আইসিইউতে আগুনে ক্ষতি সম্পর্কে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক নাজমুল হক বলেন, ‘আইসিইউ প্রতি খরচ হয়েছে ধরেন প্রায় ২০ লাখ টাকা। যদি ১০ লাখ টাকা করেও ধরি তাহলে মিলে এর ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক প্রায় ২ কোটি টাকা।’
কবে নাগাদ তবে এই আইসিইউ চালু করা সম্ভব জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা চালু করা এখনই সম্ভব নয়। এটা আমরা নতুন করে সুন্দর করে তৈরি করব। আইসিইউ চালানোর জন্য যে ধরনের বেসিক রিকোয়ারমেন্ট দরকার সেসব চালু আছে। আগুনে আইসিইউটি যে ভস্মীভূত হয়ে গেছে তা কিন্তু নয়।’
আগুনের পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ)। ছবি: নিউজবাংলাআরও আইসিইউ দরকার
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবার বাড়ছে। বাড়তি রোগীর চাপ সামলাতে এই ইউনিটে আরও এসির দরকার বলে জানিয়েছেন পরিচালক নাজমুল হক।
‘আমাদের এই মুহূর্তে চাপ সামলাতে আইসিইউ দরকার। আমাদের বাকি যে ১০ বেডের আইসিইউ আছে সেটা মূলত সার্জারি আইসিইউ। ওটার কিছু বেড খালি থাকবে। সেখানে আমরা মেডিসিনের রোগীদের পাঠাচ্ছি। সেখানে মেডিসিনের ডাক্তারদের শিফট করে রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হবে।
‘আমাদের ওখানে আরেকটি ভালো স্পেস আছে, তা হলো পোস্ট অপারেটিভ। এটা আইসিইউ মানসম্পন্ন। সেখানে আমরা আইসিইউ মানের চিকিৎসা সেবাটা চালু করব। আমাদের যে সমস্ত হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) আছে, ক্ষতিগ্রস্ত আইসিইউ চালুর আগে পর্যন্ত আমরা এই এইচডিইউগুলো আরও উন্নত করে আইসিইউর চাপটা সামলানোর পরিকল্পনা করেছি।’
যা বলছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা
গোলাম মোস্তফা আইসিইউ ১২ নম্বর বেডে ছিলেন। তার শ্যালক জামান বলেন, ‘আমরা বাইরে ছিলাম। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল আমার পেশেন্ট জীবিত ছিলেন। ভেতরের লোকজন যাদের অবস্থা ভালো তাদের আগে সরিয়েছেন। আমার রোগীর কাছে যেতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমাদেরকে আনসাররা ঢুকতে দেয়নি।
গোলাম মোস্তফা গত ১১ মার্চ ব্রেন ও ফুসফুসের সমস্যা নিয়ে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হন। করোনা টেস্টে পজিটিভ হওয়ায় করোনা ইউনিটের আইসিইউতে নিয়ে আসা হয়।
করোনা ইউনিটের ভেতরে থাকা ফায়ার এক্সটিংগুইশারগুলো সঠিকভাবে কাজ করেনি বলে দাবি স্বজনদের। করোনা ইউনিটে থাকা নার্স এবং স্টাফদের অবহেলার অভিযোগ করেছেন স্বজনরা।
১০ নম্বর বেডে ছিলেন মাহবুব মন্ডল। তিনি বেঁচে আছেন। তবে তার অবস্থাও ভালো না। আগুন লাগার সময় ১০ নম্বর বেডে বাবার পাশে ছিলেন ছেলে ইসলামুল হক।
আগুনের সূত্রপাত নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার পেশেন্ট ছিল ১০ নম্বর বেডে। ১২ নম্বর বেডে আইসিইউ মেশিনের শর্ট সার্কিট হয়। এতে আগুনের সূত্রপাত হয়। তখন আমি আমার পেশেন্টের পাশে দাঁড়ানো। আগুনটা একটা পাইপের সঙ্গে লাগার পর ১২ নম্বর পেশেন্টের যে গার্ডিয়ান ছিলেন, তিনি বাড়ি দিয়ে পাইপটা সরিয়ে দেন। তখন আগুনটা উপরে উঠে যায়।
‘আগুন বেড়ে যাওয়ার পর ভেতরে থাকা সিস্টার, আনসার সবাই পালিয়ে যান। আগুন বেড়ে যাওয়ায় আমার বাবার অক্সিজেন খুলে বাইরে নিয়ে আসি। পাশ থেকে একটি সিলিন্ডার ম্যানেজ করে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এখন পর্যন্ত আমাদের পেশেন্টকে আইসিটিতে স্থানান্তর করা হয়নি।’