ভয় ছিল শীতে। কিন্তু ঠান্ডা কেটে গরম পড়ার পর বাড়ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। এমন সময় এটি হচ্ছে, যখন করোনার বিস্তার রোধে গণটিকাদান শুরু হয়ে গেছে।
গত ছয় দিন রোগী শনাক্তের সংখ্যা ছিল হাজারের ওপরে। তার চেয়ে বড় কথা, পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার এক মাস আগের তুলনায় তিন গুণ হয়ে গেছে।
রোববার সকাল থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২১৯টি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা করা হয় ১৮ হাজার ৬৯৫টি। এদের মধ্যে করোনা সংক্রমণের তথ্য মিলেছে ১ হাজার ১৫৯ জনের শরীরে।
পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
এর আগের ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্ত হয় ১ হাজার ১৪ জনের দেহে। বৃহস্পতি থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয় ১ হাজার ৬৬ জনের দেহে।
তার আগের ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত ছিল ১ হাজার ৫১ জন। বুধবার ভাইরাসটি শনাক্ত হয় ১ হাজার ১৮ জনের দেহে।
শনাক্তের পাশাপাশি বাড়ছে মৃত্যু। এক মাস আগেও দিনে পাঁচ থেকে সাতজনের মৃত্যুর তথ্য এলেও সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ২৪ ঘণ্টায় ২৬ জনের মৃত্যুর তথ্য জানানো হয়। গত ৬৭ দিনে এত বেশি মৃত্যু দেখেনি বাংলাদেশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ৩ ফেব্রুয়ারি এক দিনে পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার কমে হয়েছে ২ দশমিক ৯১ শতাংশ। এটি গত বছরের ৪ এপ্রিলের পর ছিল সর্বনিম্ন।
ফেব্রুয়ারি মাসজুড়েই করোনা শনাক্তের হার ছিল ৫ শতাংশের নিচে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নীতিমালা অনুযায়ী, টানা দুই সপ্তাহ পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে করোনা নিয়ন্ত্রণে ধরা যায়।
বাংলাদেশে সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে ছিল টানা আট সপ্তাহের বেশি।
তবে ৬ মার্চ এই শনাক্তের হার ৫ শতাংশের ওপরে আসে। এরপর থেকে তা আরও বাড়তে থাকে। তবে ডব্লিউএইচওর আরেক নীতিমালার কারণে এখনও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে কি না, তা বলা যাচ্ছে না।
নীতিমালা অনুযায়ী, যদি টানা দুই সপ্তাহ শনাক্তের হার বাড়তে থাকে তাহলে নতুন ঢেউ আসছে বলে ধরা হয়।
৬ মার্চ থেকে দুই সপ্তাহ হতে আরও কয়েক দিন বাকি আছে। তবে সংক্রমণের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, তাতে দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ইউরোপ আমেরিকায় আরও বেশি বিধ্বংসী হয়েছে। প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউয়ে মানুষের মৃত্যু হয়েছে বেশি। এ কারণে বাংলাদেশ সরকার মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে আবার কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গ্রীষ্ম আসতে না আসতে করোনার সংক্রমণ বাড়ার বিষয়টি কেবল বাংলাদেশে নয়, প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তানেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। দুটি দেশেই বেশ কিছু শহরে নতুন করে লকডাউন দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ বি এম আবদুল্লাহ। ছবি: সংগৃহীত
বিশেষজ্ঞ মত
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ বি এম আবদুল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কিছু দিন হলো করোনা শনাক্তের হার বাড়ছে। এটা করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কি না, এ বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাবে না। আরও অপেক্ষা করতে হবে।
‘আগামী দুই সপ্তাহ যদি এই হার বাড়তে থাকে তাহলে বুঝতে হবে দেশে করোনা দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে।’
স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সামনে বড় বিপদ জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, ‘প্রায় দুই মাস দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণে ছিল, যে কারণে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে উদাসীনতা দেখা দিয়েছে। টিকা নেওয়ার পর অনেকে স্বাস্থ্যবিধি ও মাস্ক পরা ছেড়ে দিয়েছেন। রাজনৈতিক সমাবেশ, সামাজিক অনুষ্ঠানেও মানা হচ্ছে না শারীরিক দূরত্ব।
‘গত দুই সপ্তাহে বিদেশ থেকে প্রচুর মানুষ দেশে আসছে। তাদেরও সেভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে স্বাস্থ্যবিধি মানায় জোর দেয়া।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেহেতু আমাদের দেশে এমন কোনো গবেষণা করা সম্ভব হয়নি, সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যদ্বাণী দেয়া ঠিক হবে না। তবে আমরা করোনার দ্বিতীয় ঢেউকে একেবারেই উড়িয়ে দেব না। টিকা দিলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে হবে।’
তিনি বলেন, ‘৬ দিনের বৃদ্ধিকে দ্বিতীয় ঢেউ বলা ঠিক হবে না। তবে শনাক্তের হার ধারাবাহিকভাবে যদি দুই সপ্তাহ পার হয় তাহলে আমরা বলব, দ্বিতীয় ঢেউ দেশে এসেছে।’
সরকারের নতুন করে কিছু বিশেষ সতর্কতা জারি করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যেসব জায়গায় জনসমাগম হয়, সেটা রাজনৈতিক ধর্মীয় বা সামাজিক হোক, সবগুলোতে নিরুৎসাহিত করতে হবে। এমনকি এসব অনুষ্ঠান বন্ধে সরকারে ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
‘যারা এখন বিদেশ থেকে আসছে, তাদের জিনোম সিকোয়েন্স পরীক্ষা করতে হবে। তারা নতুন ধরনের করোনা নিয়ে দেশে প্রবেশ করছে কি না, জানার চেষ্টা করতে হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। ছবি: সংগৃহীত
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কী বলছে?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা নিউজবাংলাকে জানান, নতুন ধরনের করোনায় আক্রান্ত ছয়জনকে শনাক্ত করা হয়েছে।
দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিষয়টিকে ‘অনেকটা আপেক্ষিক’ হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি।
নিজের যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, অন্যান্য দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে। কারণ, তারা শুরুতেই কঠোর লকডাউনে ছিল। যখন লকডাউন খুলে দেয়া হলো, তখন সংক্রমণের হার বাড়তে শুরু করছে। ওখানে ভাইরাস পরিবর্তনের কারণে এটা হতে পারে। আরও অনেক কারণ থাকতে পারে।
সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় ঢেউ পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে সাধারণ মানুষের সচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর। আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলায় সংক্রমণের হার বেড়েছে।’