মোহাম্মদ ইসলাম গণি অধ্যাপনা করতেন রাজধানীর সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়ায়। থাকতেন মিরপুরের টোলারবাগে। চাকরি ছেড়েছিলেন বেশ কয়েক বছর আগে। অবসর জীবনে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঘরেই কেটে যেত সময়। তবে নামাজ আদায় করতে যেতেন পাশের মসজিদে।
গত বছরের মার্চের মাঝামাঝি। সপ্তাহ খানেক আগে ৮ মার্চ দেশের প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। ওই দিন একসঙ্গে তিনজন রোগী শনাক্তের ঘোষণা দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে জনমনে। তখনও সর্বাত্মক লকডাউনে যায়নি সরকার।
এ রকম সময় হঠাৎ করে শরীরটা কেমন যেন লাগছিল মোহাম্মদ ইসলাম গণির। জ্বর আসে, সঙ্গে আবার সর্দি। বাড়িতে বসে চিকিৎসা নিতে নিতেই পার হয় সপ্তাহ খানেক। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে ছোটাছুটি শুরু করে পরিবার-পরিজন।
তত দিনে করোনার আতঙ্ক দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের মাঝে। অনেক চিকিৎসাকেন্দ্র ফিরিয়ে দেয় প্রবীণ ইসলাম গণিকে। বুঝিয়ে-শুনিয়ে ২০২০ সালের ১৮ মার্চ একটি বেসরকারি হাসপাতালকে ভর্তি করা হয় তাকে। কিন্তু করোনাভাইরাস পরীক্ষার সনদ না থাকায় চিকিৎসা ছিল বন্ধ।
ওই সময় দেশে করোনা পরীক্ষা করত একমাত্র রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। কিট সংকট থাকায় পরীক্ষাও হতো কম। চেষ্টা-তদবির শেষে মোহাম্মদ ইসলাম গণির স্বজনেরা করোনাভাইরাস পরীক্ষার সুযোগ পান।
আইইডিসিআরের এক কর্মী মিরপুরের ওই হাসপাতালে গিয়ে রোগীর নমুনা নিয়ে আসেন। পরদিন জানানো হয়, করোনা পজিটিভ। অর্থাৎ মোহাম্মদ ইসলাম গণি নিশ্চিতভাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত।
এরপর রোগীকে বের করে দিতে মরিয়া হয়ে ওঠে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অনেক অনুরোধ করার পর ওই শিক্ষককে আইসিইউতে রাখা হয়। তবে সময় যত যায়, শ্বাসকষ্টের তীব্রতা বাড়তে থাকে।
একপর্যায়ে ২২ মার্চ রাত সাড়ে ৩টায় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান তিনি। পরে সরকারের পক্ষ থেকে সাবেক এই অধ্যক্ষের পরিবারের সাতজনের উপস্থিতিতে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয় মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে।
এটি ছিল দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে দ্বিতীয় মৃত্যু। প্রথম যিনি মারা গেছেন, তার নাম-পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি নিউজবাংলা।
গত এক বছরে করোনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৪৬২ জন। এই এক বছরে শনাক্ত হয়েছে ৫ লাখ ৫০ হাজার ৩৩০ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছে মোট ৫ লাখ ৩ হাজার তিনজন।
এক বছর আগের সেই দুঃসহ দিনগুলো এখন অনেকটাই দূর অতীত মনে হয়। রোববার নিউজবাংলার প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করছিলেন মোহাম্মদ ইসলাম গণির ছোট ছেলে ইকবাল আব্দুল্লাহ আল মাসুদ।
তার কথায় উঠে আসে পিতা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় ১০ দিনের ভোগান্তি ও চিকিৎসার অব্যবস্থাপনা।
ইকবাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাবা অসুস্থ হওয়ার পর বহু চেষ্টা করেও আইইডিসিআর থেকে করোনা পরীক্ষার সুযোগ পাইনি। পরে উচ্চপর্যায়ের তদবিরে করোনা পরীক্ষার সুযোগ মিলেছিল। তখন আর চিকিৎসা করার সময় ছিল না। যেদিন করোনা পরীক্ষা ফল আসে, সেই রাতেই বাবার মৃত্যু হয়।’
করোনা আক্রান্ত সন্দেহ হওয়ার পর ১৭ মার্চ থেকে আইইডিসিআরের হটলাইনে বহু চেষ্টার পর সংযোগ পায় এ পরিবার।
ইকবাল বলেন, ‘বাবার মুখে বিস্তারিত শোনার পর আইইডিসিআর থেকে বলা হয়, কোনো সমস্যা নেই। স্বাভাবিক জ্বর-সর্দি। রোগীকে বাসায় বিশ্রামে থাকতে বলা হয়।’
ওই দিন (১৭ মার্চ) দুপুর থেকে শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে ওই শিক্ষাবিদের। বাধ্য হয়ে রোগীকে ভর্তি করা হয় রাজধানীর কল্যাণপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় আইসিইউতে স্থানান্তরের প্রয়োজন হয়।
কিন্তু হাসপাতালে আইসিইউ খালি না থাকায় ওই দিন সন্ধ্যায় মিরপুর-১ এলাকার অন্য একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। সেখানে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।
প্রাক্তন এই শিক্ষকের সন্তান বলেন, ‘বাবা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, এমন সংবাদ শুনে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে নিয়ে যেতে চাপ দেন। তবে বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে আইসিইউতে রাখা হয়। এ অবস্থার মধ্যেই শ্বাসকষ্টের তীব্রতা বেড়ে শুক্রবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে তিনি মারা যান।’
রীতি অনুযায়ী মৃত ব্যক্তিকে গোসল করিয়ে কাফনের কাপড় পরিয়ে দাফন করা হয়। কিন্তু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে গেলে ভাইরাস ছড়াতে পারে, এই আশঙ্কায় সরকারিভাবে মরদেহ দাফন করা হয়। রাজধানীর মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ সময় তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য জানাজায় অংশ নেন।
ইকবালের আক্ষেপ: ‘বাবা মারা গেলেও চোখের দেখা দেখতে পারলাম না। আমিসহ পরিবারে ১৮ সদস্য ঘরবন্দি ছিলাম। প্রায় দুই মাস পর বাবার কবর দেখতে যাই। নিজের বাবাকে নিজের হাতে মাটিও দিতে পারিনি।’
ঠিক কোত্থেকে বা কার মাধ্যমে মোহাম্মদ ইসলাম গণি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তা আর জানা যায়নি। মৃত্যুর পর তার পরিবারের সদস্যদের গণমাধ্যমে কথা বলতেও নিষেধাজ্ঞা ছিল বলে জানান ইকবাল।
ঠিক এক বছর আগে ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর সংক্রমণ প্রতিরোধে ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল সরকার। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে বন্ধ করে দেয়া হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত। বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের গণপরিবহন। সাধারণ ছুটি সাত দফা বাড়ানো হয়। অবশেষে তিন মাস পর ৩০ মে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু করা হয় সরকারি-বেসরকারি অফিস।
৩১ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত সীমিত পরিসরে অফিস-আদালত খুললেও বন্ধ থাকে সব ধরনের গণপরিবহন। তবে ১৫ জুনের পর থেকে করোনা সংক্রমণের মধ্যেই স্বাভাবিক হতে শুরু করে রাজধানীর জীবনযাত্রা।
১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এই ছুটি দফায় দফায় বাড়িয়ে এ বছরের ২৯ মার্চ পর্যন্ত করা হয়েছে।
সাধারণ ছুটির মধ্যে করোনা সংক্রমণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও মে মাসের মাঝামাঝিতে সংক্রমণ ফের বাড়তে থাকে। ওই মাসের শেষের দিক থেকে রোগী শনাক্তের হার ২০ শতাংশের ওপরে চলে যায়। আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সেটি ২০ শতাংশের ওপরে ছিল। এরপর হার কমতে থাকে। তবে নভেম্বর মাসজুড়ে সংক্রমণের হার ফের ঊর্ধ্বমুখী ছিল। ডিসেম্বরে এই হারে কিছুটা লাগাম পড়েছে।
করোনা শনাক্তের বর্ষপূর্তির দিন শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।