ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের বাইরে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকার বিকল্প উৎস নিয়েও পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এ বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ আলোচনা হচ্ছে বলে জানালেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন ‘টিকা সংগ্রহে বিকল্প ভাবনাও রয়েছে। ভারতের বায়োটেক এবং চীনের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ করছে।
‘আমাদের এখানে কিছু নতুন সাপ্লাইয়ার আবেদন করেছে। এ বিষয়েও আমরা চিন্তাভাবনা করছি। সে বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা করে আমরা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’
বিশ্বজুড়ে নানা ব্র্যান্ডের টিকার প্রয়োগ চলছে। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার, মডার্না, রাশিয়ার স্পুৎনিক, চীনের সিনোভ্যাক। তবে বাংলাদেশে প্রয়োগ চলছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত ‘কোভিশিল্ড’ টিকা।
এখন পর্যন্ত করোনা প্রতিরোধী যেসব টিকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে এর মধ্যে কোভিশিল্ড টিকাই সংরক্ষণে সবচেয়ে সহজ; দামও কম। অন্যদিকে ফাইজার, মডার্নাসহ অন্যান্য টিকা সংরক্ষণ প্রক্রিয়া খুবই জটিল।
যেসব টিকার সংরক্ষণ প্রক্রিয়া জটিল সেসবে সরকারের খুব একটা আগ্রহ নেই বলে জানালেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
‘তাপমাত্রাজনিত কারণে যে টিকা সংরক্ষণ কঠিন, সেগুলো নিয়ে সরকারের আগ্রহ কম। যেগুলো মাইনাস টোয়েন্টি, মাইনাস সেভেন্টি সেগুলো আমাদের দেশে বর্তমানে রাখা এবং দেয়াটা একটু কষ্টকর। সে কারণে আমাদের ওই সমস্ত টিকায় অগ্রাধিকার দিতে হবে আস্ট্রাজেনেকার মতো। যেগুলো আমরা দুই থেকে আট ডিগ্রিতে রাখতে পারি।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ে টিকা বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সংবাদ সম্মেলন। ছবি: নিউজবাংলা
পরের চালানে বেশি টিকা পাঠাবে সিরাম
সিরাম থেকে ৩ কোটি ডোজ কোভিশিল্ড টিকা আনতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি করে রেখেছে বাংলাদেশ সরকার।
কেনা টিকা ছাড়াও গত ২০ জানুয়ারি বাংলাদেশকে ২০ লাখ ডোজ টিকা পাঠায় ভারত সরকার। এর পাঁচ দিন পর দেশে আসে কেনা টিকার ৫০ লাখ ডোজের প্রথম চালান।
মোট ৭০ লাখ ডোজ হাতে নিয়ে গত ২৭ জানুয়ারি কয়েকজনকে প্রয়োগের মাধ্যমে দেশে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয় টিকাদান। এর ১০ দিন পর শুরু হয় গণটিকা।
সোমবার বিকেল পর্যন্ত ২৩ লাখের কিছু বেশি মানুষকে টিকার প্রথম ডোজ দেয়া হয়। এদিন রাতে আসে কেনা টিকার ২০ লাখ ডোজের দ্বিতীয় চালান। সরকার থেকে জানানো হয়েছিল দ্বিতীয় চালানেও ৫০ লাখ টিকা আসবে। চুক্তিতেও উল্লেখ ছিল, প্রতি মাসে বাংলাদেশে ৫০ লাখ ডোজ টিকার চালান পাঠাবে সিরাম।
তাহলে দ্বিতীয় চালানে ৩০ ডোজ টিকা কম কেন, এতে দেশে টিকা দেয়ার পরিকল্পনায় সমস্যা হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘ঘাটতি পূরণে প্রতিষ্ঠানটি আগামী মাসে বাড়তি টিকা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
‘এই মাসে আমাদের পাওয়ার কথা ছিল ৫০ লাখ। কিন্তু পেয়েছি ২০ লাখ। অর্থাৎ এখানে একটু ঘাটতি হয়ে গেল। এ বিষয়ে আমরা সিরামের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছি। এখানে যারা সাপ্লাইয়ার আছে, তাদের ওপর আমরা চাপ প্রয়োগ করেছি যে এটা যেন তারা তাড়াতাড়ি মেকআপ করেন।’
ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সিরামের ওপর টিকার জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে জানিয়ে জাহিদ মালেক বলেন, ‘তারা আগামী মার্চে বাড়িয়ে দেবে বলেছে। এ মাসে যা দিয়েছে আগামী মাসে আরও বাড়িয়ে দেবে। কত বাড়িয়ে দেবে সেটা আমাদের কনফার্ম করলে আমরা আপনাদের জানিয়ে দিতে পারব।’
মন্ত্রী বলেন, ৪০ বছর বয়সীদের টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সেই হিসেবে দেশে ৪০ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। দুই ডোজ করে সবাইকে টিকা দিতে গেলে প্রয়োজন হবে ৮ কোটি ডোজ টিকার।
জাহিদ মালেক বলেন, ‘৩ কোটি ডোজের ব্যবস্থা আছে, চুক্তি করা আছে ভারতের সিরামের সঙ্গে। ২০ লাখ অতিরিক্ত পেয়েছি, ভারত সরকারের উপহার হিসেবে।’
যারা এরই মধ্যে প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন, দুই মাস পর তাদের দেয়া হবে দ্বিতীয় ডোজ টিকা। ছবি: নিউজবাংলা
দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ শুরু ৭ এপ্রিল
প্রথম ডোজ টিকা দেয়ার আট সপ্তাহ তথা প্রায় দুই মাস পর দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সে অনুযায়ী ৭ এপ্রিল থেকে দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানালেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
‘আমরা দুই মাস পরে দ্বিতীয় ডোজ দিতে যাচ্ছি। তখন আট সপ্তাহ হবে। কারণ হলো, আট সপ্তাহে ইমিউনিটি ভালো হয়। এটা হু (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) এর গাইডলাইন। সেই গাইডলাইন ফলো করে আমরা এপ্রিলের ৭ তারিখ থেকে দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার চিন্তাভাবনা এখন থেকে করছি।’
২৩ লাখেরও বেশি মানুষ টিকা নিয়েছেন জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেছে প্রায় ৩৬ লাখের ওপরে। আমাদের ভ্যাকসিন দেয়ার যে রেট আছে, সেটাও বেশ ভালো। আড়াই লাখের কাছাকাছি। কখনও বেশি হয়, কখনও কম হয়। রেজিস্ট্রেশন তার থেকেও বেশি হয়।’
মন্ত্রী জানান, যে হারে রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে, যে হারে ভ্যাকসিন গ্রহণ করছে। এ হারটি বজায় থাকবে যদি কিনা আমরা সেই হারে ভ্যাকসিন পাই। যার চেষ্টা আমাদের রয়েছে। কিন্তু সেই হারে যদি কম-বেশি হয়ে যায়, তাহলে আমাদের ভ্যাকসিন দেয়ার হারে একটু কম-বেশি করতে হবে।’
দেশে পুরুষের তুলনায় নারীর টিকা নেয়ার হার অনেকটাই কম। ছবি: নিউজবাংলা
টিকা নেয়ায় পিছিয়ে নারী
দেশে সোমবার পর্যন্ত প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন ২৩ লাখ ৮ হাজার ১৫৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১৫ লাখ ১৮ হাজার ৭১৫ জন; নারী ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৪৪২ জন।
নারীদের টিকা নেয়ার হার কম প্রশ্নে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা সেভাবে গবেষণা করিনি। কিন্তু আমরা মনে করি, নারীরা যেহেতু বের হন কম এবং তারা কর্মক্ষেত্রেও কম, সে কারণে এমনটা হতে পারে।’
‘মহিলারা একটু পিছিয়ে আছে। আমরা আহ্বান করব মহিলারা আরও বেশি করে এগিয়ে আসবেন। সমানে সমানে হবে।’
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে শিক্ষকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেয়া হবে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। বলেন, ‘বেশির ভাগ শিক্ষকের বয়স ৪০-এর বেশি। ৪০ বছরের নিচের শিক্ষকদের বিশেষ ব্যবস্থায় টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
‘১৮ বছরের নিচে হলে টিকা দেয়া হবে না। অন্যদের ক্ষেত্রে সরকারের নির্দেশনা অনুসরণ করে টিকা দেয়া হবে।’