গত টানা ১৬ দিন করোনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার পাঁচ শতাংশের নিচে নামল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার টানা দুই সপ্তাহ পাঁচ শতাংশের নিচে হলে করোনা নিয়ন্ত্রণে বলা যায়।
অবশ্য নীতিমালায় এও বলা আছে যে, দিনে পরীক্ষা হতে হবে ২০ হাজারের বেশি। কিন্তু গত দুই সপ্তাহে এক বারও ২০ হাজার পরীক্ষা করা হয়নি। একদিন ছাড়া প্রতিদিনই পরীক্ষা হয়েছে ১৫ হাজারের নিচে।
এই ১৬ দিনে সর্বনিম্ন ১১ হাজার ১১৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৯৭ জন নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
এই কম নমুনা পরীক্ষার পেছনে অবশ্য সরকারের কোনো দায় নেই। শুরুর দিকে কিটসহ অবকাঠামোগত সমস্যায় পরীক্ষা করতে বাধা পেলেও এখন আর সে পরিস্থিতি নেই। দেশের ২০৬টি ল্যাবে এখন পরীক্ষা করা যায়, সেই সঙ্গে শুরুর হয়েছে অ্যান্টিজেন টেস্টও। জনগণই পরীক্ষা করতে কম যাচ্ছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার কমে হয়েছে ২.৯১ শতাংশ। এটি গত বছরের ৪ এপ্রিলের পর সর্বনিম্ন। সেদিন শনাক্তের হার ছিল ২.০৭ শতাংশ।
গত ২৪ ঘণ্টায় ২০৬টি ল্যাবে এক হাজার ৯৮৫টি নমুনা পরীক্ষা করে ৪৩৮ জনের দেহে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এখন পর্যন্ত দেশে যত যত পরীক্ষা করা হয়েছে, তার মধ্যে শনাক্তের হার পাওয়া গেছে ১৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ। গত বছরের মার্চ থেকে মোট করোনা পরীক্ষা হয়েছে ৩৬ লাখ ৯৩ হাজার ৬৩৪ জনের। এর মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে পাঁচ লাখ ৩৬ হাজার ৫৪৫ জনের।
গত ২৭ জানুয়ারি রুনু ভেরোনিকা ডিকষ্টাকে প্রয়োগের মধ্য দিয়ে করোনার টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়
এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে গেছেন চার লাখ ৮১ হাজার ৩০৬ জন। মারা গেছেন আট হাজার ১৬১ জন। এখনও অসুস্থ আছেন ৪৭ হাজার ৭৮ জন।
এবারের শীতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কায় ছিল সরকার। ইউরোপে শীতে দ্বিতীয় ঢেউ প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে বেশি প্রাণঘাতি হওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর জোর দেয় সরকার।
বিশেষ করে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। মাস্ক ছাড়া সেবা মিলবে না- এমন নীতি ঘোষণা করার পরও কাজ না হওয়ায় নামানো হয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। অসংখ্য মানুষকে করা হয় জরিমানা।
নামানো হয় অক্টোবর-নভেম্বরে। তবে শীত বাড়ার পর সংক্রমণ না বেড়ে উল্টো কমতে থাকে।
টানা দুই সপ্তাহ ধরেই সংক্রমণের হার ক্রমন্বয়ে নিম্নমুখী অবস্থানে। কমছে মৃত্যুও। তিন মাস আগে যেখানে দিনে ৩০ জনের বেশি মারা যেত, সেই সংখ্যাটি কমে এখন ১০ এর কিছু ওপরে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সংক্রমণের নিম্নমুখী হার আমাদের আশা যোগাচ্ছে। দেশে পাঁচ শতাংশের নিচে সংক্রমণ হলে এবং এটা যদি টানা দুই সপ্তাহ চলে তাহলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বলতে পারি। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলারও আহ্বান জানাচ্ছি।’
করোনা মোকাবিলায় গঠিত সরকারের কারিগরি কমিটির সদস্য বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম অবশ্য আরও অপেক্ষা করতে চান। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা আরও দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করব। যদি এর মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার না বাড়ে, তাহলে আমরা ধরে নেব সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে।’
ফেব্রুয়রি ও মার্চে তামপাত্রা ক্রমে বাড়ে। এই পরিস্থিতিতে করোনা সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা করছেন কি না- এমন প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বলেন, ‘গরম আসলে করোনা বাড়ার আশঙ্কা আমরা করছি না। তার পরেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।’
৭ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রয়োগের জন্য জেলায় জেলায় পাঠানো হয়েছে করোনার টিকা
এর মধ্যে বাংলাদেশ করোনার টিকা প্রয়োগও শুরু করেছে। গত ২৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন। তবে গণটিকা শুরু হচ্ছে ৭ ফেব্রুয়ারি। এরই মধ্যে বাংলাদেশ হাতে পেয়েছে ৭০ লাখ টিকা। প্রতি মাস ভারত থেকে আসবে ৫০ লাখ করে। আবার বিশ্বজুড়ে টিকা বিতরণে গড়ে উঠা জোট কোভ্যাক্স থেকে পাওয়া যাবে আরও পৌনে সাত কোটি টিকা।
এই অবস্থার মধ্যে করোনার সংক্রমণ কমে আসায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি ফিরছে। সরকার স্কুল-কলেজ খুলে দেয়ার চিন্তাও করছে।
সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছে ৫৭৮ জন। এ নিয়ে সুস্থ হলেন চার লাখ ৮১ হাজার ৩০৬ জন। সংক্রমণ বিবেচনায় মৃত্যুর হার এক দশমিক ৫২ শতাংশ।
গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত ১৩ জনের মধ্যে ১১ পুরুষ ও দুই জন নারী।
গত ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসে প্রথম শনাক্তের খবর জানানো হয়। এর ১০ দিনের মাথায় ১৮ মার্চ করোনায় দেশে প্রথম মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে সরকার।
জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে করোনাভাইরাস শনাক্তের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৩১তম। আর মৃতের দিক থেকে ৩৮তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
করোনা মোকাবিলায় বিশ্বের প্রায় সব দেশ লকডাউন দিলেও বাংলাদেশ কখনও সে পথে হাঁটেনি। তবে ঘরের বাইরে মানুষের চলাচল সীমিত করতে গত বছরের ২৬ মার্চ ঘোষণা করা হয় সাধারণ ছুটি। চলে ৩০ জুন পর্যন্ত।
এরপর একে একে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়। তবে এখনও বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের পদক্ষেপের প্রশংসা এসেছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বিবেচনায় ‘করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশ সফল’। এটি চিঠি দিয়েও জানিয়েছে তারা।
প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদ মাধ্যম ব্লুমবার্গও প্রশংসা করেছে বাংলাদেশের। ডিসেম্বরের শেষের দিকে ‘কোভিড রেজিলিয়েন্স র্যাংকিং’-বাংলাদেশকে বিশ্বে ২০তম ও দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ অবস্থানে রাখা হয়।
গত ২১ জানুয়ারি ভারত থেকে উপহারের ২০ লাখ টিকা আসে। চারদিন পর আসে বাংলাদেশের কেনা ৫০ লাখ
করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক আঘাত মোকাবিলায় সক্ষমতাসহ বিভিন্ন সূচকের ওপর ভিত্তি করে এই র্যাংকিং প্রকাশ করছে ব্লুমবার্গ। নভেম্বরে ২৪তম স্থানে ছিল বাংলাদেশ। এক মাসে চারধাপ উপরে উঠে এসেছে দেশটি।
বিশ্বজুড়ে করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে গত বছরের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বিজনেস ম্যাগাজিন ফোর্বসও বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীসহ বিশ্বের আট নারীর অবদান বিশ্বজুড়ে ‘স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য’।
ম্যাগাজিনের নিবন্ধে বলা হয়, শেখ হাসিনার নেতৃত্ব দেওয়া ১৬ কোটিরও বেশি মানুষের দেশ-বাংলাদেশ বিভিন্ন সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে এক পরিচিত নাম।
শেখ হাসিনা তার দেশে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে ক্ষমতা দেখিয়েছেন তা ‘প্রশংসনীয়’ বলে এক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামও।
গত দুই সপ্তাহে করোনা সংক্রমণের হার কত?
গত ১৭ থেকে ১৮ জানুয়ারি ২৪ ঘণ্টায় যত নমুনা পরীক্ষা করা হয়, তার মধ্যে সংক্রমণের হার পাওয়া যায় ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
এরপর প্রতিদিনই এই হার ছিল পাঁচ শতাংশের কম। ১৯ জানুয়ারি পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ছিল ৪.৬৫।
গত ২০ জানুয়ারি এই হার ছিল ৪.২৬ শতাংশ, পরের দিন যা সামান্য বেড়ে হয় ৪.৭ শতাংশ।
গত ২২ শনাক্তের হার দাঁড়ায় ৪.১৭ শতাংশ, যা গত ২৩ জানুয়ারি আরও কমে হয় ৩.৯২ শতাংশ।
২৪ জানুয়ারি আরও কমে ৩.৩৪ শতাংশ শনাক্ত হলেও পরের তিন তা আবার বেড়ে হয় ৪.০৬ শতাংশ।
২৬ জানুয়ারি আবার শনাক্তের হার কমে হয় ৩.৩৬ শতাংশ। পরের দিন তা প্রায় সমান থাকে। সেদিন শনাক্তের হার পাওয়া যায় ৩.৪৩ শতাংশ।
২৮ জানুয়ারি শনাক্তের হার কিছুটা বেড়ে হয় ৩.৭৬ শতাংশ, পরের দিনও তা থাকে একই রকম, ৩.৭৬ শতাংশ।
৩০ জানুয়ারি পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার আরও কমে হয় তিন শতাংশ, পরের দিন যা দাঁড়ায় ৩.০২ শতাংশ।
১ ফেব্রুয়ারি পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার কিছুটা বেড়ে হয় ৩.৫৫ শতাংশ, যা ২ ফেব্রুয়ারি দাঁড়ায় ৩.৬৩ শতাংশ।