বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

টিকা কারা নিতে চান, কারা চান না

  •    
  • ২৩ জানুয়ারি, ২০২১ ০৮:১৬

নিউজবাংলার প্রতিবেদকেরা শুক্রবার ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ১০৮ জনের সঙ্গে কথা বলেছেন। এদের কমপক্ষে ৩০ শতাংশ বলেছেন, তারা টিকা নিতে আগ্রহী না।

নানা জল্পনার অবসান শেষে দেশে এসেছে কাঙ্ক্ষিত করোনার টিকা। তবে টিকা নিতে আগ্রহ নেই বা নিতেই চান না, দেশে এমন লোকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।

নিউজবাংলার প্রতিবেদকেরা শুক্রবার দৈবচয়ন ভিত্তিতে ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ১০৮ জনের সঙ্গে কথা বলেছেন। এদের মধ্যে সাংবাদিক, চিকিৎসক, সরকারি চাকরিজীবী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য যেমন আছেন, তেমনি আছেন রিকশাচালক, চায়ের দোকানদার বা পরিবহন শ্রমিক।

মতামত দেয়া ১০৮ জনের মধ্যে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ (৩৪ জন) নানা কারণ দেখিয়ে টিকা নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কেউ বলেছেন, তারা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ভয় পাচ্ছেন। অনেকে নানারকম গুজবের কথা বলেছেন। অনেকে মনে করেন, টিকা নেয়ার দরকারই হবে না।

টিকা নিতে যাদের আগ্রহ নেই, তাদের বড় অংশটিই শহুরে শিক্ষিত পেশাজীবী, যারা সংবাদমাধ্যম থেকে নিয়মিত সংবাদ পড়েন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন। দিনমজুরদের মধ্যে টিকা নেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ বেশি।

আবার যারা টিকা নিতে চান, তাদের একটি বড় অংশই জানেন না, টিকা নিতে কীভাবে নিবন্ধন করতে হবে।

‘সুরক্ষা’ নামের একটি মোবাইল অ্যাপ ও ওয়েবসাইটে গিয়ে টিকা নিবন্ধন শুরু হচ্ছে ২৬ জানুয়ারি। এ প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা নেই অধিকাংশের।

ভারত থেকে এসেছে বহুল কাঙ্ক্ষিত করোনাভাইরাস প্রতিরোধী অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা। ছবি: নিউজবাংলা

টিকা নিয়ে অনাগ্রহীদের সুর

টিকার প্রতি অনাগ্রহের কারণ হিসেবে উঠে এসেছে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, নিবন্ধন জটিলতা ও নানারকম ভীতি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার একজন র‌্যাব কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে টিকা নিতে চান না। তবে সংস্থা থেকে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে টিকা নিতে বলা হলে তিনি নিবেন। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের টিকা নিতে দিবেন না। নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে তিনি ব্যক্তিগতভাবে টিকা নিতে চান না।

রাজধানীর কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা ও একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদক জিয়াউদ্দিন রাজু নিউজবাংলাকে বলেন, তিনি টিকা নিতে চান না।

কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই টিকা আমার শরীরের সঙ্গে কতটুকু মিল হচ্ছে, তার ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। টিকা নিবন্ধন প্রক্রিয়া কী- এই বিষয়েও আমার জানা নেই।’

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবু সুফিয়ান রাসেলও টিকা থেকে দূরে থাকতে চান। তিনি জানালেন, করোনার পরীক্ষা ও ফল নিয়ে বহু অসঙ্গতি চোখে পড়েছে তার। তাই টিকা নিয়েও সন্দিহান তিনি।আরও পড়ুন: যুক্তরাষ্ট্রে পড়ে আছে টিকার লাখ লাখ ডোজ

তবে তার সামনে এক বা একাধিক ব্যক্তি টিকা গ্রহণ করে সুস্থ থাকলে করোনার টিকা গ্রহণ নিতে পিছপা হবেন না সুফিয়ান।

নিউজবাংলা অনেকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছে, তাদের মধ্যে টিকা নিয়ে গুজবপ্রসূত বিচিত্র ধারণা বিরাজ করছে। অনেকের ধারণা, টিকা নিলে শরীরের আকার পরিবর্তন হয়ে যাবে। আবার অনেকের শঙ্কা টিকা নিলেও করোনা যাবে না।

নওগাঁ শহরের রিকশাচালক তজিমুল সরদার বলেন, ‘ক্যারে বা, টিকা দেশোত আচ্ছে অ্যাডা তো হামি জানিই না। তোমার মুকোত থ্যাকা কেবল শুননু। সারাদিন রিসকা চালাই, এল্লা কতা জানার টাইম কুনটি বা। তয় হামি এখনও ভালো আছি, অ্যাল্লা করোনা না কি কয়, হামার হয়নি। আর টিকাও হামি নিমু না।’

ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ব্যবসায়ী আব্দুল কায়েমের মনেও আছে টিকা ভীতি। তিন বলেন, ‘শুনেছি টিকা নিয়ে চেহারা ব্যাঁকা হয়ে যায়। মানুষ মরে যায়, এটাও শুনেছি।’

বগুড়ার গৃহবধূ বৃষ্টি বলেন, ‘অনেক সংবাদ দেখেছি টিকা নিয়ে। টিকা নিলে নানা অসুবিধা দেখা দিচ্ছে। যে কারণে আমি টিকা নিব না। টিকা ছাড়াই আল্লাহ আমাকে সুস্থ রেখেছেন। আর টিকা নিতে হলেও কী করতে হবে, তা আমার জানা নেই। যেহেতু নিব না, তাই জানতেও চাই না।’

রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় থাকেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মী মো. নাজমুল। টিকা নিয়ে তার মনেও আছে দ্বিধা-সংশয়।

তিনি বলেন, ‘এই টিকার ওপর আমার বিশ্বাস নেই। আর সব লেভেলের মানুষ এটা পাবেও না।’

নিজের নাম আড়াল রেখে সরকারি একটি সেবা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন বললেন, তিনি টিকা নেবেন না। তার মনে টিকার কার্যকারিতা আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে সন্দেহ জেগেছে।

হাতিরঝিলের বাসিন্দা গৃহিনী বর্ণা আফসানা বেছে নিলেন সুবিধাজনক অবস্থান। আপাতত টিকা নিতে তার আগ্রহ নেই। তবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে টিকা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) হবিগঞ্জ সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, ‘টিকা নেয়া নিয়ে আমার দোটানা রয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ দেখছি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই টিকা নিয়ে শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। আর নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।’

বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে অনেকেই করোনা প্রতিরোধী টিকা গ্রহণে আগ্রহী। ছবি: নিউজবাংলা

টিকা নিতে আগ্রহী বেশির ভাগ মানুষ

যাদের সঙ্গে নিউজবাংলা কথা বলেছেন, তাদের ৭০ শতাংশ টিকা নিতে আগ্রহী।

ঢাকায় রিকশা চালান মাদারীপুরের কাশেম মিয়া। তিনি টিকা নিতে চান, তবে টাকা দিয়ে নয়। তিনি জানান, সরকার থেকে ফ্রিতে টিকা দিলে তিনি নেবেন। কিন্তু তার সঙ্গে ভোটার আইডি ও স্মার্টফোন নেই। আর এই কারণে তিনি টিকা পাবেন কিনা সেই সন্দেহে আছেন।

ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়িচালক কামাল হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একা না, পরিবারের সবার জন্য টিকা চাই।’

উল্টো কীভাবে পরিবারের জন্য ফ্রি টিকা নিতে হয় সেই বিষয়ে জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি।

ঢাকার নবাবগঞ্জের চিকিৎসক কৃষ্ণেন্দু বোস টিকা নিতে চান। তিনি বলেন, ‘টিকা আমি অবশ্যই নিব। আর সব টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকবেই। কিন্তু টিকা নেয়ার ফলে উপকার বেশি হচ্ছে কি না, সেই বিষয় মাথায় রাখতে হবে।’

সুর মেলালেন তার স্ত্রী মৌসুমী বোস। তার মতে, ‘যেহেতু ডাক্তারেরা নিজেরাই টিকা নেবেন, তাই আমার আর দ্বিতীয় কোনো ভাবনা নেই।’

ফরিদপুরের একটি সরকারি কলেজের একজন শিক্ষক নিজেকে নিরাপদ রাখতে টিকা নিতে আগ্রহী। কিন্তু তার শঙ্কা অন্য জায়গায়। তার ধারণা, ‘দেশের রাঘববোয়ালদের ভীড়ে’ তাদের কাছে টিকা পৌঁছাবে না।

টিকা নিয়ে আগ্রহ দেখালেও অনেকের মনে ভয় আছে। আবার টিকা যে দেশে এসেছে, সেই খবরও নেই অনেকের কাছে।

নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড়ের চা বিক্রতা বিটল হোসেন টিকা নিতে উৎস্যুক হয়ে আছেন। তার প্রশ্ন একটাই: তিনি পাবেন তো?

তিনি বলেন, ‘হ্যামাকে দেশোত নাকি টিকা আসিছে টিভিত দেকনু। তয় হামরা নাকি আগে টিকা পামু না। আগে না পাই, তয় কিছুদিন পরে হলেও তো টিকা পামু। কিন্তু টিকা কীভাবে হামাক দেওয়া হবে, সেডা তো হামি জানিই না। আবার টিভিত গতকাল রাতোত দেকনু যে কুনবা কুনবা দেশোত নাকি এই টিকা লিয়্যা মানুষ মরা গেছে। অ্যাল্লা দেকা তো হ্যামাক অ্যানা ভয়ও লাগিচ্ছে। সবাই যদি টিকা লেয়, তয় হামিও নিমু।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী তাকসিন হোসেন এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হামজা রহমান অন্তর বলেন, তারা অবশ্যই টিকা নিতে চান।

অন্তর বলেন, ‘টিকা নিবন্ধন প্রক্রিয়া আমি জানি। এই প্রক্রিয়া অবশ্যই সহজ এবং একজনের দ্বিতীয়বার নেয়ার সুযোগ নেই।’

তবে অনেকে জানেন না টিকা নেয়ার প্রক্রিয়া। ছবি: নিউজবাংলা

জানা নেই টিকা নেয়ার প্রক্রিয়া

টিকা নিতে চাইলেইও অধিকাংশের জানা নেই কীভাবে বা কোথায় গিয়ে করতে হবে নিবন্ধন। টিকা ব্যবস্থাপনায় ২৬ জানুয়ারি থেকে নিবন্ধন শুরু করতে যাচ্ছে সরকার। এই অ্যাপটির নাম ‘সুরক্ষা’। কিন্তু অনেকের কাছে পৌঁছেনি এই সংবাদ। ফলে তাদের জানা নেই নিবন্ধন প্রক্রিয়া।

তেজগাঁও ট্রাফিক পুলিশ বিভাগের কনস্টেবল আসাদুল ইসলাম টিকা নিতে চান। জানেন না নিবন্ধন প্রক্রিয়া। তবে সরকার যেভাবে দেবে, সেভাবেই তিনি নেবেন বলে জানান।

দিনাজপুরের হকার ফজলুর রহমান টিকা নিতে চান। সুরক্ষা অ্যাপের কথা শোনেননি তিনি। আর কীভাবে নিবন্ধন করতে হয় তাও তার জানা নেই।

ঢাকার এক গবেষক জানান, তিনি টিকা নিতে চান আর এ জন্য নিবন্ধন করা লাগবে সেটাও তিনি জানেন। কিন্তু কী প্রক্রিয়ায় হবে তা জানেন না।

ঢাকার বাইরে এ প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মাজহারুল করিম অভি, দিনাজপুর থেকে কুরবান আলী, কুমিল্লা থেকে মাহাফুজ নান্টু, হবিগঞ্জ থেকে কাজল সরকার, নওগাঁ থেকে সবুজ হোসেন।

এ বিভাগের আরো খবর