রাজধানীতে এক দশক আগে মশার জিনগত যে বৈশিষ্ট্য ছিল, এখন তাতে অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে। কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, প্রচলিত কীটনাশক সহনশীল হওয়ার পাশাপাশি পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শিখেছে ঢাকার মশা।
রাজধানীতে মশার প্রকোপের একটি বড় কারণ এই জিনগত পরিবর্তন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় শীতকালে কিউলেক্স মশার উৎপাত বেশি। এরপর বর্ষা মৌসুমে বাড়বে এডিস মশার প্রকোপ।
মশা নিয়ে গবেষণার জন্য সুপরিচিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে ১২৩ প্রজাতির মশা আছে। এর মধ্যে ঢাকায় কিউলেক্স ও এডিস মশার আধিপত্য বেশি। আর একটা প্রজাতির মশা ঢাকায় আছে, তবে সেটি তুলনামূলক কম। এটি ম্যানসোনিয়া মশা, কচুরিপানা ভর্তি ডোবা বা পুকুরে এগুলো বেশি জন্মায়।’
ম্যানসোনিয়া মশা। ছবি: কবিরুল বাশার
এ গবেষক জানান, কিউলেক্স মশা সারা বছরই দেখা যায়। তবে নভেম্বর থেকে শুরু করে মার্চ পর্যন্ত এর উৎপাত বেশি। মার্চের শেষে যখন বৃষ্টি শুরু হবে তখন এর আধিক্য কমতে শুরু করবে।
ঢাকায় কিউলেক্স মশার প্রকোপের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যখন পানির দূষণ বাড়তে থাকে তখন কিউলেক্সের আধিক্য বেড়ে যায়। কারণ দূষিত পানিতে সে খাবার পায়। এখন বাংলাদেশে যে তাপমাত্রা সেটা এই মশার প্রজননের জন্য অনেক বেশি উপযুক্ত।
‘ড্রেন বা ডোবাগুলোতে পানির ফ্লো যত কম থাকবে তত এই মশার প্রজনন বাড়তে থাকবে। বৃষ্টির সময়ে ড্রেন বা ডোবাতে ফ্লো থাকে বেশি। তাই তখন এর ডিম থেকে বাচ্চা বের হতে পারে না। তাই বৃষ্টির সময়ে এর আধিক্য অনেক কম থাকে।’
কিউলেক্স মশা। ছবি: কবিরুল বাশার
কীটনাশক ছিটানোর পরও মশা বাড়ছে কেন, এমন প্রশ্নে মশার অভিযোজন ক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি সামনে আনেন অধ্যাপক কবিরুল।
তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক প্রজাতির মশা কীটনাশক ও প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে তাদের জিনগত পরিবর্তন করে থাকে। যে কীটনাশক এখন দেয়া হচ্ছে বা বিগত দুই থেকে তিন বছর ধরে দেয়া হয় সেটার বিরুদ্ধে সে সহনশীলতা তৈরি করে ফেলে। এটাকে ইনসেক্টিসাইড রেজিস্ট্যান্স বা কীটনাশক সহনশীলতা বলা হয়। একটা সময়ে এটা এদের জিনগত সহনশীলতায় পরিবর্তন নিয়ে আসে, যা পরবর্তী প্রজন্মেও ট্রান্সফার হয়।’
এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, ‘এভাবে কিউলেক্স মশা একটা পরিবর্তিত পরিবেশে বেঁচে থাকার সামর্থ্য অর্জন করে থাকে। তবে এটা যে আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠবে তা নয়, যে কীটনাশক দিয়ে তাকে মারা হতো সেটার বিরুদ্ধে সে শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
‘ফলে এখন যে কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে আর এই মশা মরছে না।’
বিষয়টির বিশদ ব্যাখ্যায় অধ্যাপক কবিরুল বলেন, ‘এদের (মশার) জিনগত পরিবর্তন অনেকটা আমাদের মতো। আমার বা আপনার বাবা যদি সাহসী হয়ে থাকেন তবে আপনার মধ্যেও তার একটা প্রভাব পড়বে। মশা তার সহনশীলতা এভাবেই পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করে থাকে।’
তবে মশার এই পরিবর্তন মানবদেহের ওপর প্রভাবে কোনো পরিবর্তন আনেনি। কিউলেক্স মশা কামড়ানোর পর যে জ্বলুনি বা ফোলা ভাব অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় তার সঙ্গে মশার জিনগত পরিবর্তনের কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানান কবিরুল বাশার।
তিনি বলেন, ‘এটা প্রতিক্রিয়ার ধরন মানবদেহের ওপর নির্ভর করে। অনেকের শরীরে অ্যালার্জির মাত্রা বেশি হওয়ায় লাল দাগ বা ফোলা তৈরি হয়।’
ঢাকায় এডিস মশা দমনেও খুব বেশি আশার কথা নেই এই কীটতাত্ত্বিকের কথায়। তিনি বলেন, এডিস মশার পিক সিজন (ভরা মৌসুম) এপ্রিলে শুরু হয়ে নভেম্বরে শেষ হয়। তবে শীতে এই মশা কম থাকে। বাংলাদেশে শীতকালে যে তাপমাত্রা থাকে সেখানে এডিস প্রজনন করতে পারবে যদি সে পানি পায়। যে পানিতে এডিস মশার জন্ম সেটা যদি শীতকালেও থেকে থাকে তবে এডিস মশাও থাকবে। তবে শীতকালে এডিস মশার গ্রোথ (শারীরিক বৃদ্ধি) ও ডেভেলপমেন্ট (বিকাশ) অনেক ধীর হয়।
‘শীতকালে এটির (এডিস) প্রজননের পর্যাপ্ত পরিমাণ বিড্রিং পয়েন্ট (প্রজনন জায়গা) থাকে না। তবে ইনসাইডে (বাসার ভেতরে) যে কন্টেইনার থাকে যেমন কন্ট্রাকশন বিল্ডিং বা বাসা বাড়ির ছাদ, সেখানে শীতের সময়েও এডিস মশা পাওয়া যাবে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকায় এখন সারা বছর ডেঙ্গু মশা পাওয়া যাচ্ছে। আর এর কারণ হচ্ছে নগরায়ন। যত বেশি নগরায়ন হবে তত বেশি ডেঙ্গু মশার আধিক্য থাকবে। আর কিউলেক্স মশার জন্য শীতের এই সময়টা উপযুক্ত। কারণ এখন বাতাস ও বৃষ্টির আধিক্য নেই।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা দাবি করেন, সিটি করপোরেশন থেকে যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়েও মশা দমনে সফল হচ্ছে না।
ঢাকায় মশার প্রকোপ স্বীকার করছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা বুঝেছি যে ইদানীং মশা দেখা যাচ্ছে। আমার নিজের বাসায়ও দুই-একটা মশা দেখি, যেটা আগে দেখিনি।’
মশা মারা এবং ডেঙ্গু থেকে নগরবাসীকে রক্ষায় পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করার দাবি করে মন্ত্রী বলেন, এ বিষয়ে আগামী সপ্তাহেই আন্তমন্ত্রণালয় সভা করা হবে।