বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অনুমোদন ছাড়াই করোনার ন্যাজাল স্প্রে প্রয়োগ

  •    
  • ১৬ জানুয়ারি, ২০২১ ১৬:১০

নীতিমালার কোনোটিই অনুসরণ করেননি ‘বঙ্গসেফ ওরো-ন্যাজাল স্প্রে’র গবেষকেরা। এমনকি নৈতিক অনুমোদন না নিয়েই তারা ওষুধের প্রয়োগ এবং সিআরওর মূল্যায়ন প্রতিবেদন ছাড়াই সংবাদমাধ্যমের সামনে সাফল্য দাবি করেছেন। 

করোনাভাইরাস রোধে সক্ষম এক ধরনের ন্যাজাল স্প্রে উদ্ভাবনের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টস (বিআরআইসিএম)। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে যৌথ গবেষণায় স্প্রেটি উদ্ভাবনের দাবি করছেন বিআরআইসিএমের কর্মকর্তারা।

এই ন্যাজাল স্প্রের কার্যকারিতা দেখতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত ২০০ রোগীর ওপর প্রয়োগের তথ্য সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন গবেষকেরা। তবে নিউজবাংলার অনুসন্ধানে দেখা যায়, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য নির্ধারিত নিয়মের কিছুই অনুসরণ করা হয়নি। এমনকি যাদের ওপর এই স্প্রের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হয়েছে, নির্ধারিত নিয়ম মেনে তাদের সম্মতি গ্রহণ করা হয়নি।

আরও পড়ুন: করোনারোধী ‘ন্যাজাল স্প্রে’ উদ্ভাবন দাবি বিআরআইসিএমের

ঢাকা মেডিক্যালের যে চিকিৎসক এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, এই ন্যাজাল স্প্রে নতুন কোনো উদ্ভাবন নয়। স্প্রেটির উপাদান অন্য রোগে ব্যবহার করা হতো, তবে এবার সেগুলো করোনা রোধে ব্যবহার করা হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো ওষুধ মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট প্রটোকল রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সেটি অনুসরণ না করে গুরুতর অনিয়ম করেছেন গবেষকেরা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে জানান, যেকোনো ওষুধ বাজারে আসার আগে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি ধাপ অনুসরণের বিধান রয়েছে। একটি সম্ভাব্য ওষুধ মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের আগে গবেষকদের কার্যকারিতা পরীক্ষার প্রটোকল বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল বিএমআরসিতে জমা দিতে হয়।

অধ্যাপক নজরুল বলেন, ‘বিএমআরসি এই প্রটোকল যাচাই-বাছাইয়ের পর মানবদেহে পরীক্ষার নৈতিক অনুমোদন (এথিক্যাল পারমিশন) দিয়ে থাকে। এই অনুমোদন পাওয়ার পরই কেবল মানুষের ওপর ওষুধের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা যায়। তবে যাদের ওপর প্রয়োগ করা হচ্ছে, তাদের পূর্ব সম্মতি নেয়ার বিধান আছে। আবার লটারির মাধ্যমেও ওষুধগ্রহীতা নির্বাচনের একটি বিশ্বস্বীকৃত পদ্ধতি আছে।’

মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পদ্ধতি ও ফল পর্যালোচনার জন্য নিয়োগ দিতে হয় সরকার নির্ধারিত আলাদা কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা সিআরওকে। সেই সিআরওর মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই ওষুধ বাজারজাত করার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এ সংক্রান্ত একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের।

তবে ওই নীতিমালার কোনোটিই অনুসরণ করেননি ‘বঙ্গসেফ ওরো-ন্যাজাল স্প্রে’র গবেষকরা। নৈতিক অনুমোদন না নিয়েই তারা ওষুধের প্রয়োগ করেছেন। সিআরওর মূল্যায়ন প্রতিবেদন ছাড়াই সাফল্য দাবি করেছেন সংবাদমাধ্যমের সামনে।

বিএমআরসি বা ঔষধ প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়াই মানবদেহে স্প্রে কীভাবে প্রয়োগ করা হলো এর পরিষ্কার কোনো ব্যাখ্যা নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে।

বিষয়টি জানতে নিউজবাংলা কথা বলেছে এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেয়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নাক নাক গলা বিশেষজ্ঞ মোস্তফা কামাল আরেফিনের সঙ্গে। তিনি দাবি করেন, ‘জরুরি পরিস্থিতি’ বিবেচনায় রোগীর ওপর এই স্প্রের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হয়েছে।

গবেষক দলের তথ্য অনুযায়ী, কেবল সাধারণ পরিস্থিতিতে এই স্প্রে প্রয়োগ করে নাক ও গলার করোনাভাইরাস মেরে ফেলা সম্ভব। তবে আক্রান্তের অবস্থা গুরুতর হলে এই স্প্রের মাধ্যমে উপশম করা যায় না। সে ক্ষেত্রে রোগীর কোন ‘জরুরি পরিস্থিতিতে’ এই স্প্রে প্রয়োগ করা হলো, তার ব্যাখ্যা দেননি ডা. আরেফিন।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জরুরি আইন বলতে ঢাকা মেডিক্যাল চাইলে যেকোনো গবেষণা করতে পারবে। এ জন্য তাকে বিএমআরসির অনুমোদন নেয়ার প্রয়োজন নেই। তবে ব্যাপক হারে গবেষণা করতে গেলে অবশ্যই বিএমআরসির অনুমোদন নিতে হবে।

‘আমরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এথিক্যাল রিভিউ কমিটির অনুমোদন নিয়ে এ স্প্রে মানুষের শরীরে প্রয়োগ করেছি। এমন কোনো নতুন পদার্থ নিয়ে কাজ করা হয়নি, যার জন্য ওষুধ প্রশাসন ও বিএমআরসির অনুমোদন নেয়ার প্রয়োজন হবে।’

স্প্রের উপাদান নতুন উদ্ভাবন নয় স্বীকার করে মোস্তফা কামাল আরেফিন বলেন, ‘গলাব্যথা, টনসিল ইনফেকশন, গলায় ইনফেকশন—এ ধরনের ঠান্ডাজনিত সমস্যার ক্ষেত্রে এই ওষুধ আগে থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে।’

বিশ্বের অনেক দেশেই করোনাভাইরাস প্রতিরোধী ন্যাজাল স্প্রে নিয়ে গবেষণা চলছে। কয়েকটি দেশে এ ধরনের স্প্রের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালও চলছে। এর পরেও বাংলাদেশের গবেষক দলটি তাদের স্প্রেকে বিশ্বে প্রথম উদ্ভাবন কেন দাবি করছে- সেই প্রশ্নে ডা. আরেফিন বলেন, ‘আরও অনেক দেশে এ ধরনের ন্যাজাল স্প্রে থাকতে পারে, তবে সেগুলোর কোনোটিই আমাদেরটির মতো নয়।’

এই গবেষণার সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিআরআইসিএমের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মালা খানের দাবি, করোনা রোগীর ওপর এই স্প্রে প্রয়োগের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল থেকে ‘নৈতিক ছাড়পত্র’ নেয়া হয়েছে।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগামী রোববার ব্যাপক হারে গবেষণার জন্য বিএমআরসির অনুমোদন চাওয়া হবে।’

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্প্রের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের সময় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসির উদ্দিন।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি এখনই আমরা গণমাধ্যমে জানাতে চাইনি। আমরা বিএমআরসির অনুমোদন নেয়ার জন্য কাগজপত্র কিছু দিনের মধ্যে জমা দেব।’

বিএমআরসির অনুমোদনের আগেই স্প্রের প্রয়োগ আইনের লঙ্ঘন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যেকোনো গবেষণা যেকোনো প্রতিষ্ঠান করতে পারে। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যালে একটা টেকনিক্যাল কমিটি রয়েছে। এই কমিটির কাছ থেকে আমার কাছে একটা প্রস্তাব আসার পর সেটার আমি অনুমোদন দিয়েছি।’

তবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের এ ধরনের কোনো অনুমতি দেয়ার এখতিয়ার নেই বলে জানিয়েছেন বিএমআরসির চেয়ারম্যান সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী।

তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেকোনো মেডিক্যাল গবেষণা করতে হলে বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল থেকে অনুমোদন নিতে হয়। এটাকে নৈতিক ছাড়পত্র বলে। নৈতিক অনুমোদন দেয়ার অর্থ এই নয় যে, মানবদেহে পরীক্ষামূলক চূড়ান্ত ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে।

‘পরীক্ষামূলক প্রয়োগ, ওষুধ উৎপাদন ও ব্যবহারের জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন দরকার হয়। আবার হাসপাতালে ব্যবহারের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমতিরও প্রয়োজন।’

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা আমারও প্রশ্ন, অনুমোদন ছাড়া কীভাবে এই স্প্রে মানবদেহে প্রয়োগ করা হলো। নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে গবেষণাগারে, এরপর প্রাণীর ওপর প্রয়োগ করে যদি কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না থাকে, তাহলে ঔষধ প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে মানবদেহে প্রয়োগ করা যাবে। এখানে এই নিয়মের কোনোটাই অনুসরণ করা হয়নি। এটা বেআইনি।’

‘জরুরি পরিস্থিতিতে’ গবেষণার ক্ষেত্রে অনুমতি ছাড়া মানবদেহে ওষুধ প্রয়োগের নিয়ম আছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জরুরি অবস্থায় হয় কি- কাজটা দ্রুত করার সুযোগ দেয়া হয়। যে গবেষণাটি করতে পাঁচ মাস সময় লাগবে সেটা হয়ত দুই মাসে করা যায়। এ ছাড়া ৫০০টি প্রাণীর দেহে ওষুধ প্রয়োগ করার কথা ছিল, সেটি হয়ত ২০০টি করা যেতে পারে। এগুলো হয়ত শিথিল করা হয়। কিন্তু মানুষের নিরাপত্তার বিষয়ে কোনো ছাড় দেয়া চলবে না।’

যাদের ওপর এই স্প্রে প্রয়োগ করা হয়েছে, তাদের কেউ অসুস্থ হলে মামলা বা অভিযোগ করার সুযোগ আছে বলেও জানান মো. সালাহউদ্দিন।

এর আগে গত বছরের মার্চে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ছাড়াই করোনা পরীক্ষার র‌্যাপিড কিটকে সফল বলে দাবি করেছিলেন গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এ বিষয়ে দেশজুড়ে অনেক আলোচনা সমালোচনার পর এপ্রিলের শেষে সিআরও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কিটের মূল্যায়ন চালাতে রাজি হন ডা. জাফরুল্লাহ। তবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়নি বলে পরে সংবাদ সম্মেলন করে জানায় সিআরও প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এ বিভাগের আরো খবর