নমুনা পরীক্ষা কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে কমছে করোনা রোগী শনাক্তের সংখ্যা। গত ছয় দিন রোগী শনাক্তের সংখ্যা ছিল হাজারের নিচে। গত শনিবার রোগী শনাক্ত হয়েছে ৬৮৪ জন, যা গত আট মাসে সবচেয়ে কম। গত বছরের শেষ দিন বৃহস্পতিবার রোগী শনাক্তের হার ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ, যা গত তিন মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত এক মাসে রোগী শনাক্তের হার ৮ শতাংশ কমে এসেছে।
প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশে কি তবে অন্য দেশেগুলোর মতো করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসছে না?
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা তবু উড়িয়ে দিচ্ছেন না স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তবে দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানার আশঙ্কা কিছুটা কম বলে দাবি তাদের। যদিও এরই মধ্যে করোনা দ্বিতীয় ঢেউ যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক দেশে লকডাউন জারি করা হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও দেখা দিয়েছে দ্বিতীয় ঢেউ। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে ও দেশের বিমানবন্দরগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
দেশে এখন রোগী শনাক্তের যে হার, তাতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আছে, এটা বলা যাবে না। টানা তিন সপ্তাহ যদি পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকে, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে ধরা যায়। সে ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে প্রতিদিন ন্যূনতম ২০ হাজার মানুষের নমুনা পরীক্ষা করতে হবে এবং দেশের সব জেলা থেকে নমুনা সংগ্রহের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। দেশে এখন নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে ১০ হাজারের মতো।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশে করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউই নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ এলে শনাক্তের হার পাঁচ শতাংশের নিচে আসার কথা।
‘তবে এখনও শনাক্তের হার সাত শতাংশের নিচে নামেনি। শীতকালে আমাদের দেশে অন্যান্য ভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার কারণে করোনাভাইরাসের শনাক্তের হার অনেক কমে আসছে। একই সঙ্গে দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসার সম্ভবনা অনেক কম।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশে করোনাভাইরাস এখনও রয়েছে। কোনো ভাইরাস সম্পর্কে বলতে গেলে সেই ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি আগে বুঝতে হবে। তবে কেউই করোনার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সঠিকভাবে বলতে পারছে না। এ কারণে দ্বিতীয় ঢেউ আসবে, কি আসবে না এটা এখন বলা যাবে না। করোনার গতি যে কোনো সময় পরিবর্তন হতে পারে। আমাদের দেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
‘যেহেতু আমাদের দেশে এমন কোনো গবেষণা করা সম্ভব হয়নি, সে ক্ষেত্রে ভবিষদ্বাণী দেয়া ঠিক হবে না। ফলে আমরা করোনার দ্বিতীয় ঢেউকে একেবারেই উড়িয়ে দেব না। এখন থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে ভ্যাকসিন আসার আগ পর্যন্ত করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করতে যা যা করা দরকার, সেটা করতে হবে।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার ক্ষেত্রে আমরা দেখছি সংক্রমণের ধারাটা একটু নিম্নগামী। করোনা যা পরীক্ষা হচ্ছে, তার ১০ শতাংশের নিচে শনাক্ত হচ্ছে। তবে আশঙ্কার বিষয়টা অন্য জায়গায়। যুক্তরাজ্যে নতুন যে করোনা দেখা দিয়েছে, এ ভাইরাসটি ইতোমধ্যে অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতাতেও এটার অস্তিত্ব দেখা দিয়েছে।
‘আমাদের ভয় হচ্ছে এটা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে। এখন যে করোনা শনাক্তের হার রয়েছে, এটা যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তাহলে জনভোগান্তি কমবে। এজন্য করোনা টেস্ট করতে উৎসাহিত করতে হবে। করোনা পরীক্ষা বিনামূল্যে করতে হবে। টেস্ট করতে ভোগান্তি কমাতে হবে।’
করোনা পরীক্ষার ফল দ্রুত দেয়ার ব্যবস্থা থাকা উচিত বলেও মনে করেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, ‘তাহলে আমরা বুঝতে পারব, কী পরিমাণ করোনা রোগী দেশে রয়েছে। এটা বোঝার জন্য করোনা নিয়ে একটা জরিপ করা দরকার ছিল। জনগণকে আমরা যদি স্বাস্থ্যবিধি মানাতে পারি, তাহলে আমরা করোনাকে রুখে দিতে পারব। বিশ্বের বিজ্ঞানীরা বলছেন, জানুয়ারির শেষে এবং ফেব্রুয়ারির প্রথমে এই করোনা সংক্রমণ আবার বাড়তে পারে। যদি আমারা যুক্তরাজ্যের নতুন ধরনের করোনাকে দেশ আসতে না দিতে পারি, তাহলে বলা যায় করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হব।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদি সাব্রিনা ফ্লোরা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নতুন ধরনের করোনা আমাদের দেশে এখনও আসেনি। যদিও এ বিষয়টি দেখার জন্য আইইডিসিআরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।’
দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিষয়টিকে ‘অনেকটা আপেক্ষিক’ হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে নিজের যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘অন্যান্য দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে। কারণ তারা শুরুতেই কঠোর লকডাউনে ছিল। যখন লকডাউন খুলে দেয়া হলো, তখন সংক্রমণের হার বাড়তে শুরু করছে। ওখানে ভাইরাস পরিবর্তনের কারণে এটা হতে পারে। আরও অনেক কারণ থাকতে পারে।’
মীরজাদি সেব্রিনা মনে করেন, করোনাভাইরাসের প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় ঢেউ— পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে সাধারণ মানুষের সচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর।
তিনি বলেন, ‘যদি আমার স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলি, সংক্রমণের হার অব্যাহত থাকবে। নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন, শুরুর দিকে সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তখন সংক্রমণ অনেক কম ছিল। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চললে অবশ্যই আবার সংক্রমণ বাড়বে।’