ফাইজার ও মর্ডানা দাবি করছে, তাদের করোনা টিকা ৯৫ শতাংশ কার্যকর। অন্যদিকে, অক্সফোর্ডের টিকা ৭০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর বলা হচ্ছে।
কার্যকারিতার এই হার কী অর্থ বহন করে- সে বিষয়ে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ। গত মাসে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে ফাইজার ও মডার্নার টিকার কার্যকারিতা নির্ধারণের পদ্ধতি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই দুই টিকা ৯৫ শতাংশ কার্যকর মানে এই নয় যে, বাস্তবে ১০০ জন টিকা গ্রহিতার মধ্যে ৯৫ জন করোনা থেকে সুরক্ষা পাবেন। বাস্তবে সুরক্ষা পাওয়া মানুষের হার অনেক কমও হতে পারে।
নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটি বাংলায় ভাষান্তর করেছেন মেহরিন জাহান।
করোনাভাইরাসকে হারানোর দৌড়ে এগিয়ে থাকা টিকাগুলো প্রত্যাশার চেয়েও ভালো করেছে। ফাইজার ও মডার্না এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, তাদের টিকা করোনা প্রতিরোধে ৯৫ শতাংশ কার্যকর। মডার্না তাদের কার্যক্ষমতার হার জানিয়েছে ৯৪.৫ শতাংশ। আর রাশিয়ার স্পুৎনিক টিকার উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের দাবি, তাদের টিকা ৯০ শতাংশেরও বেশি কার্যকর।
যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান মায়ো ক্লিনিকের টিকা গবেষক ডা. গ্রেগরি পোলান্ড যেমনটি বলছিলেন, ‘এরা সব হিসাব নিকাশই পাল্টে দিয়েছে। আমরা তো কেবল ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ কার্যকারিতা আশা করেছিলাম।’
এমনকি দেশটির ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনও (এফডিএ) ঘোষণা দিয়েছিল, ৫০ শতাংশ কার্যকারিতা দেখাতে পারলেই জরুরি ব্যবহারের জন্য টিকা অনুমোদনের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
খবরের শিরোনাম দেখলে মনে হতেই পারে, এই টিকা পাওয়া প্রতি ১০০ জনের ৯৫ জনই করোনা থেকে সুরক্ষা পাবেন। তবে টিকাগুলোর ট্রায়ালের ওপর ভিত্তি করে পাওয়া ফল আর বাস্তব এক নয়। বাস্তবে এসব টিকা কেমন কাজ করবে তা নির্ভর করছে এমন অনেক বিষয়ের ওপর, যেগুলো এখনো পরিষ্কার নয়- যেমন, টিকা দেয়া ব্যক্তি উপসর্গহীন করোনায় আক্রান্ত হবেন কি না অথবা কতজন টিকা পাবেন ইত্যাদি।
এখানে এসব টিকা আসলে কতটা কার্যকর- তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
টিকা ৯৫ শতাংশ কার্যকর- বলতে কোম্পানিগুলো আসলে কী বোঝায়?
টিকার ট্রায়ালের মৌলিক হিসাব-নিকাশগুলো দাঁড়িয়ে আছে এক শতকের বেশি আগে পরিসংখ্যানবিদদের বের করা হিসাবের ওপর। গবেষকেরা দুটি গ্রুপকে ট্রায়ালের আওতায় নেন- যাদের এক গ্রুপকে দেয়া হয় সত্যিকারের টিকা, আরেকটি গ্রুপকে টিকাসদৃশ প্লাসেবো। এরপর তারা স্বেচ্ছাসেবীদের অসুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় থাকেন এবং কোন গ্রুপ থেকে কতজন আক্রান্ত হলেন- সেটি পর্যবেক্ষণ করেন।
যেমন, ফাইজার তাদের টিকার ট্রায়ালের জন্য ৪৩ হাজার ৬৬১ জন স্বেচ্ছাসেবীকে বেছে নিয়েছিল। তাদের মধ্যে উপসর্গ নিয়ে আসা ১৭০ জনের মধ্যে পরে করোনা শনাক্ত হয়। এই ১৭০ জনের মধ্যে ১৬২ জনই ছিলেন প্লাসেবো গ্রুপের, অর্থাৎ তারা আসল টিকা পাননি। মাত্র আট জন আসল টিকা পাওয়ার পরেও আক্রান্ত বলে শনাক্ত হন।
এই সংখ্যার ভিত্তিতে ফাইজারের গবেষকেরা দুই গ্রুপের স্বেচ্ছাসেবীদের অসুস্থ হওয়ার হার নির্ধারণ করেছেন। দুটি সংখ্যাই বেশ কম, তবে এর মধ্যে টিকা না পেয়ে আক্রান্ত হওয়ার হারটি টিকা পেয়ে আক্রান্তের হারের চেয়ে অনেক বেশি। এরপর গবেষকেরা দুই অংশের হারের আপেক্ষিক পার্থক্য বের করেছেন। এই পার্থক্যকে সংখ্যাগত মানে নির্ধারণ করা হয়, গবেষকেরা যাকে টিকার ‘এফিকেসি’ বা কার্যক্ষমতা বলেন। দুই গ্রুপে আক্রান্তের হার যদি একই হয়, তাহলে এফিকেসি হবে শূন্য। আবার আক্রান্ত ব্যক্তিদের কেউই যদি টিকা না পেয়ে থাকতেন, অর্থাৎ তারা সবাই যদি প্লাসেবো গ্রুপের হতেন, তাহলে টিকার এফিকেসি হতো ১০০ শতাংশ।
এভাবে ৯৫ শতাংশ কার্যক্ষম হওয়ার হিসাবটি বেশ শক্ত একটি প্রমাণ যে, টিকা ভালোভাবেই কাজ করছে। তবে এই টিকা নেয়ার পরেও অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা কতটুকু- তা কিন্তু ওই সংখ্যা দিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। এমনকি টিকা কোভিড-১৯ সংক্রমণ কমাতে কতটা ভালোভাবে কার্যকর হবে তাও বলা যায় না।
কার্যক্ষমতা (এফিকেসি) ও কার্যকারিতার (ইফেক্টিভনেস) ফারাক
কার্যক্ষমতা আর কার্যকারিতা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত, তবে দুটি বিষয় এক নয়। এমনকি টিকা বিশেষজ্ঞরাও স্বীকার করেন দুটিকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়। কার্যক্ষমতা টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে পাওয়া একটা পরিমাপক মাত্র। অন্যদিকে, জনস হপকিনস ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ নাওয়ার বার-জিভের মতে, ‘কার্যকারিতা নির্ভর করে বাস্তব প্রয়োগে টিকা কতটা কাজ করছে তার ওপর।’
এটা হতে পারে, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কার্যক্ষমতা টিকার বাস্তব কার্যকারিতার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যাবে। তবে আগে বিভিন্ন রোগের টিকার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের চেয়ে বাস্তব কার্যকারিতা বেশ কম।
ট্রায়াল আর বাস্তবের এই গড়মিলের কারণ হচ্ছে, ট্রায়ালে অংশ নেয়া স্বেচ্ছাসেবীরা বড় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন না। যেমন, বাস্তবে অনেকেরই নানা গুরুতর রোগ থাকে, যেগুলো শরীরে টিকার সুরক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) সবসময়ই অনুমোদন পাওয়া টিকার কার্যকারিতার ওপর নজরদারি বজায় রাখে। সংস্থাটি সম্প্রতি জানিয়েছে, করোনার টিকাগুলোর কার্যকারিতা নিয়েও তারা গবেষণা অব্যাহত রাখবে। এর ফলে টিকা পাওয়া ও না পাওয়া মানুষের স্বাস্থ্য পরিস্থিতির তুলনামূলক বিশ্লেষণের সুযোগ তৈরি হবে।
এই টিকাগুলো আসলে কী করতে সক্ষম?
ফাইজার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এমনভাবে সাজিয়েছিল যেখানে দেখা হয়েছে, টিকা মানুষকে করোনা আক্রান্ত হওয়া ঠেকাতে পারে কিনা। স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে জ্বর বা কাশির মতো উপসর্গ দেখা গেলেই কেবল তাদের করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
কিন্তু এমন অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে, যেসব ক্ষেত্রে দেখা গেছে কোনো উপসর্গ ছাড়াই করোনা সংক্রমণ ঘটতে পারে। ফলে এটা হতেই পারে যে, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশ নেয়া আরও অনেকে টিকা পাওয়ার পরেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, কিন্তু উপসর্গ না থাকায় তা জানা যায়নি। আর এমন ঘটে থাকলে তাদের কেউ ওই ৯৫ শতাংশ কার্যক্ষমতার হিসাব নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় বিবেচিত হননি।
উপসর্গহীন করোনা আক্রান্তরা অজান্তেই অন্যদের মধ্যে ভাইরাস ছড়ান। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, উপসর্গহীনদের দেহে কম সংখ্যক ভাইরাস তৈরি হয়। এ কারণে তাদের কাছ থেকে অন্যদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম, যেটা উপসর্গসহ আক্রান্তদের ক্ষেত্রে বেশি। কিন্তু টিকা নেয়ার পর নিজেকে সুরক্ষিত ভেবে মানুষ যদি মাস্ক ও অন্যান্য সুরক্ষা ব্যবস্থা এড়িয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায় তাহলে উপসর্গহীনদের কাছ থেকে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে।
ডা. বার জিভের আশঙ্কা, ‘এ রকম ধোয়াশাপূর্ণ অবস্থায় পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে।’
এই টিকা কি আসলেই করোনা মহামারিতে লাগাম পরাবে?
টিকা শুধু গ্রহিতাকেই সুরক্ষা দেয় তা নয়, এটি ভাইরাস বিস্তারের গতিও কমায়। এভাবে ধীরে ধীরে আক্রান্তের হার কমিয়ে আনে ও গোটা অঞ্চলকেই এক সময়ে সুরক্ষিত করে ফেলে।
বিজ্ঞানীরা বড় পরিসরে এমন কার্যকারিতাকেই টিকার সামগ্রিক প্রভাব হিসেবে গণ্য করেন। গুটি বসন্তের টিকার ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যাপক প্রভাব দেখা গিয়েছিল, যে কারণে ১৯৭০ এর দশকে ভাইরাসটি একদম হারিয়ে যায়। তবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে উচ্চ কার্যক্ষমতা দেখানো টিকাও বাস্তবে ততটা ভালো ফল দিতে নাও পারে, যদি সেটি অল্প কিছু মানুষে প্রয়োগ করা হয়।
ইয়েল স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধ্যাপক এ. ডেভিড পালটিয়েল যেমনটি বলছিলেন, ‘টিকা কখনও প্রাণ বাঁচায় না, প্রাণ বাঁচে টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে।’
অধ্যাপক পালটিয়েল ও তার দল হেলথ অ্যাফেয়ার্স জার্নালে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। সেখানে তারা কার্যক্ষমতার হিসাবে উচ্চ থেকে নিম্ন মাত্রার টিকাগুলোর একটি মডেল দেখিয়েছেন। পাশাপাশি তারা করোনার এই বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে কত দ্রুত ও বড় পরিসরে টিকাগুলো সরবরাহ হবে সে বিষয়টিও বিবেচনায় নিয়েছেন।
অধ্যাপক পালটিয়েল বলছেন, তাদের গবেষণার ফল উদ্বেগজনক। তিনি এবং তার সহকর্মীরা দেখিয়েছেন, সংক্রমণ, হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু হার কমানোর ক্ষেত্রে টিকার কার্যক্ষমতা ততটুকুই হবে, যতটুকু টিকাদান কমসূচি চলবে।
অধ্যাপক পালটিয়েল সতর্ক করে বলছেন, ‘সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের জন্য টিকার চেয়ে টিকা বিতরণ ব্যবস্থাপনাই বড় ভূমিকা রাখবে।’