পৃথিবী নামের এই সবুজ গ্রহের প্রায় সব জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়েছে প্লাস্টিকের দূষণ। সুউচ্চ পর্বতমালা থেকে গভীর সমুদ্র- এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে প্লাস্টিকের দূষণ পৌঁছেনি।
প্রতিদিন গ্রহণ করা খাবার, পানি ও বাতাসের মধ্য দিয়ে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা আমাদের শরীরেও প্রবেশ করছে। তবে এই প্রথমবারের মতো গর্ভের শিশুদের নাড়িতেও প্লাস্টিকের কণার উপস্থিতি খুঁজে পেয়েছেন একদল গবেষক।
তারা বলছেন, এমন সংবেদনশীল প্রত্যঙ্গে প্লাস্টিকের উপস্থিতি হতে পারে শিশুদের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কারণ। এই ঘটনাকে ‘চরম উদ্বেগের’ বিষয় বলেও অভিহিত করেছেন ওই গবেষকরা।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দি গার্ডিয়ান জানাচ্ছে, সম্প্রতি চার জন অন্তঃসত্ত্বার গর্ভফুলে ইতালির রোমের একদল গবেষক প্লাস্টিক কণার অস্তিত্ব খুঁজে পান। গবেষণায় অংশ নেয়া নারীরা শারীরিকভাবে সুস্থ ছিলেন। তারা সন্তান প্রসবও করেছেন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। গবেষকদের ধারণা, খাদ্যগ্রহণ বা নিঃশ্বাসের ভেতর দিয়ে ওই কণাগুলো গর্ভাশয়ে প্রবেশ করেছিল।
গর্ভাবস্থায় শিশুদের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গর্ভফুল। এটি গর্ভের শিশুদের শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ ও অপ্রয়োজনীয় উপাদান বের করে দেয়ার কাজ করে। শিশুদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতেও ভূমিকা রাখে প্রত্যঙ্গটি।
গবেষকরা বলছেন, ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণায় এমন রাসায়নিক উপাদান থাকতে পারে, যা শিশুর বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
গবেষণায় ওই অন্তঃসত্ত্বাদের গর্ভফুলে অন্তত কয়েক ডজন প্লাস্টিক কণা খুঁজে পাওয়া যায়। এর মাত্র চার শতাংশকে পরীক্ষা করেই আরও বেশি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা পাওয়া যায়।
বেশিরভাগ কণা ছিল নীল, লাল ও কমলা রঙের। গবেষকদের ধারণা, এগুলো পণ্যের মোড়ক, রঙ, প্রসাধনী বা ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিসপত্র থেকে এসেছে।
প্লাস্টিকের কণাগুলোর আকার এত ছোট ছিল যে, সেগুলো খুব সহজেই রক্তে মিশে যেতে পারে। হয়তবা শিশুদের শরীরেও সেগুলো প্রবেশ করেছে। তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত নন গবেষকরা।
গবেষণায় নেতৃত্ব দেয়া রোমের স্যান গিওভান্নি ক্যালিবিটা হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান অ্যান্তোনিও রাগুসা বলেন, ‘এই ঘটনা অনেকটা সাইবর্গ (বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর গল্পের বিশেষ ধরনের মানুষ, যাদের শরীর জৈব-অজৈব উপাদানে গঠিত) শরীর থাকার মতো। এতে শুধু মানব কোষই নয়, জৈব-অজৈব দুই ধরনের উপাদানই রয়েছে।’
শিশুদের মায়েরা এই গর্ভফুলে প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি দেখার পর হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন বলেও জানান তিনি।
জার্নাল এনভারয়নমেন্ট ইন্টারন্যাশনালে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ‘ভ্রুণের বিকাশে গর্ভফুল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এতে ক্ষতিকর প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয়। গর্ভফুলে মাইক্রোফুলের উপস্থিতির ক্ষতি নিয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।’
এ বছরের অক্টোবরে একদল গবেষক জানিয়েছিলেন, শিশুদের প্লাস্টিকের বোতলে করে দুধ খাওয়ালে লাখ লাখ ক্ষুদ্র কণা শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
২০১৯ সালে এক গবেষণায় জানা যায়, যানবাহনের ধোঁয়া ও জীবাশ্ম জ্বালানির দূষণ গর্ভের শিশুদেরও ক্ষতি করে। বায়ু দূষণের কারণে তাদের শরীরে ক্ষতিকর কণা প্রবেশ করতে পারে।
লন্ডনের কিংস কলেজের ধাত্রীবিদ্যার অধ্যাপক অ্যান্ড্রু শেনান ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ইতালির ওই গবেষণার শিশুদের স্বাভাবিক জন্মই হয়েছিল। তবে সদ্যজাত শিশুর শরীরে অজৈব উপাদান থাকাটা স্বাভাবিক ঘটনা নয়।’
দূষণ নিয়ে কাজ করা ক্যামিকেল চ্যারিটি নামের একটি সংস্থার কর্মকর্তা এলিজাবেথ সল্টার বলেন, ‘শিশুরা জন্মের আগেই দূষণের শিকার হচ্ছে। গর্ভফুলে প্লাস্টিক কণা পাওয়ার গবেষণাটি ছোট হলেও এটি এক ধরনের সতর্কবার্তা দিয়েছে।’
সম্প্রতি গবেষণাগারে গর্ভবতী ইঁদুরদের ওপর পরিচালিত আরেকটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, নিঃশ্বাসের সঙ্গে ঢোকা ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা ইঁদুরদের লিভার, ফুসফুস, কিডনি, মস্তিষ্ক ও গর্ভাশয়ে জমা হয়েছে।