করোনাভাইরাসের নতুন রূপের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে, তা হলো এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাজ্য ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের কিছু কিছু অঞ্চলে সংক্রমণ লাফিয়ে বাড়ার পেছনে এই ধরনই দায়ী বলে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।
যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে ১৪ ডিসেম্বর করোনার নতুন রূপ শনাক্তের কথা জানিয়ে দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক জানান, দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে সংক্রমণের মাত্রা বাড়ার পেছনে এটাই কারণ হয়ে থাকতে পারে।
নতুন ধরনটি কেমন?
বর্তমানে যে ধরনের করোনা বিশ্বজুড়ে মহামারি ঘটাচ্ছে, সেটির নাম ‘সার্স সিওভি টু’। এটির যে পরিবর্তিত রূপ যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হয়েছে, সেটির নাম দেয়া হয়েছে সার্স সিওভি টু ভিইউআই-২০২০/০১ (ভ্যারিয়েন্ট আন্ডার ইনভেস্টিগেশন, বর্ষ ২০২০, মাস ১২, ধরন ০১)।
‘সার্স সিওভি টু’ থেকে ১৭ বার পরির্বতন বা বিবর্তনের একটি সেটের পর নতুন রূপটি ধারণ করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটা হয়েছে প্রোটিনযুক্ত স্পাইকে, যা মানব শরীরে আক্রমণে ব্যবহার করে ভাইরাস।
প্রোটিন স্পাইকে পরিবর্তন করোনার নতুন রূপটিকে আরও বেশি সংক্রামক বানিয়ে থাকতে পারে। সেই সঙ্গে এটি মানুষ থেকে মানুষে আরও দ্রুত ছড়ানোর ক্ষমতা পেয়ে থাকতে পারে।
শনাক্ত হলো কিভাবে?
করোনা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক কনসোর্টিয়াম ‘কোভিড-১৯ জেনোমিকস’। এর সঙ্গে যুক্ত দেশটির স্বাস্থ্য বিষয়ক চারটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে দেশটির জিন গবেষণা ইনস্টিটিউট ওয়েলকাম স্যানগার ইনস্টিটিউট ও ১২টি অ্যাকাডেমিক প্রতিষ্ঠান।
চলতি বছরের এপ্রিলে গঠনের পর এই কনসোর্টিয়াম দৈবচয়নের ভিত্তিতে যুক্তরাজ্য জুড়ে কোভিড-১৯ পজিটিভ নমুনার জেনেটিক সিকোয়েন্সিং নিয়ে কাজ করছে। এরই মধ্যে করোনা শনাক্ত ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ থেকে নমুনা নিয়ে জিন বিশ্লেষণ করেছে কনসোর্টিয়ামটি।
এসব বিশ্লেষণের তথ্যউপাত্ত থেকে উঠে আসে করোনার পরিবর্তিত নতুন রূপটি। কনসোর্টিয়ামটির ওয়েবসাইটে সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনেও তা তুলে ধরা হয়।
নতুন ধরন কতটা প্রচলিত?
১৩ ডিসেম্বরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যের প্রায় ৬০টি জায়গায় নতুন ভ্যারিয়ান্টে শনাক্ত ১ হাজার ১০৮ জন রোগী পাওয়া যায়। সত্যিকারের সংখ্যাটা আরও বেশি হয়ে থাকতে পারে।
শুরুর দিকে করোনার নতুন রূপটি বেশি ধরা পড়ে যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে। অতি সাম্প্রতিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ওয়েলস ও স্কটল্যান্ডসহ দেশটির অন্যান্য এলাকায়ও এটি শনাক্ত হয়েছে।
এ বিষয়ে ১৫ ডিসেম্বর বার্মিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবিয়াল জিনোমিক্স অ্যান্ড বায়ো-ইনফরমেটিক্সের অধ্যাপক নিক লকম্যান জানান, করোনার নতুন রূপটি প্রথম ধরা পড়ে সেপ্টেম্বরে। আর এখন পর্যন্ত যাদের মধ্যে এটির সংক্রমণ পাওয়া গেছে, তাদের ২০ শতাংশ নরফোক, ১০ শতাংশ এসেক্স ও ৩ শতাংশ সাফোক কাউন্টিতে।
তিনি বলেন, ‘এটি অন্য দেশ থেকে এসেছে এমন কোনো তথ্য নেই। বলা যায়, যুক্তরাজ্যেই এটি বিকশিত হয়েছে।’
যুক্তরাজ্যে পাওয়া গেছে অত্যন্ত ছোঁয়াচে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন
আসলেই এটি বেশি ছড়ায়?
এ ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের আইনসভার নিন্মকক্ষ হাউজ অব কমন্সে দেয়া ভাষণে দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক দাবি করেন, দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডে সাম্প্রতিককালে করোনায় ‘আক্রান্ত বাড়ার পেছনে এটি জড়িত থাকতে পারে।’
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে অধ্যাপক লকম্যান বলেন, ‘যেসব জায়গায় আমরা কোভিড-১৯ সংক্রমণের বাড়বাড়ন্ত রূপ দেখছি, সেখানে নতুন ধরনটি জোরালভাবে জড়িত। এখানে দুটির পারস্পরিক সংযোগ পাওয়া গেছে। অবশ্য এটাকে আমরা কারণ হিসেবে দাঁড় করাতে পারি না। তবে নতুন ধরনটি ব্যাপকভাবে ছড়ায় এবং এই কারণে আমরা উদ্বিগ্ন। জরুরি ভিত্তিতে এটি খতিয়ে দেখা এবং তদন্ত করা দরকার।’
করোনার ধরন বদলানো কি প্রত্যাশিত?
বর্তমান মহামারির করোনা ‘সার্স সিওভি টু’ আরএনএ জিনকাঠামোর একটি ভাইরাস। ভাইরাস প্রতিনিয়তই রূপ বদল করে। এ কারণে করোনার মিউটেশন হওয়াটাও স্বাভাবিক।
করোনার এরই মধ্যে কয়েক হাজার বদলি রূপ পাওয়া গেছে। তবে খুব অল্প কয়েকটাকেই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের করোনাবিষয়ক কনসোর্টিয়াম বলছে, ভাইরাসটির প্রোটিন স্পাইকে এরই মধ্যে প্রায় ৪ হাজার মিউটেশন লক্ষ্য করা গেছে।
কনসোর্টিয়ামের পরিচালক স্যারন পিকক বলেছেন, ‘মিউটেশন প্রত্যাশিত। ভাইরাস বিবর্তনে এটি একটি প্রাকৃতিক ব্যাপার। (করোনাভাইরাসের) কয়েক হাজার বিবর্তন এরই মধ্যে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ভাইরাসটির ক্ষেত্রে বেশির ভাগেরই কোনো প্রভাব নেই। তবে চলমান মহামারি পর্যবেক্ষণে এগুলো মাপকাঠি হিসেবে দেখা যেতে পারে।’
নতুন ধরনটি কি আরও ভয়াবহ?
এ ব্যাপারে এখনও কিছু জানা যায়নি। ধরন বদলানো ভাইরাসকে বেশি সংক্রামক করতে পারে। তবে ভয়াবহ বানাতে পারে না।
উদাহরণ হিসেবে করোনার একটি বদলি রূপ ’ডি৬১৪জি’ এর কথা বলা যেতে পারে। ধারণা করা হয়, এটি খুব দ্রুত ছড়ায় এবং যুক্তরাজ্যে এটি এখন সবচেয়ে কমন একটি করোনার রূপ। কিন্তু এতে আক্রান্তদের মধ্যে জটিল কিছু দেখা যাচ্ছে না।
করোনার নতুন রূপটির তীব্রতা বেশি নাকি কম তা পর্যবেক্ষণে কাজ করছে পোর্টন ডাউনে অবস্থিত যুক্তরাজ্যের জনস্বাস্থ্য ল্যাবরেটরি। তবে দেশটির স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুসান হপকিন্স বলেছেন, ‘নতুন ধরনটি অসুস্থতা আরও বাড়িয়ে দেয় কি না এখন পর্যন্ত এমন প্রমাণ নেই।’
টিকা কি নতুন ধরনে কাজে দেবে?
স্পাইক প্রোটিনে মিউটেড হওয়া নতুন ধরনটি প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দিয়েছে করোনা রোধে এখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত তিনটি টিকাকে (মডার্না, ফাইজার ও অক্সফোর্ড)।
টিকা মূলত করোনার স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধেই অ্যান্টিবডি তৈরি করে। ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনে কোনো একটি পরিবর্তন টিকার কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে।
সময়ের সঙ্গে ভাইরাসটিতে আরও বেশি বিবর্তন ঘটলে টিকাতেও পরিবর্তন আনতে হতে পারে। যেমনটা ঘটে মৌসুমী ফ্লুয়ের ক্ষেত্রে। প্রতি বছরই ফ্লুয়ের ভাইরাসে মিউটেশন ঘটে। সেভাবে পরিবর্তন আনা হয় টিকাতেও। সে হিসেবে করোনা রোধে এখন পর্যন্ত যেসব টিকা ট্রায়াল পর্যায়ে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে, প্রয়োজনে সেগুলোতে সহজেই পরিবর্তন আনা যাবে।