রাজধানীর কলাবাগানের বাসিন্দা আয়েশা বেগম করোনা আক্রান্ত হয়ে পাঁচ দিন ধরে বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। হঠাৎ শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়ায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। চিকিৎসক তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেয়ার পরামর্শ দেন।
তবে সেই মুহূর্তে ঢাকা মেডিক্যালে আইসিইউ বেড খালি ছিল না। তখন আয়েশা বেগমের ছেলে আশরাফুলকে ঢামেকের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার রবিউল ইসলাম এক পাশে নিয়ে বলেন, আইসিইউর ব্যবস্থা তিনি করে দিতে পারবেন। তবে সরকারি নয়; বেসরকারি হাসপাতালে।
নিরুপায় আশরাফুল রাজি হন রবিউলের কথায়। রাজধানীর গ্রিন রোডে নিউ লাইফ হাসপাতাল নামে একটি চিকিৎসাকেন্দ্রের আইসিইউতে ভর্তি করানো হয় তার মা আয়েশাকে। সেই হাসপাতালে আইসিইউ বাবদ প্রতিদিন ১৬ হাজার টাকা দিতে হয়।
খোঁজ নিয়ে আশরাফুল জানতে পারেন, এই হাসপাতালে আইসিইউ বাবদ যে বিল আসবে তার ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন পাবেন ঢামেক হাসপাতালের নিরাপত্তা দায়িত্ব পালনকারী আনসার রবিউল।
এমন অভিযোগের সত্যতা জানতে নিউজবাংলার এ প্রতিবেদক ঢামেকে কায়কোবাদ নামে অপর এক আনসার সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
রোগীর অভিভাবক পরিচয় দিয়ে আইসিইউ প্রয়োজন বলে যোগাযোগ করা হলে আনসার সদস্য কায়কোবাদ জানান, ঢামেক হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি নেই। ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি। এ জন্যে ১০ হাজার টাকা লাগবে প্রতিদিন।
এ বিষয়ে ওই হাসপাতালের মালিক মোমিন আহমেদের সঙ্গে কথা বললে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, যেহেতু আনসারের মাধ্যমে রোগীর তথ্য পেয়েছেন তারা, সে ক্ষেত্রে ওই আনসার সদস্যকে কমিশন দিতে হবে।
কমিশন ৩০ শতাংশ কি না জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এমন না যে তাদের ৩০ শতাংশ দিতেই হবে।
শুধু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল নয়, রাজধানীর অধিকাংশ হাসপাতালের আইসিইউ এখন নিয়ন্ত্রণ করছে আনসার ও নার্সরা। তাদের কমিশন দিলে অনেক সময় তাৎক্ষণিকভাবে আইসিইউর ব্যবস্থা হয়ে যায়।
শীতের আগমনে করোনা ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে আইসিইউর চিকিৎসার চাহিদা। ফলে আইসিইউ পেতে বেগ পোহাতে হচ্ছে রোগীদের।
এ বিষয়ে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, হাসপাতালের কিছু আনসার অতি উৎসাহী হয়ে রোগীর পরিবারকে এ বিষয়ে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারে। তবে এর মধ্যে বাণিজ্যিক স্বার্থ থাকলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। উল্লিখিত দুই আনসার সদস্যের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আইসিইউ সংকট নিরসনে এর সংখ্যা বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, সাধারণত বয়স্ক ও আগে থেকেই অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্তদের আইসিইউ প্রয়োজন হয়। অথচ প্রতিটি কোভিড-ডেডিকেটেড হাসপাতালে একটি আইসিইউ শয্যা পেতে অপেক্ষায় থাকতে হয় একাধিক রোগীকে। আইসিইউ না পেয়ে রোগী মারা যাওয়ার সংবাদও আসে প্রতিদিন। এ ছাড়া শীতের কারণে সংক্রমণ কিছুটা বেড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, একটি দেশের হাসপাতালে রোগীর জন্য যতগুলো শয্যা রয়েছে, তার ১০ শতাংশ আইসিইউ থাকতে হবে। তবে এটি সম্ভব না হলে ন্যূনতম চার শতাংশ থাকতে হবে।
বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে সব মিলিয়ে রোগীর শয্যা রয়েছে ৩১ হাজার ২২০টি। হিসাব অনুযায়ী এসব হাসপাতালে আইসিইউ থাকার কথা সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি। ন্যূনতম ধরলেও এর সংখ্যা হওয়ার কথা ছিল ১ হাজার ২০০-এর মতো। তবে এসব হাসপাতালে বর্তমানে আইসিইউ রয়েছে মাত্র ৫৭১টি।
স্বাস্থ্য অধিদফতের তথ্য বলছে, সারা দেশে করোনা রোগীর সেবা দেয়ার জন্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে মোট ১০ হাজার ৪৩৬টি আইসোলেশন সিট রয়েছে। এর মধ্যে খালি বেড রয়েছে ৫ হাজার ৯০৮টি। ঢাকা বিভাগে মোট ১৯ হাসপাতালে তিন হাজার ২৬০ বেড রয়েছে। এর মধ্যে খালি রয়েছে ১ হাজার ৩৮৯টি বেড।
সারা দেশে হাসপাতালগুলোতে মোট আইসিইউর আসন সংখ্যা ৫৭১টি। বর্তমানে খালি রয়েছে ২৮৬টি। শুধু ঢাকায় ২৮৯ বেড রয়েছে, যার মধ্যে ৭৮টি খালি। এমন চাহিদার মধ্যে সারা দেশে প্রায় ৩৫ শতাংশ আইসিইউ বেড খালি রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ থেকে ২০ শতাংশ রোগীকে আইসিইউতে রাখার প্রয়োজন হতে পারে। তবে দেশে করোনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংকটপূর্ণ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, শীতে করোনা ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ কিছুটা বাড়ছে। সেই কারণে হয়তো আইসিইউর চাহিদা বাড়তে পারে। তবে রাজধানীতে আইসিইউর চাহিদা থাকলেও জেলা শহরে তেমন নেই। এখন প্রায় ৩৭ শতাংশ খালি রয়েছে।