কোনো রোগের টিকা উদ্ভাবন দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়া। সাধারণ পরিস্থিতিতে কোনো টিকা অনুমোদন, বাজারে ছাড়া ও বিতরণের স্তরে আসতে লেগে যায় ১০ থেকে ১৫ বছর সময়।
চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়ার শুরু থেকেই করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিলেন মহামারি বিশারদরা। অতি ছোঁয়াচে এই ভাইরাসে এরই মধ্যে মৃত্যু হয়েছে সাড়ে ১৩ লাখ মানুষের।
বিষয়টি পরিষ্কার যে, স্বাভাবিক সময়ে নেই বিশ্ব। এই রোগের প্রতিষেধক উদ্ভাবনেও উঠেপড়ে লেগেছে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। চলমান মহামারি এক বছর পার না হতেই মনে হচ্ছে, কার্যকরী টিকা খুব দূরে নেই।
নভেম্বরের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি ওষুধ কোম্পানির ঘোষণা করোনা প্রতিরোধ নিয়ে আশার সঞ্চার করেছে।
তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে ফাইজার জানায়, করোনা প্রতিরোধে তাদের উদ্ভাবিত টিকা ৯০ শতাংশ কার্যকর।
সপ্তাহের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের আরেক প্রতিষ্ঠান মডার্না জানায়, তাদের টিকা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া থেকে মানুষকে রক্ষায় প্রায় ৯৫ শতাংশ কার্যকর।
ফাইজার এরই মধ্যে তাদের টিকা নিয়ে চূড়ান্ত বিশ্লেষণ সম্পন্ন করেছে। তাতে দেখানো হয়, প্রতিষ্ঠানটির করোনা টিকা ৯৫ শতাংশ কার্যকর। ‘কয়েক দিনের’ মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ফুড ও ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হবে বলেও প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলছেন, একটি টিকা উদ্ভাবন ও অনুমোদন কেবল একটি চ্যালেঞ্জের অর্ধেক। এরপর আসছে আরও কঠিন কাজ—টিকা বিতরণ ও জনসাধারণের দোড়গোড়ায় পৌঁছানো। আর এসব চ্যালেঞ্জ জানান দিচ্ছে, চলমান মহামারির লাগাম এখনই টানা যাচ্ছে না।
বেশ কয়েকজন শীর্ষ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মতে, করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে ২০২১ সালের শীত পর্যন্ত মাস্ক পরা ও সামাজিক দূরত্ব মানার বিষয়টি চালিয়ে যেতে হতে পারে।
টিকার বর্তমান অবস্থা
নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ৫৪টি করোনা টিকার পরীক্ষা চলছে মনুষ্য শরীরে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র দুটি টিকা অনুমোদন পাওয়ার দ্বারপ্রান্তে।
ফাইজার: ৯ নভেম্বর আশাব্যঞ্জক এক ঘোষণা নিয়ে আসে ফাইজার। তারা জানায়, জার্মান প্রতিষ্ঠান বায়ো-এনটেকের সঙ্গে যৌথভাবে উদ্ভাবিত টিকা আগে আক্রান্ত হয়নি এমন লোকজনকে ৯০ শতাংশের বেশি নিরাপদ রাখতে পারে।
টিকাটি ২১ দিনের ব্যবধানে নিতে হয় দুই ডোজ। প্রাথমিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ৯০ শতাংশ কার্যকারিতার খবর দেয়ার পর ১৮ নভেম্বর ট্রায়ালের চূড়ান্ত বিশ্লেষণের তথ্য জানায় ফাইজার।
কোম্পানিটির ঘোষণায় বলা হয়, টিকাটি হালকা ও গুরুতর পর্যায়ের সংক্রমণ রোধে ৯৫ শতাংশ কার্যকর। কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও তৈরি করে না।
এ বিষয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিস্তৃত প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে থাকা বয়স্কদের ক্ষেত্রেও টিকাটি ৯৪ শতাংশ কার্যকর। টিকা ব্যবহারের অনুমতি পেতে দ্রুতই এফডিএর অনুমতি চাওয়া হবে বলে ফাইজার থেকে জানানো হয়।
মডার্না: ১৬ নভেম্বর মডার্না এক ঘোষণায় জানায়, গবেষণায় দেখা গেছে তাদের টিকা করোনা রোধে ৯৪.৫ শতাংশ কার্যকর। চার সপ্তাহের ব্যবধানে দুই ডোজ নিতে হয় এই টিকা। যদিও এটির ট্রায়াল এখনও শেষ হয়নি।
এই টিকার ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের করোনা মহামারি মোকাবিলাবিষয়ক টাস্কফোর্সের অন্যতম সদস্য অ্যান্থনি ফাউচি বলেন, ‘আমি আগে থেকেই বলছিলাম, ৭৫ শতাংশ কার্যকর কোনো টিকা পেলেই আমি সন্তুষ্ট থাকব।
‘উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা বললে, আপনারা হয়তো ৯০, ৯৫ শতাংশ কার্যকর টিকা দেখতে চাইবেন। তবে আমি এমনটা প্রত্যাশা করছি না।’
এ ছাড়া বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের করোনা টিকা পাইপলাইনে আছে। টিকা উদ্ভাবন প্রতিযোগিতায় ফাইজার ও মডার্নার খানিক পরই রয়েছে জনসন অ্যান্ড জনসন, সানোফি অ্যান্ড জিএসকে, নোভাভ্যাক্স ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার অবস্থান।
একাধিক টিকা পাওয়া যাবে?
বিশ্বজুড়ে করোনার যে বিস্তৃতি, তাতে একাধিক টিকার প্রয়োজনের প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বেথ ইসরায়েল ডেকোনেস মেডিক্যাল সেন্টারের ভাইরাস ও টিকা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. ড্যানিয়েল ব্যারোচ বলেন, ‘বিশ্বে ৭০০ কোটি মানুষ। তাই সফল হওয়ার জন্য আমাদের একাধিক টিকা প্রয়োজন। এটা কেবল টিকা উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আরেকটি টিকা উদ্ভাবনী প্রতিষ্ঠানের প্রতিযোগিতা নয়। এটা বৈশ্বিক ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
‘সকল টিকা উদ্ভাবকদের আমি বলব, আমরা চাই সবগুলো প্রকল্পই সফল হোক।’
মডার্না ও ফাইজারের সামনের বাধা
কার্যকারিতার প্রমাণ দিতে পারায় জরুরি ব্যবহারের জন্য প্রতিষ্ঠান দুটির টিকা এখন অবশ্যই অনুমোদন দেবে যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও মানবসেবাবিষয়ক মন্ত্রী অ্যালেক্স অ্যাজার সিএনবিসিকে জানান, উভয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছে তার দফতর। অপ্রয়োজনীয় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সে ব্যবস্থাও নেয়া হবে।
এরপরও কিছু চ্যালেঞ্জ থেকে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছু অঙ্গরাজ্য আছে, যেখানে করোনার টিকার প্রতি তেমন আস্থাই নেই। টিকা সম্পর্কে সেসব এলাকায় আস্থা ফেরানোটা কঠিনই হবে বৈকি।
এ ছাড়া এফডিএ অনুমোদিত কোনো টিকার জন্য ভ্যাট না দেয়ার ব্যাপারে অনেক গভর্নর এরই মধ্যে জোট বেঁধেছেন বলে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
টিকা নিয়ে ফেডারেল সরকার ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের জানাশোনার ব্যাপারটি এখনও যথাযথভাবে শেষ হয়নি। এসব কারণেও টিকা জনসাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি হতে পারে।
বিষয়টি নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের স্বাস্থ্য ও জনসেবা বিভাগের ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ পল ম্যাঙ্গো বলেন, ‘কোনো অঙ্গরাজ্য যদি বাধা আরোপ করে, তাহলে খুব ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকদের টিকা পেতেও দেরি হবে।’
প্রথমে টিকা পাবে কারা?
টিকার খবর আসার পর কাদের ওপর আগে প্রয়োগ করা হবে, এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বেশ কিছু সংস্থা। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তরও পাওয়া যায়নি।
তবে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে চারটি গ্রুপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)। এতে প্রথমেই রয়েছে স্বাস্থ্যকর্মীরা। এরপরই রয়েছেন অতি প্রয়োজনীয় দায়িত্বে নিযুক্ত কর্মীরা। এরপর বৃদ্ধ ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জটিলতায় শয্যাশায়ীরা।
শিশুদের ক্ষেত্রে কী হবে?
প্রকৃতিগভাবে পর্যাপ্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকার কারণে শিশুদের ক্ষেত্রে টিকার সাড়াটা প্রাপ্তবয়স্কদের মতো পাওয়া যায় না। ফলে টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠাগুলোও ট্রায়ালে শিশুদের রাখেনি।
অবশ্য অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই বলছে, শিশুদের জন্যও টিকা উদ্ভাবনের ইচ্ছা আছে তাদের। তাই ২০২১ সালের শেষ নাগাদ শিশুদের জন্য করোনার টিকা পাওয়া যাবে কি না, তা এখনও বলা যাচ্ছে না।
ব্যাপকভাবে টিকা বিতরণ কবে
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২১ সালের জুনের মধ্যেই করোনার টিকা পেয়ে যেতে পারে প্রত্যেক আমেরিকান।
তবে বিতরণ প্রক্রিয়াটা সহজ হবে না। বিশেষ ক্ষেত্রে ফাইজারের টিকা বিতরণ বেশি কঠিন হবে।
ফাইজার ও মডার্না ‘এমআরএনএ’ জেনেটিক কোড ব্যবহার করলেও প্রথম কোম্পানিটির টিকা সংরক্ষণ প্রক্রিয়াটা জটিল।
টিকাটি মাইনাস ৯৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার বিশেষায়িত ডিপ ফ্রিজ স্যুটকেসে বহন করতে হবে ফাইজারের টিকা। স্যুটকেস দিনে খোলা যাবে দুবার। তবে কোনোবারই ১৮০ সেকেন্ডের বেশি খোলা অবস্থায় রাখা যাবে না।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় ওষুধ সামগ্রী সরবরাহ প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ারের পরিচালক সুমি সাহা সিবিসিকে বলেন, ‘বাস্তবতা হলো কোনো ওষুধ সংরক্ষণে এমন তাপমাত্রার প্রয়োজন পড়েনি।’
তার মতে, গ্রামাঞ্চলের যেসব হাসপাতাল টিকা সংগ্রহ ও সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করতে সক্ষম নয়, সেসব এলাকার লাখ লাখ মানুষের কাছে টিকা পৌঁছানোটা ‘যৌক্তিকভাবেই দুঃস্বপ্ন’।
মডার্নার টিকাটিও হিমায়িত জাহাজে বহন করতে হবে। তবে বিষয়টি ফাইজারের টিকার মতো দুরূহ হবে না। তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৪৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রাতেই মডার্নার টিকা বহন করা যাবে।
টিকার দাম কেমন হবে?
বিষয়টি নিয়ে এখনও স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। তবে করোনাভাইরাস সংকট নিয়ন্ত্রণে ডনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের নেয়া ‘অপারেশন র্যাপ স্পিড’-এ বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে টিকা কেনার পর তা প্রত্যেক নাগরিকের জন্য বিনা মূল্যে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।