রাজধানীর শ্যামলীর একটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ছেলেকে ভর্তি করেছিলেন ‘ফ’ অদ্যাক্ষরের এক অভিভাবক। মাদক থেকে মুক্তি মেলেনি, উল্টো পিটুনির কারণে হাত ভেঙে যাওয়ায় ছেলের চিকিৎসা করাতে হয়েছে অন্য জায়গায়। পরে সেখান থেকে নিয়ে ছেলেকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করেন ওই ব্যক্তি।
সম্প্রতি আদাবরের মাইন্ড কেয়ার ইনস্টিটিউট নামে একটি মানসিক হাসপাতাল ও মাদক নিরাময় কেন্দ্রে এক এএসপিকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে।
কেন সেখানে পেটানো হলো পুলিশ কর্মকর্তাকে? খোঁজ নিতে গিয়ে উঠে এসেছে এই ধরনের হাসপাতালগুলোতে এ রকম পিটুনি চলে নিয়মিত।
চিকিৎসা করে সুস্থ হওয়া রোগী, রোগীর অভিভাবক, এমনকি সরকারি মানসিক হাসপাতালের একজন কর্মীও জানিয়েছেন একই অভিযোগ।
পাবনা মানসিক হাসপাতালের একজন সাইকোলজিস্ট সোশ্যাল ওয়ার্কার জানিয়েছেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত লোকবল থাকে না। রোগীরা কথা না শুনলেই পিটুনি দিয়ে তাদের ভয় দেখানো হয়। তারা ভয়ে কথা শুনবে বলে ধারণা থেকে এই কাজ করা হয়। যদিও এতে হিতে বিপরীত হয়। রোগীরা সুস্থ হওয়ার বদলে নতুন বিপত্তি তৈরি হয়।
আদাবরে একটি মাদকসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে ছেলের চিকিৎসা করিয়েছেন শ্যামলীর একজন বাসিন্দা। তার অভিযোগ, সেখানে অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্স ছিলেন না। স্টাফরাও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন। অল্পতেই তারা রেগে যেতেন। রোগীদের মারধর করতেন। অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হতো তাকে।
ওই প্রতিষ্ঠানটিতে ৭০ জন রোগীর চিকিৎসায় স্টাফ ছিলেন মাত্র তিনজন। মাসে একবার অভিজ্ঞ একজন চিকিৎসক আসলেও তিনি ঠিকভাবে রোগীদের দেখতেন না বলে জানিয়েছেন এই অভিভাবক। ছেলের এক মাস চিকিৎসার জন্য লক্ষাধিক টাকা পরিশোধ করতে হয় ওই অভিভাবককে। পরে সেখান থেকে ছেলেকে নিয়ে আসেন তিনি।
যদিও স্বাস্থ্য নীতি ২০১৭ বলছে, মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পাশাপাশি থাকতে হবে বিশেষজ্ঞ নার্স। বোর্ড গঠন করে সমস্যা আগে চিহ্নিত করে চিকিৎসা দিতে হবে। কারণ, মানসিক সমস্যা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। রোগী কী ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত প্রথমে তা বের করতে হবে।
তবে আসলে কী হয়, সেটা জানা গেল একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হওয়া একজন রোগীর কাছ থেকে।
সন্তান প্রসবের পরে পোস্ট পার্টাম সাইকোসিসে আক্রান্ত হন একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত নাদিয়া সারওয়াত। এমন অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয় রাজধানীর শ্যামলীর একটি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে।
সে সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে নাদিয়া সম্প্রতি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘রাতে হাসপাতালের সব লাইট নেভানো থাকলেও, নার্সের ঘরে আলো জ্বলত। আমি বারবার ঘুরে ঘুরে ওই ঘরে চলে যেতাম, আমার বাচ্চাটাকে খুঁজতে। তখনই বিরক্ত হয়ে একদিন গায়ে হাত তুলেছিল নার্স। গালে কালশিটে দাগ ছিল ছাড়া পাওয়ার পরেও।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘হাসপাতালে প্রথম দিন থেকেই ইনজেকশন দিতে চাইতাম না, হাত পা ছুঁড়তাম, তখন জোর করে চেপে ধরত নিয়মিতই, সেটাকে মার হিসেবে মনে রাখিনি। কিন্তু ওই ঘটনা মনে রেখেছি, পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে না পারলেও অপমানটা ঠিকই আঘাত করেছে।’
এ প্রতিবেদনে নাম প্রকাশ কোনো আপত্তি নেই জানিয়ে নাদিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হাসপাতালের অনেকেই আন্তরিক ছিলেন। তবে সেই সময়ের কিছু বাজে অভিজ্ঞতা এখনও আমি ভুলতে পারিনি। ’
মাইন্ড এইডে পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুর পর প্রশাসনের চালানো অভিযানেও উঠে এসেছে বিভিন্ন অনিয়ম। পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক-নার্স ছিল না সেখানে। স্টাফদের দুর্ব্যবহার, মারধর, নির্যাতন, নিয়মিত খাবার না দেয়া, মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ দেয়ার প্রমাণ পেয়েছে প্রশাসন।
অন্য হাসপাতালগুলোতেও পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা আর নীতিমালা অনুযায়ী চিকিৎসক, কর্মী আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আর হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে পিটুনির শিকার হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে ব্যাপক হারে।
মানসিক সমস্যায় থাকা মেয়েকে বারিধারার প্রমিসেস মেডিক্যাল লিমিটেডে হাসপাতালে ভর্তি করান মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা মুন্নি (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘ওরা (হাসপাতাল স্টাফ) রোগীদের ওপর কথায় কথায় নির্যাতন করে। এখানে যারা সেবা দেন, তারা কেউই পারদর্শী না।’
এই নির্যাতনের কথা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো কেন অভিযোগ করা হয়েছে, সেজন্য আরও নির্যাতন সহ্য করতে হয়।
নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে হাসপাতালের চেয়ারম্যান শাহিদুল ইসলাম হেলাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যদি কোনো রোগী অভিযোগ করে থাকে, তাহলে অবশ্যই ঠিক বলেছেন। কারণ, প্রত্যেক রোগী এমন কথা বলেন। তবে অভিভাবক যদি অভিযোগ করে থাকে, তাহলে আমি বলব, এটি ভিত্তিহীন। আমাদের বিশেষজ্ঞরা অনেক দক্ষ।’
পাবনা মানসিক হাসপাতালের সাইকোলজিস্ট সোশ্যাল ওয়ার্কার মকবুল হোসেন পাশাও শুনেছেন রোগীকে বেধড়ক মারধরের কথা।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকাসহ সারাদেশে অনেক মানসিক রোগ নিরাময় কেন্দ্র গড়ে উঠছে। যেগুলোতে ডাক্তার না হয়েও, মানসিক বিশেষজ্ঞ না হয়েও চিকিৎসা দিচ্ছেন অনেকে। বিভিন্নভাবে নির্যাতন করছেন রোগীদের।’
‘দীর্ঘ সময় ভুল চিকিৎসা ও অত্যাচারের পর রোগী সুস্থ না হওয়ায় অভিভাবক ডাকা হয়। অভিভাবক এসে দেখছে রোগীর হাত ভাঙা, পা ভাঙা, শরীরে বিভিন্ন ধরনের আঘাতের চিহ্ন। নির্যাতন করা কোনোভাবেই চিকিৎসা পদ্ধতি হতে পারে না’- বলেন মানসিক রোগীর চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ মকবুল পাশা।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালে সারোয়ার আলমও বহু হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে এই অনিয়ম দেখেছেন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নার্স সংকট, অভিজ্ঞ ডাক্তার সংকট, এই রোগীদের জন্য যে ধরনের পরিবেশ থাকা দরকার তার কিছুই দেখিনি আমি। মানহীন অনেকগুলো হাসপাতাল বন্ধ করেছি। তবে মানে উন্নতি করতে পারিনি।’
অবৈধ হাসপাতাল কত, জানে না অধিদফতর
যাদের হাসপাতালগুলো দেখভাল করার কথা, সেই স্বাস্থ্য অধিদফতর জানেই না লাইসেন্স না নিয়ে কতগুলো হাসপাতাল চলছে রাজধানীতে।
অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ উদ্দিন মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনুমোদন নিয়েছে ১৫টি হাসপাতাল। তবে লাইসেন্স ছাড়া মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দিচ্ছে এমন প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান জানা নেই।’
অনুমোদনহীন হাসপাতালগুলো কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে? এমন প্রশ্নে ডা. ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘জনবল সংকট থাকার কারণে যেভাবে ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন, সেভাবে নেয়া যাচ্ছে না।’
ঢাকা বিভাগের সিভিল সার্জন মঈনুল আহসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র পরিচালনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। তবে অধিকাংশ হাসপাতাল এই অনুমোদন ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে। আমরা বিভিন্ন সময় অভিযান করছি।’