পুরুষের তুলনায় নারীদের জীবন দুর্বিষহ এমন একটি ধারণা বিশ্বের সব দেশে প্রচলিত। এই ধারণাটির সত্যতা যাচাইয়ে চমকপ্রদ এক পরীক্ষায় জড়িয়েছিলেন আমেরিকান নারী লেখক ও সাংবাদিক নোরাহ ভিনসেন্ট। নারীবাদী হিসেবে সুপরিচিত নোরাহ সিদ্ধান্ত নেন পুরুষ সেজে পুরুষদের বোঝার চেষ্টা করবেন।
প্রায় দুই দশক আগে ২০০৩ সালে শুরু হয় নোরাহর ‘পুরুষ জীবন’, চলে একটানা ১৮ মাস। নিজের পরিচয় গোপন করে ‘নেড’ নাম নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন আমেরিকার পাঁচটি রাজ্যে। সে সময় ৩৫ বছর বয়সী নোরা পুরুষের ছদ্মবেশ সুচারু করতে মেকআপ আর্টিস্টের সাহায্যে চিবুক ও চুলে পরিবর্তন আনেন। চোখে ছেলেদের মতো চার কোনা চশমা লাগান। বুকে ও পিঠে পেশি বাড়াতে করেছেন বিশেষ ব্যায়াম।
স্তন গোপন রাখতে ছোট সাইজের স্পোর্টস ব্রা পরা শুরু করেন। এমনকি প্রস্থেটিকের বানানো একটি পুরুষাঙ্গও বেল্টের সাহায্যে বিশেষ কায়দায় দেহে লাগিয়ে নিয়েছিলেন।
শুধু তা-ই নয় ম্যানহাটনের জুলিয়ার্ড স্কুলের এক ভোকাল কোচের অধীনে দীর্ঘদিন নোরাহ কীভাবে কণ্ঠস্বর ভারী ও ধীর লয়ে করতে হয় ও কীভাবে নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেন। পুরুষের বেশে তিনি মিশেছেন পুরুষ, নারী উভয়ের সঙ্গে। তার সেই ‘পুরুষ অভিজ্ঞতা’ থেকে পরে লেখেন ‘সেলফ মেড ম্যান’ নামের একটি বই।
সে সময়ের ‘পুরুষ জীবনে’ নোরাহ দেখতে পান পুরুষ সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত ধারণার বড় অংশটিই ভুল। আধুনিক নারীবাদ পুরুষের নিজস্ব সংকট ও চ্যালেঞ্জকে বুঝতে ব্যর্থ বলেও উপলব্ধি তৈরি হয় তার মাঝে। গত বছরের ৬ জুলাই সুইজারল্যান্ডে স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নেন ৫৩ বছর বয়সী নোরাহ।
‘সেলফ মেড ম্যান’ বইটি নিয়ে ২০০৬ সালে ওয়েবসাইট বুকপেইজ ডটকমকে একটি সাক্ষাৎকার দেন সমকামী এই লেখক। সেটির ভাষান্তর করা হলো নিউজবাংলার পাঠকদের জন্য।
আমেরিকার তিনটি অঞ্চলের পাঁচটি রাজ্যের পুরুষের সঙ্গে মিশেছেন নোরাহ। নেড ভিনসেন্ট নাম নিয়ে বন্ধু বানিয়েছেন, ছেলেদের বোলিং দলে যোগ দিয়েছেন, স্ট্রিপ ক্লাবে গেছেন, মেয়েদের সঙ্গে ডেট করেছেন, আশ্রমে যোগ দিয়েছেন, ছেলেদের জন্য বিশেষায়িত থেরাপি গ্রুপে অংশ নিয়েছেন; এমনকি অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক সেলসম্যানের কাজের বাস্তবতার অভিজ্ঞতাও তার হয়েছে।
নোরাহ দেখেছেন অনেকে যেসব ধারণা করেন বাস্তবের সত্যিটা তেমন নয়। ছেলেদের জীবন সহজ নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের চেয়ে তাদের জীবন অনেক বেশি আবেগগত ক্ষয়ের মুখোমুখি হয়।
আমেরিকান নারী লেখক ও সাংবাদিক নোরাহ ভিনসেন্ট
ম্যানহাটন থেকে ফোনে দেয়া সাক্ষাৎকারে নোরাহ বলেন, ‘অনেকেই ভাবতে পারেন, সমকামী হিসেবে হয়তো আমি শুধু পুরুষদের দোষারোপ করে যাব- শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। তবে আমার অভিজ্ঞতা আমাকে অনেক বেশি দুর্বল করে তুলেছে। আমি অনেক বেশি যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে গেছি। সবকিছুই খুব কঠিন ছিল।
‘পোস্ট ফেমিনিস্ট মুভমেন্টের সঙ্গে আমরা যারা জড়িত তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, নারীর চেয়ে পুরুষের জীবন অনেকটাই সহজ। অথচ সেটা যে ভুল তা বুঝতে আমার পুরুষের জায়গায় যেতে হয়েছে।’
লস এঞ্জেলেস টাইমসের হয়ে নিয়মিত লেখা নোরাহ খ্যাতি পান তার আধুনিক ধ্যান-ধারণাভিত্তিক মতামত কলামের জন্য। প্রথাবিরোধী লেখার জন্য তাকে সমালোচনা করে ‘দ্য লিবারটারিয়ান লেসবিয়ান’ নাম দিয়েছিলেন পাঠকরা।
এক বন্ধুর কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পুরুষের জগতের সঙ্গে মিশে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ নেন নোরাহ।
তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করেই নিজেকে এমন একটা পরিস্থিতিতে পেলাম যেখানে সমাজের নিয়মকানুনগুলো আলাদা। পার্থক্যগুলো হতবাক করার মতো। পুরুষ সেজে যখন আমি একই জায়গাগুলো দিয়ে হাঁটতাম কেউ আমার চোখের দিকে তাকায়নি। সবাই অন্যদিকে তাকাত। সুন্দর কোনো ছেলের দিকে মেয়েরা গোপনে তাকায়। এমনভাবে যেন তাদের তাকানোটা চোখে না পড়ে। ওই চোখে না পড়ার বিষয়টা স্বস্তিদায়ক।’
নোরাহ তার বইয়ের অধ্যায়গুলোকে বিভিন্ন নামে ভাগ করেছেন। বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, যৌনতা, কাজ প্রভৃতি। ভালোবাসা নিয়ে তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে নোরাহ বলেন, প্রত্যাখ্যাত হওয়াটা তার ওপর অনেক বেশি প্রভাব ফেলেছে।
নোরাহ ভিনসেন্টের লেখা বই ‘সেলফ মেড ম্যান’
তিনি বলেন, “বিষয়টি খুবই করুণ। অধিকাংশ নারীর কোনো ধারণা নেই কোনো নারীর সঙ্গে কথা বলতে বা তাদের সঙ্গে পরিচিত হতে পুরুষের কতটা সাহস, মানসিক শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন হয়। ছেলেদের অহম (ইগো) দরকার হয়, কারণ তারা নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করতে পারে না। তারা তাদের চাহিদা প্রকাশ করতে পারে না। এ অপ্রাপ্তিগুলোকে তারা ‘আমি এটা করতে পারব’, ‘এটা আমার দায়িত্ব’ বলে ঢাকা দেয়। কারণ এ ছাড়া তাদের আর কিছু করার নেই।”
পুরুষদের অধিকাংশ সময়ই হিংস্র, নিজেকে ঢেকে রাখা ও আপাত আবেগহীন মনে হলেও, নোরাহ দেখেছেন, ভেতরে তারা নারীর মতোই লৈঙ্গিক সামাজিকীকরণের শিকার ও ‘পুরুষদের দায়িত্বের শিকলে বাঁধা’। নারীবাদীদের যদিও পছন্দ হবে না তারপরও নোরার দাবি- সম্পর্কের ক্ষেত্রে মেয়েরাই আদতে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণে থাকে।
নোরাহ যোগ করেন, ‘একটা ছেলের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে বোঝা যায়, অন্তত যৌনতার ক্ষেত্রে, মেয়েরা যা অফার করে সেটুকু গ্রহণ করা ছাড়া তার আর কোনো পথ নেই। শুধু এটুকু থেকেই বোঝা যায় যে আমরা (নারীরা) এগিয়ে আছি। কারণ, আমরা নিজেরা বেছে নিতে পারি। এ-ও বলতে পারি যে, ‘আমি তোমাকে পছন্দ করতে পারি, কিন্তু করব না। এটা অনেক বড় ক্ষমতা।’
নোরাহ তার সঙ্গে ছেলেদের বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে বহুবার নিজের আসল পরিচয় দিয়েছেন। বলেছেন, তিনি নারী ও তার নাম নেড নয়। তার ছেলে বন্ধুরা এতে আহত হয়নি ও তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরেনি।
তবে প্রতিদিন পুরুষ সেজে ঘোরাফেরা করাটা নোরাহর জন্য শারীরিকভাবে কষ্টদায়ক হয়ে উঠেছিল। এ ধাক্কা থেকে বের হতে তার কয়েক মাস সময় লেগেছে।
তিনি বলেন, ‘বিষয়টি কঠিন। নিজেকে শুধু শারীরিক নয় মানসিকভাবেও ছেলে হিসেবে উপস্থাপন করতে হতো। সেটা থেকে আমাকে সরে আসতে হয়েছে। পুরো প্রক্রিয়াটা শেষ করতে ও নিজেকে ফিরে পেতে সময় লেগেছে।’
নোরাহ বলেছেন, তার পুরুষ সত্তা ‘নেড’-এর বিষয়ে তিনি খুব একটা আশাবাদী ছিলেন না।
তিনি বলেন, ‘ভালো হতো নেড সত্তাটি যদি আরেকটু চটকদার কোনো ব্যক্তিত্ব হতো। কারণ, আমার নেড ছিল ছেলেদের গতানুগতিক অভিজ্ঞতায় ঠাসা। নিজেকে কিছুটা আঁতেল ও প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। আরেকটু গুন্ডা টাইপ হলে ভালো হতো হয়তো।’
নেডের কোনো বৈশিষ্ট্যকে বজায় রাখতে চান কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে নোরাহ বলেন, “হ্যামলেট যেমনটা বলেছিল যে, ‘ভালো বা মন্দ বলে কিছু নেই। চিন্তাতেই সব ভালো-মন্দ’, আমার মনে হয় এটাই ছেলেদের সবচেয়ে বড় শক্তি। যখন আমি কোনো কিছু করতে ভয় পাচ্ছি বা নিজেকে ওই কাজের উপযুক্ত মনে করছি না, আমি নিজেকে বলি, ভয়ের কী আছে? করে ফেল! এত চিন্তার কিছু নেই। উঠে দাঁড়াও ও করে ফেল।
“ছেলেদের জন্য এটা বিশেষ একটা উপহার, যা তাদের অন্য শূন্যতাগুলোকে পূরণ করে দেয়।”
নোরাহ ভিনসেন্ট এই এক্সিপেরিমেন্টের পর বিষণ্নতায় ভোগা শুরু করেন। দীর্ঘদিন ভোগার পর তার অসুখ চিকিৎসার আওতার বাইরে চলে যায়। অবশেষে ২০২২ সালের ৬ জুলাই সুইজারল্যান্ডে ৫৩ বছর বয়সে তিনি স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নেন। তার মৃত্যুর খবর পরের মাসে সংবাদমাধ্যমে আসে।