বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

লবণ পানি-প্যাডের অভাবে যৌন রোগ, বিয়েতে ‘সমাধান’

উপকূলের কিশোরীরা মাসিকের সময়েও লবণ পানিতে গোসল, নদীতে নেট জাল টানার মতো কাজ করে। তাদের প্যাড ব্যবহারের আর্থিক সংগতি নেই। পুরোনো কাপড় ব্যবহারের পর তা লবণ ও নোংরা পানি দিয়ে পরিষ্কার করে। লজ্জায় তা বাইরে শুকানোও যায় না। এসব কারণে যৌনাঙ্গে রোগ হচ্ছে তাদের। আর মা-বাবা চিকিৎসা না করিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন বিয়ে।

উপকূলীয় এলাকায় নদীতে লবণাক্ততা আর স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাড ব্যবহার না করা শেষ পর্যন্ত বাল্যবিয়ের একটি কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

বয়োসন্ধিকালের শুরুর দিকে ঋতুস্রাব বা মাসিক চলাকালে অশোধিত নদীর লবণ পানি এবং প্যাডের বদলে অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহারে কিশোরীদের যৌনাঙ্গে নানা রোগ হচ্ছে। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে কম বয়সেই তাদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকরা।

চিকিৎসকরা বলছেন, নোংরা কাপড় বা লবণ পানির কারণে যেসব সমস্যা হচ্ছে, তার সমাধান বিয়ে হতে পারে না। বরং বাল্য বয়সে বিয়ে হলে যৌন রোগের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।

খুলনা শহর থেকে ৫২ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত দাকোপ উপজেলার কালাবগি গ্রাম। ত্রিভুজ আকৃতির ওই গ্রামটির দুই দিক থেকে বয়ে গেছে শিবসা ও সুতারখালি নদী। বারবার নদী ভাঙন, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের কশাঘাতে গ্রামটির মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে।

প্যাডের বদলে পুরোনো কাপড় ব্যবহার

বাংলাদেশের নারী এবং কিশোরীরা তাদের মাসিকের সময় পুরোনো কাপড়ের টুকরা ব্যবহার করেন বলে উঠে এসেছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেসলাইন রিপোর্টে।

ওই সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ৮০ শতাংশেরও বেশি নারী এবং কিশোরী মাসিকের সময় পুরোনো কাপড়ের টুকরা ব্যবহারের কথা জানিয়েছে।

উপকূলীয় এলাকায় কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, উপকূলের কিশোরীরা পুরোনো কাপড় ব্যবহারের পর তা লবণ ও নোংরা পানি দিয়ে পরিষ্কার করে। সেটাও ঠিকমতো পরিষ্কার হয় না। লজ্জায় তা বাইরে শুকানোও যায় না।

তাছাড়া তারা মাসিকের সময়েও লবণ পানিতে গোসল, নদীতে নেট জাল টানার মতো কাজ করে। যার ফলে সহজে তাদের যৌনাঙ্গে জীবাণুর আক্রমণ হয়।

চিকিৎসকরা জানান, নারীর যৌনাঙ্গে নানা রকমের ব্যাকটেরিয়ার বসবাস। নোংরা পরিবেশ না হলে ক্ষতিকরগুলো বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। মাসিকের সময়ে নোংরা কাপড় ব্যবহার, একই কাপড় বারবার ব্যবহার, লবণ পানিতে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করলে ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

সেসব ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণেই যৌনাঙ্গে ঘা-পাচড়া বা চর্মজাতীয় রোগ হয়। এতে যৌনাঙ্গের ভেতরেও ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে, যা মাসিকের সময়ে কিশোরীদের পেটে ও যৌনাঙ্গে তীব্র ব্যথার সৃষ্টি করে।

নদীর লবণাক্ত পানিতে মাছ ধরে চলে অনেকের জীবিকা। ছবি: নিউজবাংলা

যৌনাঙ্গে ঘায়ের ‘সমাধান’ বিয়ে

গ্রামটির পশ্চিমপাড়া এলাকার একটি মেয়ে পড়ত স্থানীয় নলিয়ান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তাকে বিয়ে দেয়া হয়।

মেয়েটি বলে, ‘তখন আমার বয়স ছিল ১৪ বছর। বিয়েতে রাজি ছিলাম না। তবে পরিবারের চাপে করতে হয়েছে। এক বছরের মধ্যেই আমার ছেলেসন্তান হয়। আমি যাদের সঙ্গে লেখাপড়া করতাম, তাদের মধ্যে অনেকের পঞ্চম বা যষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়েই বিয়ে হয়ে যায়।

বিয়ের আগে লেখাপড়ার পাশাপাশি নদীতে নেটজাল টেনে বাগদা ও গলদার রেণু আহরণ করতাম আমি। মাসিকের সময়েও অনেক দিন নদীতে নেমে জাল টানতাম।

প্রথম দিকে মাসিকের ব্যাপারে সচেতন ছিলাম না। একপর্যায়ে আমার যৌনাঙ্গে ঘা হয়ে যায়। তখন মাসিকের সময়ে অনেক কষ্ট হতো। এতেই আমার বিয়ে নিয়ে মা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বাবার সঙ্গে আলোচনা করেন বিয়ে দেয়ার জন্য।

‘মা আমাকে বোঝায়, এখনই বিয়ে না হলে ভবিষ্যতে রোগ বাড়তে পারে, এমনকি আমার জরায়ুও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই আমি বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম।’

একই গ্রামের আরেক কিশোরীর বিয়ে হয়েছে ১২ বছর বয়সে। সে কখনও নদীতে নেমে জাল টানেনি। তবে তার যৌনাঙ্গেও ঘা হয়েছিল। মাসিকের সময়ে পেটে ও যৌনাঙ্গের ব্যথা বেড়ে যেত।

মেয়েটি বলে, ‘তখন মাসিকের সময়ে আমার পরিত্যক্ত কাপড় ব্যবহার করতে হতো। একই কাপড় বারবার নদীর পানি দিয়ে ধুয়ে আবারও ব্যবহার করতাম। লজ্জায় পরিবারের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম না। তবে যৌনাঙ্গে ঘা হলে মাকে বিষয়টি জানিয়েছিলাম। তারপর পরিবার আমার বিয়ে দিতে আর দেরি করেনি।’

কালাবগি এলাকায় ৭ বছর ধরে পরিবার পরিকল্পনা কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন অনিমা রায়। তার জন্মও ওই গ্রামে। তিনি বলেন, ‘বয়সন্ধিকালে এখানের কিশোরীরা বেশ উদাসীন থাকে। মাসিকের সময়ে অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করে। আর একই কাপড় ময়লা ও লবণাক্ত পানি দিয়ে ধুয়ে বারবার ব্যবহার করে। এতে তাদের যৌনাঙ্গে ঘা-পাচড়া জাতীয় রোগ বেশি হয়।

‘সেখানে স্যানিটারি ন্যাপকিন দোকান বা ফার্মেসিতে কিনতেও পাওয়া যায় না। আবার মাসিকের সময়ে মেয়েশিশুদের আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার দরকার হয়। বাড়তি পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হয়। তাদের অভিভাবকদের এ বিষয়ে কোনো খেয়াল নেই। তাদের সমাধান হলো মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়া।’

তিনি বলেন, ‘আমার প্রাথমিকের সমাপনীর পর সাত কিলোমিটার দূরে নলিয়ানের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়েছি। তবে সেই সময়ে আমার সহপাঠীরা কেউই ওই গ্রাম থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যায়নি। সবার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। এখন সেই পরিস্থিতির কিছুটা কমেছে, তবে অধিকাংশেরই বাল্যবিয়ে হচ্ছে।’

ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি ৩৫, দশমে ছাত্রী ২০, তাদেরও অনেকে বিবাহিত

বাল্যবিয়ের ফলে উপকূলের স্কুলগুলোতে ছাত্রীদের উপস্থিতি কম। নলিয়ান ম্যধ্যমিক বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ছে ২০ জন। অথচ স্কুলটিতে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয় ৩৫ জন। চার বছরের মধ্যে লেখাপড়ার থেকে ঝরে গেছে ১৫ জন।

এই ২০ জন ছাত্রীর কেউ কেউ বিবাহিত বলে জানান বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোতাহার হোসেন।

তিনি বলেন, ‘মেয়েশিশুদের শিক্ষায় রাখতে আমাদের এক রকম যুদ্ধ করতে হয়। একটু বড় হলেই অভিভাবকরা তাদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। প্রতি বছরই ২০ থেকে ৩০ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। অনেকের বিয়ে হয়ে গেলেও আমরা তাদের বাড়িতে গিয়ে বুঝিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করি। কেউ কেউ আমাদের অনুরোধ রাখে, তবে অধিকাংশই রাখে না।’

স্থানীয় সুতারখালী ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের মহিলা সদস্য জাহিদা বেগম বলেন, ‘কয়েক দিন আগে আমি ১১ বছরের একটি মেয়ের বিয়ে ঠেকিয়েছি। প্রতি বছর এভাবে প্রায় ১০টি বিয়ে আমি আটকে দিই। তবে অধিকাংশ সময়ে তারা কোনো আয়োজন করে বিয়ে করে না। তাই আমরা জানতে পারি না।’

তিনি বলেন, ‘অনেক সময় অনেক অভিভাবক আমার কাছে অনুরোধ করেন, জন্ম নিবন্ধন সংশোধন করে মেয়ের বয়স বাড়িয়ে দিতে। তারা রেজিস্ট্রি করে মেয়েদের বিয়ে দিতে চান। তবে আমরা সেটা করি না।’

কিশোরীদের বিয়ে দিতে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় কাজিদের দিয়ে নিবন্ধন করা হচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিয়ের ৫ থেকে ৭ বছর পর বয়স বাড়লে নিবন্ধন করা হয়।

উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা সুরাইয়া সিদ্দীকা বলেন, ‘প্রত্যন্ত ওই এলাকাটি আমাদের উপজেলা সদর থেকে অনেক দূরে। অধিকাংশ সময়ে বাল্যবিয়ের ঘটনাটি আমরা কিছুই জানতে পারি না। তাই সেখানে বাল্যবিয়ে আমরা এখনও কমাতে পারিনি।’

এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে উঠছে অনেকে। ছবি: নিউজবাংলা

‘পেট চলে না, প্যাড কিনব কীভাবে’

কম বয়সে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেয়ার বিষয়ে এক কিশোরীর মা বলেন, ‘আমাদের এলাকার মানুষের আয়-রোজগার নদীর পানির ওপর নির্ভারশীল, যা রোজগার হয় তা দিয়ে পেটে চলে না। তাই মেয়েদের মাসিকের সময়ে প্যাড কেনার মতো টাকা আমাদের কাছে থাকে না। তাই পুরোনো কাপড় ব্যবহার করতে হয়।’

মেয়েকে বাল্যবিয়ে দেয়ার পেছনে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘মেয়েকে তো একদিন বিয়ে দিতে হবে, তাকে রোগব্যাধির যন্ত্রণা দিয়ে বিয়ে দিব কেন? বরং বিয়ে হলে নিজের গোপনাঙ্গ নিয়ে মেয়েরা বেশ সতর্ক হয়। রোগব্যাধি হয় না।’

বিনা মূল্যে প্যাড বিতরণের পরামর্শ

উপকূলীয় এলাকায় মেয়েশিশুদের বাল্যবিয়ে রোধ করতে হলে সরকারকে ভর্তুর্কি দিয়ে স্বাস্থ্য সরঞ্জাম দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কোস্টাল ভয়েজ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক কৌশিক দে বাপ্পী।

তিনি বলেন, ‘কালাবগি এলাকার মানুষের যে আয় হয় তা দিয়ে তারা ঠিকমতো খেতেও পারে না। মাসিকের সময়ে মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন দরকার হয়। ১০ পিসের এক প্যাকেটের দাম ১৩০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা। একজন কিশোরীর মাসিক চলাকালে ৩ থেকে ৪ প্যাকেটও দরকার হয়। কিন্তু পরিবারের সে রকম আয় নেই।

‘সরকারের উচিত সেখানের মেয়েশিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য বিনা মূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ করা। একই সঙ্গে বাল্যবিয়ে রোধে ওই এলাকার মা ও কিশোরীদের সচেতনতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।’

বাল্যবিয়ের স্বাস্থ্যঝুঁকি

খুলনা সিভিল সার্জন সুজাত আহমেদ বলেন, ‘বাল্যবিয়ে মেয়েদের স্বাস্থ্য ও জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। অল্প বয়সে বিয়ে হলে তাদের যৌন সংক্রমিত রোগের আশঙ্কা আরও বেড়ে যায়। এমনকি গর্ভধারণ ও সন্তান ধারণের জটিলতা মৃত্যুও হতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘লবণাক্ততার প্রভাবে উপকূলের কিশোরীদের যেসব রোগ হচ্ছে, তার সমাধান বিয়েতে হতে তো পারেই না। এতে ওই কিশোরীর জীবন আরও ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে।’

এ বিভাগের আরো খবর