১০ বছর আগে আজকের দিনে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে একটি বাসে এক তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ এবং নির্মমভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছিল। গুরুতর আহত তরুণী এর কয়েক দিন পর মারা যান।
ভারতীয় আইনে ধর্ষণের শিকারদের নাম উল্লেখ করা হয় না। এ কারণে মেয়েটি যখন হাসপাতালের বিছানায় জীবনের জন্য যুদ্ধ করছিল, তখন সংবাদমাধ্যম মেয়েটির নাম দেয় ‘নির্ভয়া’- মানে অকুতোভয়।
আলোচিত ঘটনাটি ভারতের পাশাপাশি গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। দেশজুড়ে প্রবল বিক্ষোভের মুখে নারী নির্যাতনের আইন কঠোর করতে বাধ্য হয় ভারত সরকার।
মামলার প্রধান আসামি ছিলেন ওই বাসের চালক। তবে ঘটনার কয়েক মাস পর জেলে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এ মামলায় ২০২০ সালের মার্চ মাসে আরও চারজনকে ফাঁসি দেয়া হয়; অপ্রাপ্ত থাকায় একজনকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত।
অপরাধটি ভারতে লিঙ্গ সহিংসতাকে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে আসে। ঘটনাটি নির্ভয়ার মা আশা দেবীর জীবনে বড় পরিবর্তন এনেছিল।
আশা দেবীর জীবনের বড় একটা অংশ কেটেছে একজন ‘আদর্শ’ গৃহবধূ হয়ে। রান্না আর সন্তানদের দেখভাল ছিল তার জীবনের মূল লক্ষ্য। গত এক দশকে এই আশা দেবী হয়ে উঠেছেন একজন নারী অধিকারকর্মী। শুরুতে নিজের মেয়ের জন্য... এখন পুরো ভারতের মেয়েদের ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করছেন তিনি।
আশা দেবীর বেদনাকাতর চেহারা প্রায়ই টিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ত, যা অনেক ভারতীয়কে নাড়া দেয়
দুই বছর আগে ২০২০ সালে মেয়ের ওপর হামলার অষ্টম বার্ষিকীতে ধর্ষণের শিকার সব নারীর ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করার অঙ্গীকার করেছিলেন আশা। ঘটনার কয়েক মাস পর ফাঁসিতে ঝুলানো হয় অপরাধীদের।
তিনি বলেছিলেন, ‘এভাবেই আমি আমার মেয়ের প্রতি সম্মান জানাতে পারব।’
৫৬ বছরের আশা দেবীর একটি পা বিকল। প্রতিদিনই তাকে ছুটতে হয় ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে। এ অবস্থা নিয়ে পাঁচ সপ্তাহ ধরে প্রতি সন্ধ্যায় তিনি দিল্লির দ্বারকা জেলায় একটি মোমবাতি প্রজ্বলন সমাবেশে অংশ নিচ্ছেন।
তারা ১৯ বছর বয়সী এক তরুণীর জন্য ন্যায়বিচার দাবি করছেন; যাকে ১০ বছর আগে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর খুন করা হয়েছিল। এই অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামিকে সম্প্রতি ভারতের শীর্ষ আদালত মুক্ত করে দিয়েছে। আদালত জানায়, আসামিরা যে দোষী তার কোনো প্রমাণ নেই। যদিও শীর্ষ আদালতে একটি রিভিউ পিটিশন দাখিল করা হয়েছে, তার পরও ‘ছাওলা ধর্ষণ’ মামলাটি কেউ যেন ভুলে না যায়, সেটি নিশ্চিতের জন্য আরও অনেকের সঙ্গে আশা দেবী প্রতিবাদ করছেন।
আশা দেবী বলেন, ‘কোনো দিন ১০ আবার কোনো দিন ১৫ জন হয় মিছিলে। এভাবেই আমরা প্রতিদিন প্রতিবাদ করি।
‘আমরা চাই আদালতের আদেশ প্রত্যাহার করা হোক। তাদের (কথিত ধর্ষকদের) আবার জেলে যেতে হবে।’
আসামিদের ছেড়ে দেয়ার পরদিন আশা দেবী নির্যাতিতার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি ন্যায়বিচার পেয়েছি। আমার তো এখন চুপ থাকার কথা ছিল। কিন্তু আমি তা পারিনি। আমার কেবল মনে হতো কীভাবে কোর্টরুমের বাইরে বসে কাঁদতাম, মাঝে মাঝে ভীষণ একা লাগত। সে জন্য আমি তার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করি এবং তাদের সঙ্গে বসে কাঁদি।’
গুজরাটের আরেকটি আলোচিত ধর্ষণ ঘটনা ছিল বিলকিস বানুর মামলাটি। অভিযুক্তরা বিলকিস বানুর পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে হত্যাও করেছিল। তবে অভিযুক্ত ১১ জনকে খালাস করে দেয় রাজ্য সরকার। এই বিলকিস বানুর প্রতি ন্যায়বিচারের আহ্বান জানিয়ে একটি অনলাইন পিটিশনে সম্প্রতি আশা দেবী তার সমর্থন দেন।
ধর্ষিতাদের পাশে দাঁড়ানো এবং পারিবারিক সহিংসতার শিকারদের পরামর্শ দিতে আশা দেবী তার মেয়ের নামে একটি ট্রাস্ট গড়ে তুলেছেন। এতে আছেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ কর্মকর্তা এবং অনেক স্বেচ্ছাসেবক। গত কয়েক বছরে তারা কয়েক ডজন পরিবারের সঙ্গে কাজ করেছে।
আশা দেবী এখন বেশ প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার উপস্থিতি প্রায় পুলিশ এবং কর্তৃপক্ষকে তৎপর হতে উদ্বুদ্ধ করে। তবে আশা দেবী জানান, তার মেয়ে মারা যাওয়ার ১০ বছর কেটে গেলেও ভারতের মাটিতে কিছুই বদলায়নি।
নির্ভয়ার ওপর হামলা হয় ২০১২ সালে। সে বছর ভারতে ২৪ হাজার ৯২৩টি ধর্ষণের মামলা রেকর্ড করা হয়েছিল। ২০২০ সালে সংখ্যাটি ৩ হাজার ৬৭৭-এ দাঁড়িয়েছে।
আশা দেবী বলেন, ‘কাগজে আইন তৈরি হয়, প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়। তবে তার বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে।
‘এমনটা চলতে থাকলে ন্যায়বিচারের প্রতি আমাদের বিশ্বাস উঠে যাবে।’
নির্ভয়ার ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ হয়
আশা দেবীর এমন তৎপর হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে তার নিজের অভিজ্ঞতা, ন্যায়বিচারের জন্য তার দীর্ঘ লড়াই। ১০ বছর আগের স্মৃতি এখনও তার চোখে পানি আনে।
তিনি বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বরের মতো দিন আর কাউকে যেন দেখতে না হয়।’
নির্ভয়ার বয়স ছিল কেবল ২৩। সবে ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে প্রশিক্ষণ শেষ করছিল; একটি হাসপাতালে ইন্টার্নশিপের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল।
ছলছল চোখে নির্ভয়ার মা বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে একটি আইডি কার্ড পেয়েছিল। দু-এক দিনের মধ্যে এ কাজে যোগ দিত।’
নির্ভয়ার ওপর নৃশংসতার দিনটি ছিল রোববার। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় সে মাকে বলেছিল, ২-৩ ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসবে।
কয়েক ঘণ্টা পর আশা দেবী মেয়েকে হাসপাতালে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পান। সে সময় একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে আশা বলেছিলেন, ‘মনে হচ্ছিল যেন তাকে জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ডাক্তার বলেছিলেন, কীভাবে কী করবেন তারা সেটাই বুঝে উঠতে পারছেন না।
নির্ভয়াকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করেন বাসচালকসহ আরও পাঁচজন। এ সময় নির্ভয়ার পাশে ছিল তার বয়ফ্রেন্ড। তাকেও চরম মারধর করা হয়েছিল। নগ্ন ও রক্তাক্ত যুগলকে তারা রাস্তার ধারে ফেলে দিয়েছিল। কয়েকজন পথচারী তাদের পেয়ে পুলিশ ডাকে। পরে তাদের হাসপাতালে নেয়া হয়।
আশা দেবী বলেন, ‘আমার মেয়ের সঙ্গে যা ঘটেছিল তা এতটাই নৃশংস ছিল যে সে মরে গিয়ে যেন বেঁচে গেছে। তার পরও সে ১২ দিন বেঁচে ছিল। সবাই তার নাম রেখেছিল নির্ভয়া। সে সত্যিই সাহসী ছিল।’
চোখের পানি মুছতে মুছতে আশা বলেন, ‘হাসপাতালে সে পানির জন্য ছটফট করত। কিন্তু আমরা তাকে এক চামচ পানিও দিতে পারিনি।
‘কেবল মনে হতো কী দোষ ছিল আমার মেয়ের? কেন তাকে এত যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু হলো? আমি তাকে তীব্র যন্ত্রণা পেতে দেখেছি। সেই যন্ত্রণা থেকেই আমি শক্তি সঞ্চার করেছি। তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে আমি তার ন্যায়বিচারের জন্য লড়ব।’
বিচার শুরুর পর থেকে প্রতিদিনই আশা দেবীকে আদালতে দেখা যেত। তিনি বলেন, ‘একটি শুনানিও মিস করিনি। বাড়িঘর তখন ছেড়েই দিয়েছিলাম।’
লড়াই না ছাড়ার সংকল্পের কথা জানাচ্ছেন আশা দেবী
এসব সত্ত্বেও মামলাটি শেষ হতে এবং ধর্ষকদের ফাঁসিতে ঝুলতে ৭ বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল।
আশা দেবী বলেন, ‘সংকল্প নিয়েছিলাম, যাই হোক হাল ছাড়ব না।’
উত্তর প্রদেশের একটি পিছিয়ে পড়া জেলায় বেড়ে ওঠেন আশা দেবী। হাই স্কুলটি বাড়ি থেকে অনেক দূরে থাকায় অষ্টম শ্রেণির পর স্কুল ছেড়ে দিতে হয়েছিল তাকে। আইনের ভাষা বোঝার জন্য তাই আশাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল।
সংবাদ সম্মেলনে প্রায়ই আসতে হতো আশাকে। টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যেত তাকে। আশার এমন অদম্য শক্তি দেখে অনেক ভারতীয় অনুপ্রেরণা পেয়েছিল। আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী, সেলিব্রিটি এবং রাজনীতিবিদরা একসময় তার পাশে দাঁড়ান। এ সময়ের মধ্যে ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের মৃত্যুদণ্ড দিলে আসামিদের পরিবার এবং তাদের আইনজীবীরা রিভিউ পিটিশন দাখিল করে এবং শেষ মুহূর্তে সরকারের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চায়।
ফাঁসি স্থগিত করার জন্য দোষীদের পরিবার অনেক চেষ্টা করেছিল
অধিকারকর্মীরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে গবেষণায় দেখা গেছে মৃত্যুদণ্ড আদতে অপরাধ কমায় না। এটির ফলে আরও বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটে। কারণ অপরাধীরা প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টা করে।
তবে আশা দেবী মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে একজন জোরালো সমর্থক। জোর গলায় তিনি বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ড হচ্ছে উচিত বিচার।
‘কিছু মানুষ আছে যারা অভিযুক্তদের মানবাধিকারের কথা বলে। কিন্তু যে মেয়েটিকে ধর্ষণ এবং নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, তার মানবাধিকারের কথা কে বলে? মানুষের মধ্যে ভয় না কাজ করলে কিছুই বদলাবে না।’