সরকারি ও বেসরকারি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নীতিমালা প্রণয়ন ও কমিটি গঠনে ২০০৯ সালে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। তবে অনেক প্রতিষ্ঠানে এখনও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও কিছু প্রতিষ্ঠান অবশ্য হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ধরনের ছয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা শোনালেন নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা।
রাজধানীর দ্য ডেইলি স্টার ভবনের আজিমুর রহমান কনফারেন্স কক্ষে মঙ্গলবার ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালা: প্রয়োগ ও প্রতিবন্ধকতা’ শীর্ষক এক আলোচনায় তারা অংশ নেন। আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের আয়োজনে গোলটেবিলে সহযোগিতায় ছিল ইউএন ওমেন বাংলাদেশ।
অনুষ্ঠানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ, কুমিল্লার সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজ, পটুয়াখালী সরকারি কলেজ ও বগুড়া পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের শিক্ষকেরা যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নীতিমালা করার পর পরিস্থিতির উন্নতির কথা তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পের আওতায় এই ছয়টি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সহায়তা দিচ্ছে আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট এবং ইউএন ওমেন।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আমেনা বেগম বলেন, শিক্ষার্থীরা এখন যৌন হয়রানির বিষয়ে আওয়াজ তুলছেন। আমাদের প্রতিষ্ঠানের ইন্টারমিডিয়েট শাখাটি শহরের বাইরে হলেও সেখানে অনেক নিরাপদে আছেন ছাত্রীরা। কিছু বছর আগেও এ বিষয়ে (হাইকোর্টের নিতিমালা) আমরা জানতাম না। ছাত্রছাত্রীরাও জানতেন না। এখন জানতে পারছি।’
আলোচনায় উঠে আসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি ও নীতিমালা থাকলেও অনেক সময় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের হস্তক্ষেপে আপস করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সুজন কান্তি মালী বলেন, ‘২০১৯ সালে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল প্রতিযোগিতায় রানারআপ হয়েছিল। এটা আমাদের জন্য গর্বের। আমাদের মেয়েদের এখন আমরা জার্সি পরিয়ে মাঠে নামাচ্ছি। একটা সময়ে প্রচুর স্লেজিং করত। বাইরে থেকে লোকজন এসে খারাপ কথা বলত।
‘কোনো কোনো অভিযোগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব সামনে চলে আসে। সে সময় দেখা যায় অনেক কিছু করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ ধরনের বিচারহীনতার জায়গা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক সভাপতি ও যৌন নির্যাতন-সংক্রান্ত অভিযোগ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. জেবউননেছা বলেন, ‘২০১০ সালে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ-সংক্রান্ত কমিটি করা হয়।
‘আমাদের নিজস্ব মেইল আছে যেখানে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ জানাতে পারেন। আমাদের একটা নিজস্ব অফিস রয়েছে। আমরাই সারা দেশে প্রথম, যাদের আগামী বছরের ৪ জানুয়ারি স্থায়ীভাবে চার কক্ষের অফিস দেয়া হবে। শিগগিরই আমাদের একটি ওয়েবসাইটও তৈরি হচ্ছে।’
কমব্যাটিং জেন্ডারবেজড ভায়োলেন্স ইন বাংলাদেশ (সিজিবিভি) নামের প্রকল্প নিয়েও গোলটেবিলে কথা বলেন আয়োজকেরা।
আমরাই পারি-এর প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক বলেন, ‘যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে কমিটি করার দায়িত্ব মূলত প্রতিষ্ঠান ও সরকারের। এ ক্ষেত্রে আমরা সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্নভাবে তাদের সহযোগিতার চেষ্টা করি।
‘আজকাল আমাদের যৌন হয়রানির বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে লজ্জা লাগে না। অথচ আমরা যখন ১৯৯৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন করেছি তখন এটা নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। যৌন হয়রানি একটি অপরাধ এবং এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের জানতে হবে, তাদের প্রশ্ন করতে হবে।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী ও শিশুসংগঠক অধ্যাপক মাহফুজা খানম বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্র কী চায়? সরকার কী চায়- সেটি অনেক গুরত্বপূর্ণ।
‘মহান মুক্তিযুদ্ধে যাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা এই রাষ্ট্র পেয়েছি তাদের কাছে এই প্রজন্মের দায়বদ্ধতা রয়েছে। প্রতিবন্ধকতা অনেক থাকবে, কিন্তু এর মধ্যেও শিক্ষকেরা তাদের দায়িত্ব পালন করলে আমরা ভালো কিছু পাব।’