রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামের বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘বেগম রোকেয়ার আতুরঘরে এই গ্রাম। এখানে তার জন্ম ও মৃত্যু দিনে অনেক কর্মসূচি পালন হয়। কিন্তু তিনি শুয়ে আছেন বিদেশ-বিভুঁই।’
দেশের নারী মুক্তির পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেনের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে রংপুরের পায়রাবন্দে। এখানে তার নামে এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অথচ তার মরদেহ পড়ে আছে সীমান্তের ওপারে সোদপুরের পানিহাটি নামে এক অখ্যাত গ্রামে।
১৬ বছর পর্যন্ত বেগম রোকেয়ার কেটেছে রংপুরের পায়রাবন্দে। বিয়ের পর কলকাতা ও ভাগলপুরে তার কর্মজীবন কেটেছে।
মৃত্যুর পর বেগম রোকেয়াকে কলকাতা থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে গঙ্গা নদীর তীরবর্তী পানিহাটি গ্রামে দাফন করা হয়। তখন তাকে কলকাতায় দাফনে বাধা দিয়েছিল সেখানকার রক্ষণশীল মুসলিম সমাজ। কারণ তিনি মেয়েদের পর্দা প্রথার বিরোধিতা করেছিলেন। নারী শিক্ষার পক্ষে কথা বলেছেন।
শেষ পর্যন্ত বেগম রোকেয়াকে স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের বন্ধু ব্যারিস্টার আব্দুর রহমানের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এতে সহযোগিতা করেছিলেন পানিহাটির তৎকালীন পৌরপ্রধান সুনিল পাল।
বেগম রোকেয়া আক্ষেপ করে লিখেছেন: ‘আমি কারসিয়ং ও মধুপুর বেড়াইতে গিয়া সুন্দর সুদর্শন পাথর কুড়াইয়াছি। ওড়িশা ও মাদ্রাজে সাগরতীরে বেড়াইতে গিয়া বিচিত্র বর্ণের বিবিধ আকারের ঝিনুক কুড়াইয়া আনিয়াছি। আর জীবনে ২৫ বছর ধরিয়া সমাজসেবা করিয়া কাঠ মোল্লাদের অভিসম্পাত কুড়াইয়াছি।’
১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দে জমিদার জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার এবং রাহেতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরাণীর কোল আলোকিত করে জন্ম নেন এই মহীয়সী নারী।
রোকেয়া বিশেষজ্ঞরা জানান, বেগম রোকেয়ার শৈশবে মুসলিম সমাজ কঠোর পর্দাপ্রথার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। তখনকার সময়ে বাড়িতে ছেলেদের লেখাপড়াকে গুরুত্ব দেয়া হতো। ছেলেরা পাঠশালায় যাওয়ার সুযোগ পেলেও মেয়েরা তা থেকে বঞ্চিত হতো। কিন্তু বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের রোকেয়াকে পড়াতেন চুপিসারে। দিনের আলোয় যখন জ্ঞানচর্চা নিষিদ্ধ, তখন তিনি রাতের আঁধারেই বোনকে পড়িয়েছেন।
কলকাতায় যেভাবে গেলেন রোকেয়া
১৮৯৬ সালে ১৬ বছরের কৈশোরে পা দেন রোকেয়া। এই বয়সে বিয়ের জন্য বাড়িতে আসতে শুরু করে পাত্র । কিন্তু বড় ভাই ইব্রাহিম চেয়েছিলেন রোকেয়ার পড়ালেখা যেন বন্ধ না হয়। অনেক খুঁজে ২২ বছরের বড় বিপত্নীক ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তার বিয়ে দেন। সাখাওয়াত হোসেনের আগের স্ত্রীর এক কন্যাসন্তানও ছিল। বিয়ের পর জীবনের অধিকাংশ সময় বিহার ও পশ্চিম বাংলার কলকাতায় কেটেছে রোকেয়ার।
সাহিত্য জগতে প্রবেশ
ভাইদের কাছ থেকে রোকেয়া বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি ও আরবি আয়ত্ত করলেও আসল শিক্ষা শুরু হয়েছিল স্বামীর কাছে। ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামক একটি বাংলা গদ্য রচনার মধ্য দিয়ে সাহিত্যজীবনে পা রাখেন তিনি। এরপর ১৯০৫ সালে সুলতানাস ড্রিম নামক একটি ইংরেজি গ্রন্থ বের করেন।
১৯০৯ সালের ৩ মে স্বামী সাখাওয়াত হোসেন মারা যান। এর পাঁচ মাস পর ১ অক্টোবর ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’-এর যাত্রা শুরু করলেও রোকেয়ার সৎ-মেয়ে ও মেয়ে জামাতা তাকে বেশিদিন ভাগলপুরে টিকতে দেননি।
১৯১০ সালে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা হলে স্কুল বন্ধ করে দিয়ে তিনি কলকাতায় চলে যান। সেখানে মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে ১৯১১ সালের ১৫ মার্চ সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল চালু করলেও চার বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪-তে। ১৯৩০ সালের মধ্যে ওই স্কুলটিকে হাই স্কুলে উন্নীত করেন তিনি।
১৯৩০ সালের দিকে রোকেয়া নানা রোগে আক্রান্ত হলেও ১৯৩১ সালে ‘অবরোধবাসিনী’ রচনা করেন। ১৯৩২ সালের ৮ ডিসেম্বর লেখালেখি শেষে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৯ ডিসেম্বর তিনি মারা যান।
কবর কেন সোদপুরে
রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সরিফা সালোয়া ডিনা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রোকেয়ার সময় একটা রক্ষণশীল সমাজ ছিল। তৎকালীন বুদ্ধিজীবী মহল ছাড়া রোকেয়ার উদারনৈতিক, সংস্কারবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সবাই একমত ছিলেন না বলেই তাকে নিরলসভাবে সংগ্রাম করতে হয়েছিল। এ কারণে তার মৃত্যুর পর কলকাতার তৎকালীন রক্ষণশীল মুসলিম সমাজ তাকে সেখানে সমাহিত করার পক্ষপাতি ছিল না। তাদের ধারণা ছিল, রোকেয়া ধর্মদ্রোহিণী ছাড়া কিছুই নন। মুসলিম নারীদের তিনি পাপের পথে চলতে উৎসাহ দেন।’
তিনি বলেন, ‘কলকাতায় জানাজা শেষে আব্দুর রহমান খান নামের এক ব্যক্তির সহযোগিতায় রোকেয়ার মরদেহ ট্রাকে করে সোদপুরে নিয়ে সমাহিত করা হয়েছিল।
‘আমি মনে করি, রোকেয়ার মরদেহ বা দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। তবে তার থেকে অনেক বেশি জরুরি রোকেয়ার চেতনাকে ধারণ করা।’
রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও ডিন ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘সোদপুরের পানিহাটিতে তার কবরটি বহু বছর ছিল সবার অজানা। অনেকটা অবহেলিত অবস্থায়ই ছিল কবরটি।
‘পশ্চিমবঙ্গের স্পিকার মনসুর হবিবুল্লাহ নব্বইয়ের দশকে উদ্যোগী হন রোকেয়ার কবর সঠিকভাবে শনাক্ত করতে। সে সময়ে পানিহাটি পৌরসভার পুরোনো নথিপত্র ঘেঁটে রোকেয়াকে সমাহিত করার স্থানটির সন্ধান মেলে। ১৯৯৭ সালের ৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর রোকেয়ার কবরে উন্মোচন করেন একটি স্মৃতিফলক।’
মরদেহ ফিরিয়ে আনার দাবি
২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দ কলেজ মাঠে ‘রোকেয়া মেলা’-র আলোচনা সভায় তার ভাইয়ের মেয়ে রনজিনা সাবের দাবি তোলেন বেগম রোকেয়ার দেহাবশেষ কলকাতা থেকে ফিরিয়ে আনার।
ওই সময় মঞ্চে থাকা রংপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক বি এম এনামুল হক সেই দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেন। উদ্যোগও নেন। এরপর থেকে বিভিন্ন সংগঠনও সেই দাবি বাস্তবায়নে আন্দোলন করে।
রংপুর জেলা প্রশাসন থেকে জানা যায়, ২০১০ সালে বেগম রোকেয়ার দেহাবশেষ আনা নিয়ে তার পরিবার ও স্থানীয়দের বিভিন্ন দাবিসংবলিত একটি লিখিত আবেদন সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠান জেলা প্রশাসক বি এম এনামুল হক।
কিন্তু এ নিয়ে প্রতি বছর আলোচনা হলেও দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনতে কাগজে-কলমে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
উপজেলা চেয়ারম্যান জাকির হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বেগম রোকেয়ার দেহাবশেষ আমাদের এখানে ফিরিয়ে আনা ন্যায্য দাবি। আমি সর্বশেষ এবারের প্রস্তুতি সভায় বিষয়টি ডিসি মহোদয়কে বলেছি। আমরা রংপুরের মানুষ চাই বেগম রোকেয়ার দেহাবশেষ দেশে ফিরে আনা হোক।’
রনজিনা সাবের বলেন, ‘আমরা হতাশ-ক্ষুব্ধ। রোকেয়ার সব কিছুই আছে পায়রাবন্দে। আমি ডিসি এনামুল স্যারকে অনুরোধ করে বললাম, রোকেয়ার দেহাবশেষ কলকাতা থেকে পায়রাবন্দে আনার জন্য। তিনি আগ্রহ দেখিয়েছেন। তিনি ঢাকায় আবেদন পাঠিয়েছেন বলে আমরা শুনেছি।
‘এরপর তার বদলি হয়। অনেক খোঁজ নিয়েছি, অনেকবার বলেছি, অনেকবার। খোঁজ নিলেই বলে, প্রক্রিয়াধীন আছে। পরে কী হইল, তাও জানি না। বছর বছর ডিসেম্বর আসে, আর আলোচনা হয়, কিন্তু কাজ হয় না।’
রংপুর জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি সবশেষ যেটা জানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আমাদের কাছ থেকে যতটুকু করার ছিল আমরা করেছি। চিঠিও দেয়া হয়েছে। এখন দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হলে আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে পারব।’