রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী রাখার বাধ্যবাধকতা রেখে বিধান করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। দুই বছর পার হলেও এ বিধান প্রতিপালনের চিত্র নেই প্রধান তিন দলসহ দেশের কোনো রাজনৈতিক সংগঠনেই।
দেশের তিন প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ বা দ্বিতীয় শীর্ষ পদে আছেন নারীরা। আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আর জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ।
জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী; সংসদ উপনেতাও ছিলেন নারী। বিরোধীদলীয় নেতাও রওশন এরশাদ। এমনকি আওয়ামী লীগের ১৯ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলীতে শেখ হাসিনাসহ নারী আছেন চারজন। তারপরও দেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের চিত্রে ইসির বিধানের প্রতিফলন নেই।
সার্বিক বিচারে দলগুলোর কমিটিতে নারীর সংখ্যা ইসির বেঁধে দেয়া হারের চেয়ে অনেক কম।
রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী রাখার বিধান প্রতিপালনের সময়সীমা পার হয়ে গেছে দুই বছর আগেই, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলই এখন পর্যন্ত এ শর্ত পূরণ করতে পারেনি।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ২০০৯ (আরপিও) (সংশোধিত)-এর ৯০ বি ধারা অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব কমিটিতে নারীদের জন্য কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ পদ নিশ্চিত করতে হবে। নিবন্ধিত সব দলই সে সময় ইসিকে জানিয়েছিল, ২০২০ সালের মধ্যে তারা কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী রাখার বিধান পূর্ণ করতে পারবেন। সে অনুযায়ী দলগুলো উদ্যোগীও হয়। বাস্তবে কোনো দলই ইসির এই বিধান পূরণ করতে পারেনি।
উদ্ভূত বাস্তবতায় বিধানটি প্রতিপালন ইস্যুতে ইসিও অনেকটা শিথিল অবস্থানে। ইসি বলছে, ২০৩০ সাল নাগাদ হয়তো এটা সম্ভব হবে। সে জন্য ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়াতে আরপিও সংশোধনের লক্ষ্যে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে, যা আইন মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
সংগঠনের বিভিন্ন কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে সবার চেয়ে এগিয়ে আছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির একুশতম জাতীয় সম্মেলনে গঠিত ৮১ সদস্যবিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটির বিভিন্ন পদে ১৯ জন নারী প্রতিনিধি রয়েছেন। এই সংখ্যা প্রায় ২৩ শতাংশ।
আওয়ামী লীগের এর আগের কমিটিতে নারী প্রতিনিধিত্বের হার ছিল ১৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এর আগে ১৯তম কাউন্সিলের পর গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারী ছিলেন ১০ জন, যা ১৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ২০১৯ সালে দলের ২১তম জাতীয় সম্মেলনে বলেছিলেন, ৩৩ শতাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে তার দল কাজ করছে।
দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ২০২১ সালের ৮ অক্টোবর মহিলা লীগের এক অনুষ্ঠানে জানান, সংগঠনের কমিটিতে বর্তমানে যতসংখ্যক নারী আছেন, সেটি বাড়িয়ে দেড় গুণ করতে চান তারা। আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) অনুযায়ী নেতৃত্বে নারীদের ৩৩ ভাগ প্রতিনিধিত্ব থাকার কথা, কিন্তু এখন আছে ২২ ভাগ। এ লক্ষ্য পূরণে সবাইকে আরও তৎপর হতে হবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘দল এ বিষয়ে কাজ করছে। প্রতি কমিটিতেই পর্যায়ক্রমে নারীর সংখ্যা বাড়ছে, তবে বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীরা রাজনীতিতে কম। যোগ্যতাসম্পন্নদের দিয়ে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্বের বিধান পূরণে আওয়ামী লীগ অবিচল।’
আরেক বড় দল বিএনপির কমিটিতে নারীর সংখ্যা সামান্য। ষষ্ঠ সম্মেলনের সাড়ে চার মাস পর ২০১৬ সালের ২৯ মার্চ সবশেষ ৫৯২ সদস্যের কমিটি ঘোষণা দেয় বিএনপি।
ঘোষিত নতুন স্থায়ী কমিটিতে ১৭ জন ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদে রয়েছেন ৭৩ জন। নির্বাহী কমিটির কর্মকর্তা ও সদস্য আছেন ৫০২ জন।
নির্বাহী কমিটিতে ৩৫ জন ভাইস চেয়ারম্যান, ৭ জন যুগ্ম মহাসচিব, ১০ জন সাংগঠনিক সম্পাদকসহ বিভিন্ন সম্পাদকীয় পদে আছেন ১৬১ জন কর্মকর্তা। বাকিরা সদস্য।
বিশাল এ কমিটিতে নারী রয়েছেন ৭১ জন। সে হিসাবে বিএনপিতে নারী নেতৃত্ব রয়েছে ১১ দশমিক ০৯ শতাংশ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির ১৯টি পদের মধ্যে আগস্ট মাসে ১৭ সদস্যের নাম ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে নারী কোটায় ছয়জনের স্থান পাওয়ার কথা থাকলেও দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া (পদাধিকারবলে) ছাড়া কোনো নারী স্থান পাননি। যদিও এর দুই বছর পর দলের ভাইস চেয়ারম্যান বেগম সেলিমা রহমানকে যুক্ত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সেলিমা রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের চেয়ারপারসন একজন নারী। শতাংশের হিসাব ঠিক বলতে পারব না, তবে জেলা পর্যায়ে আরও ১৫ শতাংশ নারী যুক্ত করার জন্য বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী কাজ চলছে।
‘সমস্যা হচ্ছে, উপজেলা পর্যায়ে নারী নেতৃত্ব অনেকে মানতে চায় না। সে নিয়ে খানিকটা ঝামেলা পোহাতে হয়, তবে আমরা ধীরগতিতে হলেও এগোচ্ছি। শিগগিরই ৩৩ শতাংশ কোটা পূরণ হয়ে যাবে।’
জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ৩০০ সদস্যবিশিষ্ট বর্তমান কমিটিতে নারী আছেন ১২ জন।
কমিটিতে নারী সদস্যের সংখ্যা এত কম কেন এবং কবে নাগাদ তা ৩৩ শতাংংশে উন্নীত হবে জানতে চাইলে দলটির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ধারাবাহিকভাবে কমিটিতে নারীর সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। দলের আগামী সম্মেলনে এ সংখ্যা আরও বাড়বে, তবে যথেষ্টসংখ্যক যোগ্য নারী রাজনীতিবিদ না পাওয়ায় কমিটিতে নারী নেতৃত্বের সংখ্যা কম রয়েছে।’
এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোতে ৩৩ শতাংশ নারী কোটা পূরণ না হওয়ার পেছনে তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘নারী নেতৃত্ব কম হওয়ার প্রধান কারণটিই হলো কলুষিত রাজনীতি। এ কারণে নারীরা রাজনীতিতে আসতে কম আগ্রহী হচ্ছেন। অন্য দুটি কারণ হলো এ দেশের সমাজব্যবস্থাও মেয়েদের রাজনীতি করাকে স্বাভাবিকভাবে নেয় না এবং রাজনৈতিক দলগুলোও ৩৩ শতাংশ নারী কোটা পূরণে আন্তরিক নয়।’