লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর অন্যতম একটি গোষ্ঠী হলেও আন্তঃলিঙ্গের মানুষেরা (ইন্টারসেক্স পারসন) দেশে নানা ধরনের বঞ্চনার শিকার। জৈবিক এই বৈচিত্র্যময়তাকে ‘রোগ’ হিসেবে বিবেচনা করে অনেককে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নারী বা পুরুষে রূপান্তরিত করা হয়। ট্রান্সজেন্ডার হিসেবেও বিবেচনা করা হয় তাদের।
এ ধরনের বৈষম্য দূর করে আন্তঃলিঙ্গ মানুষদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং স্বাভাবিক নাগরিক অধিকারের দাবি জানানো হয়েছে এক গোলটেবিল বৈঠকে।
বেসরকারি সংস্থা স্পেস- আ ফাউন্ডেশন ফর পিস অ্যান্ড কেয়ারের উদ্যোগে শনিবার সকালে রাজধানীর লালমাটিয়ায় এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথের সেমিনার কক্ষে এ গোলটেবিল বৈঠক হয়।
সাধারণভাবে আন্তঃলিঙ্গের সঙ্গে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যকে সমানভাবে বিচারের প্রবণতা রয়েছে। তবে ট্রান্সজেন্ডার বৈশিষ্ট্যের অধিকারীরা মানসিকভাবে এমন লিঙ্গ বৈশিষ্ট্য ধারণ করেন যেটি তাদের জন্মের সময় নির্ধারিত লিঙ্গ বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মেলে না। অর্থাৎ জন্মগত শারীরিক লিঙ্গ বৈশিষ্ট্য নারীর হলেও তারা মানসিকভাবে পুরুষের বৈশিষ্ট্য অথবা পুরুষের শরীরে নারীর বৈশিষ্ট্য ধারণ করেন।
বিপরীতে, একজন ইন্টারসেক্স ব্যক্তি এমন লিঙ্গ বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন যা স্পষ্টভাবে পুরুষ বা নারীর বৈশিষ্ট্য নয়। জাতিসংঘের ফ্যাক্টশিটে বলা হয়েছে, ইন্টারসেক্স ব্যক্তিদের জন্মগত যৌন বৈশিষ্ট্য (জননাঙ্গ, গোনাড এবং ক্রোমোজোম প্যাটার্ন) পুরুষ বা নারীর প্রথাগত ধারণার সঙ্গে খাপ খায় না।
স্পেস আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে জানানো হয়, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নারী বা পুরুষে রূপান্তরিত করার বিরোধিতা করে ১৯৯৬ সালের ২৬ অক্টোবর আমেরিকার বোস্টন শহরে সমাবেশ করেন আন্তঃলিঙ্গ অধিকারকর্মীরা। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৩ সাল থেকে প্রতিবছর ২৬ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী আন্তঃলিঙ্গ সচেতনতা দিবস উদ্যাপন হচ্ছে।
দিবসটি উপলক্ষে আয়োজিত গোলটেবিলে আন্তঃলিঙ্গ জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে মো. পারভেজ, নুরে আলম, পরী, মাইমুনা আক্তার তাদের বঞ্চনার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তারা জানান, দেশে একজন আন্তঃলিঙ্গীয় মানুষ ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত না হলেও তিনি ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে চিহ্নিত হন। বাংলাদেশে ট্রান্সজেন্ডাররা স্বতন্ত্র লিঙ্গ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেও আন্তঃলিঙ্গের মানুষের কোনো স্বীকৃতি নেই।
বৈঠকে মাইমুনা আক্তার জানান, সরকারি ও বেসরকারি নথিতে আন্তঃলিঙ্গীয় মানুষের স্বীকৃতি না থাকায় তিনি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছেন না, এমনকি তাকে পাসপোর্ট দেয়া হচ্ছে না।
বক্তারা জানান, আন্তঃলিঙ্গীয় মানুষদের সবচেয়ে নির্মম অভিজ্ঞতা হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই পরিবার ও সমাজের চাপে লিঙ্গ অস্ত্রোপচারের জন্য চিকিৎসকের কাছে যেতে হচ্ছে। পুরুষ বা নারীর শরীর বানাতে ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচার হচ্ছে তাদের। অনেক শিশু এতে মারাও যাচ্ছে।
গোলটেবিল বৈঠকে নুরে আলম জানান, কখনও নারী আবার কখনও পুরুষ বানাতে তাকে ছয়বার এ ধরনের অস্ত্রোপাচার করা হয়েছে। তিনি এখন স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে কিংবা গণপরিবহনে উঠতে পারেন না।
নুরে আলম বলেন, ‘লিঙ্গ পরিবর্তনের এই অস্ত্রোপচার অপ্রয়োজনীয় ছিল। এটি হওয়ার আগে আমি সুস্থ ছিলাম। শুধু ছেলে বা মেয়ে বানানোর জন্য এই অস্ত্রোপাচার করে আমার বর্তমান শারীরিক জটিলতা তৈরি করা হয়েছে।’
বৈঠকে বক্তারা জানান, শিশু হাসপাতালে প্রায়ই এ ধরনের লিঙ্গ পরিবর্তনের অস্ত্রোপাচার করা হচ্ছে, যেটি মানবাধিকার লংঘন। কিছু অস্ত্রোপচার দরকারি হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘পুরুষ’ বা ‘নারী’ বানাতে এটা করা হচ্ছে।
বৈঠকে জন্মসনদ, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ সরকারি ও বেসরকারি নথিতে আন্তঃলিঙ্গ পরিচয়ের স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি এই জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়।