পরিবার-সমাজের বাধা ঠেলে পড়াশোনায় আগ্রহী মিনার কথা নিশ্চয় মনে আছে। প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে স্কুলের পথে ছুটে যেত ছোট্ট শিশুটি।
কার্টুন চরিত্রের মিনা সুরেলা গলায় গাইত, ‘আমি বাবা মায়ের শত আদরের মেয়ে/ আমি বড় হই, সকলের ভালবাসা নিয়ে/ আমার দুচোখে অনেক স্বপ্ন থাকে/ আমি পড়ালেখা শিখতে চাই/ যদি চারদেয়ালের মাঝে কাটে সারা জীবন/ তাহলে থাকব, শুধু বোঝা হয়ে/ শিক্ষা আমায় মুক্তি দেবে।’
আজ সেই প্রাণোচ্ছ্বল মীনাদের দিন। তাদের প্রাণ খুলে উচ্ছ্বাসের দিন। সব বাধা ডিঙিয়ে এগিয়ে যাওয়ার দিন। প্রতিক্রিয়াশীলতাকে পেছনে ফেলে, প্রাচীন ধ্যান ধারণা ভেঙে বিজয়ী হওয়ার দিন। আর তাই গোটা বিশ্বজুড়ে আজ উদযাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস।
কিন্তু সমাজের প্রচলিত রীতি ভেঙে অনেকে এগিয়ে যাওয়ার গল্প উৎসাহ যোগালেও এখনও প্রতি পদে পদে রয়েছে প্রতিবন্ধকতা। একুশ শতকে এসেও পোশাক নিয়ে ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে নারীর মর্যাদা।
কপালে টিপ পরায় ‘রক্ষক’ পুলিশের হাতেও হেনস্তার শিকার হতে হয় নারীদের। শিক্ষার্থীকে শাসন করার কারণে নারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে আনা হয় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ। উৎসাহের বদলে নানা টিপ্পনী সহ্য করে ফুটবল খেলতে হয় সানজিদা, মনিকা শিউলিদের।
এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে নারীর স্বাধীন চলাফেরায় তৈরি করা হচ্ছে হুমকি। নিজ ঘরেও অত্যাচারের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা, সহ্য করতে হয় মানসিক যন্ত্রণা।
কর্মজীবী নারীদের নিয়ে এখনও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি। নারী শ্রমিকদের এখনও ছোট করে দেখা হয়, দেয়া হয় না ন্যায্য মজুরি।
এভাবেই বহুকাল ধরে বৈষম্যের শিকার নারীরা। আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান যুক্ত করা হলেও বন্ধ করা যায়নি ধর্ষণ।
কিন্তু সুযোগ আর ভালোবাসা পেলে যে নারী তার শক্তি দেখিয়ে দিতে পারে তা কদিন আগে প্রমাণ করেছে সাফজয়ী বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল। তাদেরকেও পার করতে হয়েছে নানা প্রতিকূলতা। কিন্তু তার যখন নেপালের মাটি থেকে বিজয় ছিনিয়ে আনল, সেই আনন্দে উদ্ভাসিত হয়েছে পুরো বাংলাদেশ। অজস্র প্রতিকূলতাকে ডিঙিয়ে সাবিনা ও তার দল নেপালের মাঠে রচনা করলেন বীরগাথা।
এমন বাস্তবতায় বিশ্ব জুড়ে আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস। নারী ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার প্রত্যয় নিয়ে প্রতিবছর ১১ অক্টোবর উদযাপিত হয় দিনটি।
বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী হলেও তাদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন নিশ্চিত হয়নি আজও। কন্যাশিশু ও নারীর ক্ষমতায়ন, তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা, দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষার সুবিধা এবং সমান সুযোগ এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা ও বৈষম্যমুক্ত বিশ্ব গড়ার অঙ্গীকারে দিনটির সূচনা।
নিজ অধিকার আদায়ে কথা বলার শক্তিকে প্রশস্ত করে দেয়ার চর্চাটি যেন শৈশব থেকে আয়ত্ব করা যায়, সেটিই যেন কন্যাশিশু দিবসের মূল লক্ষ্য।
২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর, আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস উদযাপনে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব পাস হয়। সেদিন নারী শক্তি সম্মান জানাতে ১১ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
তবে সূর্যটা উঠেছিল চীনে। ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে নারী বিষয়ক বিশ্ব সম্মেলনে ‘বেইজিং ঘোষণা’-এর মাধ্যমে নারী ও কন্যাশিশুদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার হওয়ার দাবি জানানো হয়। বিশ্বের ইতিহাসে এটিই প্রথম ব্লুপ্রিন্ট, যা বিশ্ব জুড়ে কন্যাশিশুদের সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিত করেছে।
কন্যাশিশুদের অধিকার আদায়ে প্রথম এগিয়ে এসেছি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল। ‘কারণ আমি একজন মেয়ে’ প্রতিপাদ্য নিয়ে ২০০৭ সালে প্রচারাভিযানে নামে সংস্থাটি। যার লক্ষ্য ছিল বিশ্বজুড়ে এবং বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে কন্যাশিশুদের লালন-পালনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতার বার্তা দেয়া।
জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো ১১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস পালন করলেও বাংলাদেশে অবশ্য এর ভিন্নতা রয়েছে। দেশে প্রতিবছর ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক শিশু সপ্তাহ পালন করা হয়। এই শিশু সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর পালন করা হয় জাতীয় কন্যা শিশু দিবস।
২০০৩ সালে কন্যাশিশুদের সুরক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ৩০ সেপ্টেম্বরকে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস ঘোষণা করা হয়।
দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ শিশুর উন্নয়ন, সুরক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে বর্তমান সরকার। এই শিশুদের অন্তত ১৫ শতাংশ কন্যাশিশু। করোনাকালে কন্যাশিশুর ওপর বঞ্চনা বেড়ে যাওয়ায় দিবসটি বিশেষ গুরুত্ব সহকারে পালন করা হয়।
সরকারের উদ্যোগ থাকলেও পরিসংখ্যান বলছে বাংলাদেশের চিত্র কন্যাশিশুদের জন্য সুখকর নয়। ইউনিসেফ-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৫০ শতাংশের বেশি নারী যাদের বয়স এখন ২০ এর মধ্যে তাদের বয়স ১৮ পূর্ণ হবার আগেই বিয়ে হয়েছে। প্রায় ১৮ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৫ বছরের নিচে।
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম নামে একটি সংগঠন জানিয়েছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে কন্যাশিশুদের উপর যৌন নিপীড়ন ও নির্যাতনের ঘটনা ছিল ১১৬টি৷ এর মধ্যে ৮৮ শিশু যৌন নিপীড়ন ভোগ করেছে৷ ২৮ কন্যাশিশু পর্নোগ্রাফির শিকার হয়েছে৷