ইরানে ‘সঠিকভাবে’ হিজাব না করার অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর পুলিশি হেফাজতে মারা যাওয়া মাহসা আমিনি গোটা দেশে নারীর পোশাকের স্বাধীনতার অধিকারের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।
মাহসার মৃত্যুর ঘটনায় টানা বিক্ষোভে উত্তাল ইরান। রাজধানী তেহরানসহ অন্তত ৮০টি শহরে ছড়িয়ে পড়েছে বিক্ষোভ। পোশাকের স্বাধীনতার দাবিতে চলমান বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত ৫০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন। আহত হয়েছেন হাজারের বেশি।
অসলোভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ইরান হিউম্যান রাইটস (আইএইচআর) জানিয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের কারণে হতাহতের ঘটনা ঘটেই চলেছে।
কুর্দি নারী মাহসা আমিনিকে গত ১৩ সেপ্টেম্বর তেহরানের ‘নৈতিকতা পুলিশ’ গ্রেপ্তার করে। ইরানের পশ্চিমাঞ্চল থেকে তেহরানে ঘুরতে আসা মাহসাকে একটি মেট্রো স্টেশন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি সঠিকভাবে হিজাব করেননি।
মাহসা আমিনি
পুলিশ হেফাজতে থাকার সময়েই মাহসা অসুস্থ হয়ে পড়েন, এরপর তিনি কোমায় চলে যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৬ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু হয়। এর ঠিক পাঁচ দিন পরেই ছিল মাহসার জন্মদিন।
বেঁচে থাকলে ২১ সেপ্টেম্বর বুধবার ২৩ বছরে পা দিতেন মাহসা আমিনি। এ ঘটনা আরও আবেগতাড়িত করছে আন্দোলনকারীদের। ইরানের কুর্দিস্তান প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর সাকেজে ১৭ সেপ্টেম্বর মাহসাকে দাফন করা হয়। জন্মদিনে সেই কবর ফুলে ঢেকে দেন শোকার্ত বিক্ষোভকারীরা। কবরের ওপরেই কাটা হয় কেক।
Happy birthday to you #Mahsa_Amini #MahsaAmini #مهسا_امینی #مهساامینی #OpIran #IranProtests2022 pic.twitter.com/ayvC3FjOHO
— Ali (@Sonofrivendell) September 24, 2022মাহসার বাবা ডয়চে ভেলে ফার্সিকে বলেন, ‘সে (মাহসা) বেঁচে থাকলে আজ ৩০ শাহরিভার নিজের জন্মদিন উদযাপন করত। সে ছিল ছোট্ট স্বপ্ন দেখা এক তরুণী। তার চলে যাওয়া বিশাল শূন্যতা তৈরি করেছে।’
পার্সিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী শাহরিভার মাসের ৩০ তারিখ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ২১ সেপ্টেম্বর। এ বছর এই তারিখটি ছিল গত বুধবার।
জন্মদিনে মাহসার কবরের ওপর লাল কাপড় বিছিয়ে তার ছবিযুক্ত কেক কাটা হয়েছে। ছিল ডার্ক চকোলেট, মিষ্টি ও ফুল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে বার্থডে উইশ করেছেন সারা বিশ্বের অসংখ্য মানুষ।
ইরানে নারীর পোশাকের স্বাধীনতার অধিকারের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন মাহসা আমিনি
১৯৯৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয়া মাহসার পুরো নাম জিনা মাহসা আমিনি।
ইরান সরকারের অভিযোগ, মাহসা কুর্দি বিদ্রোহী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে এ অভিযোগকে সরকারের প্রোপাগান্ডা হিসেবে দাবি করেছে তার পরিবার।
মাহসা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না জানিয়ে তার চাচাতো ভাই এরফান মোর্তেজা বলেন, ‘আমার সোজাসাপ্টা উত্তর হলো মাহসা তার ২২ বছরের জীবনে কখনও ইরানের বাইরে পা রাখেনি। সে ছিল মিষ্টি একটি মেয়ে, যার জীবন বলতে ছিল সংগীত, ভ্রমণ, শিল্প সম্পর্কে চিন্তা; মাহসা কোনো রাজনৈতিক কার্যকলাপে যুক্ত ছিল না। তার স্বপ্ন ছিল নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা।’
মাহসা ছিলেন পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। প্রথম সন্তান আরমিন আমিনি কিশোর বয়সেই মারা যায়। মাহসার কিয়ারশ আমিনি নামে এক ভাই রয়েছে, তার সামনেই তেহরানের মেট্রো স্টেশন থেকে মাহসাকে গ্রেপ্তার করে ইরানের নৈতিকতা পুলিশ।
কিয়ারশ গত সপ্তাহে ইরানওয়্যারকে বলেন, ‘আমার এখন হারানোর আর কিছুই নেই। আমি ইরানের সবাইকে জানাব কী হয়েছিল।’
কিয়ারশ জানান, তাদের পরিবার রাজধানীতে ঘুরতে এসেছিল। শহীদ হাঘানি এক্সপ্রেসওয়ের প্রবেশপথে ভোর সাড়ে ৬টার দিকে নৈতিকতা পুলিশের টহল ভ্যান তাদের গতিরোধ করে।
পুলিশ মাহসাকে জোর করে ভ্যানে তুলে নেয়। তার ভাই এ সময় বাধা দিয়েও ব্যর্থ হন। নৈতিকতা পুলিশের দলটি যাওয়ার সময় জানায়, মাহসাকে তারা নিজেদের স্টেশনে নিয়ে যাচ্ছে এবং ১ ঘণ্টার ‘শিক্ষা সেশন’ শেষে ছেড়ে দেয়া হবে।
ইরানজুড়ে বিক্ষুব্ধদের ঐক্যবদ্ধ করেছেন মাহসা আমিনি
পরের ঘটনার বিবরণ দিয়ে কিয়ারশ বলেন, ‘আমি ওদের (নৈতিকতা পুলিশ) ভবনের সামনে গিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আমার সঙ্গে আরও অনেকে ছিলেন। এ সময় হঠাৎ ভেতর থেকে চিৎকার শুনতে পাই।
‘আমরা সবাই দরজায় ধাক্কা দিতে থাকি। হঠাৎ পুলিশ সদস্যরা ভবন থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের লাঠিপেটা এবং টিয়ার শেল ছুড়তে শুরু করে। আঘাতে আমার সারা শরীর কালো আর নীল হয়ে গিয়েছিল। কাঁদানে গ্যাসের কারণে চোখ জ্বলছিল। এর ৫ মিনিট পর একটি অ্যাম্বুলেন্স ভবনটি থেকে বেরিয়ে যায়।’
কিয়ারশ বলেন, ‘এ সময় বন্দি অনেক নারী ছুটে বেরিয়ে আসেন। তারা বলছিলেন ভেতরে কেউ মারা গেছে। আমি তাদের মাহসার ছবি দেখালাম। একজন বললেন, ঘটনাটি ঘটার সময় মাহসা তার পাশে ছিল।
‘আমি হতবাক ও আতঙ্কিত হয়ে যাই। এক পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে। তিনি বললেন, তাদের একজন আহত হয়েছেন। তিনি আসলে মিথ্যা বলছিলেন। আমি তাকে বিশ্বাস করিনি। সেই অ্যাম্বুলেন্সে ছিল মাহসা। আমি ছুটতে ছুটতে হাসপাতালে গিয়েছি।’
সেদিন রাত সোয়া ৮টার দিকে চিকিৎসকরা মাহসার পরিবারকে জানান, তাকে বাঁচানো যাবে না। তিনি হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন। তার হৃৎপিণ্ড সচল থাকলেও মস্তিষ্ক কাজ করছে না। কোমায় চলে যাওয়া মাহসার মৃত্যু হয় ১৬ সেপ্টেম্বর।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অল্প কয়েকটি ছবিতে দেখা যায়, ছোটবেলা থেকেই প্রাণোচ্ছ্বল ছিলেন মাহসা আমিনি।
চাচাতো ভাই এরফান মোর্তেজা বলেন, ‘মাহসা বা আমাদের প্রিয় জিনা (ডাকনাম) সব সময় হাসিখুশি, উচ্ছ্বসিত ও প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ ছিল। গান, ঘোরাঘুরি, কুর্দি পোশাক এবং শিল্প খুব পছন্দ করত। আমাদের কোনো আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিতদের সঙ্গে ও কখনও দুর্ব্যবহার করেনি।’
‘বাধ্যতামূলক হিজাব আইন ও একদম পছন্দ করত না।’
তেহরানের রাস্তায় বিক্ষোভের সময় হিজাব খুলে পুড়িয়ে দিচ্ছেন এক নারী
ইরানে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পরই নারীদের জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক করা হয়। ইরানের ধর্মীয় শাসকদের কাছে নারীদের জন্য এটি ‘অতিক্রম-অযোগ্য সীমারেখা’। বাধ্যতামূলক এই পোশাকবিধি মুসলিম নারীসহ ইরানের সব জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মের নারীদের জন্য প্রযোজ্য।
এই পোশাকবিধি অনুযায়ী নারীদের জনসমক্ষে চুল সম্পূর্ণভাবে ঢেকে রাখতে হয় এবং লম্বা, ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হয়।
হিজাব আইন আরও কঠোরভাবে প্রয়োগের জন্য চলতি বছরের ৫ জুলাই ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি একটি আদেশ জারি করেন। এর মাধ্যমে ‘সঠিক নিয়মে’ পোশাকবিধি অনুসরণ না করা নারীদের সরকারি সব অফিস, ব্যাংক এবং গণপরিবহনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ইরানে নারীর পোশাকের স্বাধীনতার দাবিতে বিক্ষোভে অসংখ্য পুরুষও যোগ দিয়েছেন
এ ঘটনায় গত জুলাইয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #no2hijab হ্যাশট্যাগ দিয়ে শুরু হয় প্রতিবাদ। দেশটির নারী অধিকারকর্মীরা ১২ জুলাই সরকারঘোষিত জাতীয় হিজাব ও সতীত্ব দিবসে প্রকাশ্যে তাদের বোরকা ও হিজাব সরানোর ভিডিও পোস্ট করেন। তাদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে সে সময়েও পোস্ট দিয়েছিলেন অসংখ্য ইরানি পুরুষ।
ওই আন্দোলনের রেশ শেষ না হতেই মাহসার মৃত্যু কেন্দ্র করে নতুন করে উত্তাল ইরান। ফেসবুক ও টুইটারে #mahsaamini এবং #Mahsa_Amini হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে চলছে প্রতিবাদ। দেশটির বিভিন্ন জায়গায় নারীর পোশাকের স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলছে নিরাপত্তা বাহিনীর।