নারীর পোশাকের স্বাধীনতার দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল ইরান। ‘সঠিক নিয়মে’ হিজাব না পরার অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর ২২ বছরের মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর দেশটির বিভিন্ন শহরে টানা বিক্ষোভ চলছে।
এই বিক্ষোভে নারীদের পাশাপাশি যোগ দিয়েছেন হাজারো পুরুষ। রাস্তায় প্রতিবাদের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নারীর পোশাকের স্বাধীনতার পক্ষে দেশটির অসংখ্য পুরুষ সোচ্চার।
টানা ছয় দিনের বিক্ষোভ দমন করতে ব্যাপক শক্তি প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে। বুধবার পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৭ বিক্ষোভকারী, যাদের প্রায় সবাই পুরুষ বলে জানাচ্ছে বিভিন্ন অধিকার গোষ্ঠী।
নরওয়েভিত্তিক কুর্দি অধিকার গোষ্ঠী হেনগাও-এর তথ্য অনুযায়ী, সবশেষ মঙ্গলবার ইরানের পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশের পিরানশাহর ও উর্মিয়া শহরে ভয়াবহ সংঘর্ষে ১৬ বছরের কিশোর জাকারিয়া খিয়াল ও ২৩ বছর বয়সী ফারজাদ দারউশি মারা যান।
এ ছাড়া গত কয়েক দিনে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর সরাসরি গুলিতে দেহগোলান, দিওয়ানদারা, সাকেজ, উর্মিয়া এবং পিরানশাহর শহরে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত পাঁচ কুর্দি বিক্ষোভকারী।
নিরাপত্তা বাহিনীর গুলি, লাঠিপেটায় গত ছয় দিনে আহত হয়েছেন সাড়ে চার শর বেশি মানুষ, গ্রেপ্তার হয়েছেন হাজারেরও বেশি। আহত ও গ্রেপ্তার বিক্ষোভকারীদের মধ্যেও পুরুষের সংখ্যা বেশি।
বিক্ষোভে অংশ নেয়া পুরুষরা বলছেন, তারা ইরানে নারীর জন্য ‘স্বাধীন’ একটি পরিবেশ তৈরি করতে চান। আমিরএমসিজি নামের একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে রাবার বুলেটে ঝাঝরা হয়ে যাওয়া এক পুরুষ বিক্ষোভকারীর ছবি পোস্ট করে বলা হয়েছে, ‘দ্যাট’স হোয়াট উই ডু ফর আওয়ার সিস্টার্স (আমাদের বোনদের জন্য আমরা যা করছি)’।
ইরানে মঙ্গলবার বিক্ষোভে নিহত কিশোর জাকারিয়া খিয়াল (বাঁয়ে) ও ফারজাদ দারউশি
ইরানের নিউ ইয়র্কভিত্তিক সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটসের নির্বাহী পরিচালক হাদি ঘাইমি বলেন, ‘মাহসা আমার মেয়ে, আমার বোন, আমার স্ত্রী হতে পারে। আমার বাড়ির মেয়েরা যতবার বাড়ি থেকে বের হয়, ততবার আশঙ্কায় থাকি, তারা হয়তো আর বাড়ি ফিরে নাও আসতে পারে।’
ইরানে ১৯৭৯ সালের ৭ মার্চ নারীদের জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক করা হয়। দেশটির ধর্মীয় শাসকদের কাছে নারীদের জন্য এটি ‘অতিক্রম-অযোগ্য সীমারেখা’। বাধ্যতামূলক এই পোশাকবিধি মুসলিম নারীসহ ইরানের সব জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মের নারীদের জন্য প্রযোজ্য।
এই পোশাকবিধি অনুযায়ী নারীদের জনসমক্ষে চুল সম্পূর্ণভাবে ঢেকে রাখতে হয় এবং লম্বা, ঢিলেঢালা পোশাক পরা বাধ্যতামূলক। আর বিষয়টি নিশ্চিতের দায়িত্ব রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিশেষ শাখা- নৈতিকতা পুলিশের ওপর।
হিজাব আইন আরও কঠোরভাবে প্রয়োগের জন্য চলতি বছরের ৫ জুলাই ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি একটি আদেশ জারি করেন। এর মাধ্যমে ‘সঠিক নিয়মে’ পোশাকবিধি অনুসরণ না করা নারীদের সরকারি সব অফিস, ব্যাংক এবং গণপরিবহনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এ ঘটনায় গত জুলাইয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #no2hijab হ্যাশট্যাগ দিয়ে শুরু হয় প্রতিবাদ। দেশটির নারী অধিকারকর্মীরা ১২ জুলাই সরকারঘোষিত জাতীয় হিজাব ও সতীত্ব দিবসে প্রকাশ্যে তাদের বোরকা ও হিজাব সরানোর ভিডিও পোস্ট করেন। তাদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে সে সময়েও পোস্ট দিয়েছিলেন অসংখ্য ইরানি পুরুষ।
কুর্দি নারী মাহসা আমিনিকে গত ১৩ সেপ্টেম্বর তেহরানের ‘নৈতিকতা পুলিশ’ গ্রেপ্তার করে। ইরানের দক্ষিণাঞ্চল থেকে তেহরানে ঘুরতে আসা মাহসাকে একটি মেট্রো স্টেশন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি সঠিকভাবে হিজাব করেননি।
পুলিশ হেফাজতে থাকার সময়েই মাহসার হার্ট অ্যাটাক হয়, এরপর তিনি কোমায় চলে যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শুক্রবার তার মৃত্যু হয়। পুলিশ মাহসাকে হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরিবারের অভিযোগ গ্রেপ্তারের পর তাকে পেটানো হয়।
মাহসার মৃত্যুর পর থেকেই উত্তাল ইরান। ফেসবুক ও টুইটারে #mahsaamini এবং #Mahsa_Amini হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে চলছে প্রতিবাদ। দেশটির বিভিন্ন জায়গায় নারীর পোশাকের স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলছে নিরাপত্তা বাহিনীর।