নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার মিনু মরমু দুই ছেলের মা। স্বামী ভ্যানচালক। সংসারে বাড়তি আয়ের জোগান দিতে মিনু জমিতে আমন ধানের চারা রোপণ করছেন। তার সঙ্গে একই কাজ করছেন আরও ১১ নারী। মিনু মনে করেন, সৎভাবে সব কাজই গৌরবের।
উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁর প্রায় এক লাখ নারী কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। কৃষির বিভিন্ন কাজ, বিশেষ করে শস্য কাটা, ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণ, বীজ উৎপাদন, বসতবাড়ির আঙিনায় সবজি ও ফল উৎপাদন ইত্যাদিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন নারীরা।
জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নারীদের কেউ বাড়ির উঠানে সবজি চাষ করছেন, কেউ সবজি ক্ষেতে কাজ করছেন, কেউবা ধানক্ষেতে কাজ করছেন।
পত্নীতলা উপজেলার সরাইল মাঠে ধান রোপণ করছেন ১২ জন নারী। তাদের দলনেতা হানিফ উদ্দিন নামে এক শ্রমিক। মাথার ওপর তীব্র রোদ ও গরম উপেক্ষা করে পুরুষ শ্রমিকদের মতোই সমানতালে ধান রোপণ করে যাচ্ছেন নারী শ্রমিকরা।
এই দলেই কাজ করছেন মিনু। তিনি বলেন, ‘হামার সংসারে দুই সন্তান ও স্বামী আছে। স্বামীডা হামার ভ্যান চালায় আর হামি নারী শ্রমিকের কাম করি। আমন মৌসুম চলিচ্ছে। তাই ধান লাগানার কাম করিচ্ছি। প্রতি বিঘা ধান লাগানা ১৫০০ টাকা করা। প্রতিদিন হামরা ৫ বিঘার মতো ধান লাগাই। দিন শেষে একেক জন ৬৫০-৭০০ টেক্যার মতো করা পাই। দুই সন্তান স্কুলে পড়ালেকা করে। তারকোক বড় করা তুলা চাকুরি করামু।’
দলনেতা হানিফ উদ্দিন বলেন, ‘আমরা মোট ১৩ জন ধান রোপণের কাজ করছি। আমি ছাড়া সবাই নারী। কাজ করে যা টাকা পাই তা সবাই সমান করেই ভাগ করে নিই। আমাদের মাঝে কাজের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা বা ঝামেলা হয় না।’
নওগাঁর মান্দা উপজেলা মৈনম গ্রামের তাহমিনা বেগম বলেন, ‘আউস ধান কাটা শুরু হয়েছে। বাড়ির উঠানে ধান শুকানোর কাজ করছি। আমার স্বামীকেও নানাভাবে কৃষিকাজে সাহায্য করি।’
সদর উপজেলার বর্ষাইল গ্রামের মাঠে ক্ষেত থেকে মরিচ সংগ্রহের কাজ করছেন কান্তী রানী। তিনি বলেন, ‘স্বামী ও সন্তানদের সঙ্গে ক্ষেত ত্যাকা হামি মরিচ তোলার কামে সহযোগিতা করিচ্ছি। সংসারের কামের পাশাপাশি নানা ধরনের কৃষি ফসল ফলান ও উৎপাদনে স্বামী ও সন্তানোক নানাভাবে সহযোগিতা করা থাকি। সবাই মিলা-মিশা কামগুলা করলে সহজ হয়।’
নওগাঁ শহরের মুন্সিপাড়া মহল্লার গৃহিণী পারভিন আক্তার তার বাড়ির ছাদে সবজি, ফুল, ফলসহ প্রায় ২৫ রকমের চারা রোপণ করেছেন। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাজারে বিক্রিও করেন। এমনকি প্রতিবেশীদেরও উপহার দেন।
পারভিন বলেন, ‘নারীরা সব দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। সব ক্ষেত্রে নারীরা অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন। বাড়ির ছাদ খালি পড়েছিল। দুই বছর আগে আমি ছাদ বাগান গড়ে তুলি। এসব বাগান থেকে সবজি ও ফল নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাজারেও বিক্রি করছি। প্রতিবেশীদেরও দিই। এসব গাছ লাগানোর কারণে পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা হচ্ছে। গ্রাম কিংবা শহর সবখানেই উচিত নারীদের কৃষিতে ভূমিকা রাখা।’
নওগাঁ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও গবেষক শরিফুল ইসলাম খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কৃষিক্ষেত্রে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। ফসল উৎপাদনে মাঠের কাজের পাশাপাশি মাঠের বাইরে উৎপাদনকাজেও নারীরা ভূমিকা রাখছেন। কৃষিপণ্য উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত রয়েছে নারীর অবদান। এসব নারীর কৃষি খাতে ভূমিকা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বেশি করে প্রশিক্ষণ ও স্বীকৃতি দেয়ার প্রয়োজন।’
নারীদের জেলা পর্যায়ে কৃষি খাতে ভূমিকা রাখা ও উৎসাহিত করতে বিশেষ পুরস্কার দেয়ার উদ্যোগ নিলে তারা আরও উৎসাহিত হবেন বলে মত জানান তিনি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আবু হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নওগাঁর ১১টি উপজেলার প্রায় এক লাখ নারী প্রত্যক্ষ ও প্ররোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। কৃষিতে নানাভাবে ভূমিকা রেখে আসছেন জেলার নারীরা। তারা সংসারে বাড়তি আয়ের জোগান দিচ্ছেন কৃষি কাজ করে।’
কৃষি বিভাগ থেকে গ্রামীণ নারীদের কৃষিকাজে কী ধরনের সহায়তা ও পরামর্শ দেয়া হয়- এমন প্রশ্নে এই কর্মকতা বলেন, ‘নারীদের কৃষিকাজে উৎসাহিত করার জন্য মাঠ দিবস, উঠান বৈঠক করা হয়। এ ছাড়া নানা ধরনের ফসল, সবজি, ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, বীজ উৎপাদন, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু পালন, বসতবাড়ির আঙিনায় সবজি ও ফল উৎপাদনসহ নানা ধরনের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা করা হয়।
‘জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে আমাদের কৃষি অফিস আছে। সেখান থেকে নারীরা সরাসরি কৃষিবিষয়ক নানা পরামর্শ পান। প্রতিটি প্রশিক্ষণে আমরা ৩০ ভাগ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করি।’