নারীর ‘ছোট পোশাকের’ বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সম্প্রতি আয়োজিত মানববন্ধন নিয়ে প্রবল সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কর্মসূচির ব্যানার-ফেস্টুনে ব্যবহৃত স্লোগান নারীর প্রতি প্রচণ্ড অমর্যাদার হিসেবে মন্তব্য করে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন অনেকে।
এসব কর্মসূচিতে ব্যবহৃত স্লোগানের একটিতে বলা হচ্ছে ‘ছোট পোশাক নারীকে বিজ্ঞানী বানায় না, পণ্য বানায়’। এই স্লোগানটি নিয়েও নানামুখী আলোচনা চলছে ফেসবুকে।
ইন্টারনেট ঘেঁটে নারীর বিজ্ঞানমনস্কতার সঙ্গে ছোট বা বড় পোশাকের কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। বরং বিজ্ঞান জগতের নারীরা মনে করছেন, কর্মক্ষেত্রে নিজের স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ যেকোনো পোশাক কাজের প্রতি মনোনিবেশ বাড়িয়ে দেয়।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় যুক্ত নারীদের পোশাক কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম বেঁধে দেয়ার সুযোগ নেই বলেও মনে করছেন নারী বিজ্ঞানীরা।
সুইজারল্যান্ডের ইকোল পলিটেকনিক ফেদারেল দ্যু লুসানের ক্যানসার বায়োলজির পোস্টডক্টরাল গবেষক কোর্টনি থমাস বলছেন, ‘বিজ্ঞানের জগতে বসবাস করা নারী হিসেবে আমরা নিজেদের এবং পুরুষ সহকর্মীদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করি: আমাদের আচরণ কী হবে, কীভাবে সেরা গবেষণা করা যাবে এবং কীভাবে নিজেদের উপস্থাপন করতে হবে।
‘একজন নারী বিজ্ঞানীর সৌন্দর্য সচেতনতা নিয়ে আমাদের সমাজে কিছু অন্ধবিশ্বাস রয়েছে। অনেকেই মনে করেন একজন নারী তার সৌন্দর্যের দিকে মনোযোগ দিলে বোধহয় স্টেম সেল বা কোয়ান্টামবিদ্যা সম্পর্কে গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করার সময় পান না।’
নারী বিজ্ঞানীরা প্রায়ই সেক্সিস্ট (যৌনবিদ্বেষী) ও আপত্তিকর আচরণ এবং অযাচিত পরামর্শের মুখোমুখি হন বলেও মন্তব্য করেন কোর্টনি।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রায়ই মেয়েদের উপদেশ দেয়া হয়, ২ ইঞ্চির বেশি হিল পরবেন না। এর চেয়ে উঁচু হিল ভয়ঙ্কর এবং অ-পেশাদার। কিন্তু আমি একবার একটি সেমিনারে নিজের প্রিয় বেগুনি রংয়ের ৩ ইঞ্চি হিল জুতো পরে গিয়েছি।
‘যে জুতো আপনার জন্য আরামদায়ক সেটিই পরুন। এটি আপনাকে অনন্য আত্মবিশ্বাস দেবে। আপনি নিজেকে আরও ভালোভাবে প্রকাশে সক্ষম হবেন।’
কোর্টনি বলেন, ‘নারীর প্রতি আরেকটি (অযাচিত) উপদেশ হলো, মেকআপ করুন, তবে খুব বেশি নয়। বলা হয়, একজন নারীর শারীরিক সৌন্দর্য প্রকাশের একটি সীমা নির্ধারিত আছে।
‘এ সম্পর্কে আমার সাফ কথা, আমি কী গবেষণা করছি সেদিকে নজর দিন, আমার মুখ/হেয়ারস্টাইল/পোশাক নিয়ে আপনার মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। ল্যাবে চেহারার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আপনি যে পোশাক পরে কাজ করছেন সেটি নিরাপদ কিনা। আপনি যদি আরামদায়ক পোশাক পরে আরও ভালো কাজ করতে পারেন, তাহলে সেটাই বেছে নিন। চাইলে জিন্স ও সোয়েটশার্ট পরে ল্যাবে যান।’
‘আমি মেকআপ পছন্দ করি না, তাই বেশিরভাগ দিন এটা নিয়ে ল্যাবে যাই না। তবে আমার একজন সহকর্মী প্রতিদিন বিশ্বের সবচেয়ে নিখুঁত আইলাইনার নিয়ে আসেন। মূল কথা হলো, আমরা দুজনেই স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণভাবে কাজ করতে পছন্দ করি। নিজেকে আরামদায়ক রাখতে পারলে নিজের সমস্ত অভিনিবেশ নিয়ে দুর্দান্ত বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করতে পারবেন।‘
গবেষণার সময়ে নারীর সঙ্গে অন্তত একজন পুরুষ সহকর্মী রাখার মতো উপদেশ নিয়েও বিরক্ত কোর্টনি থমাস।
তিনি বলেন, ‘কত হাস্যকর এক উপদেশ! কাউকে একজন বিজ্ঞানীর মতো দেখানোর একক কোনো উপায় নেই। এসব পুরোনো ধ্যানধারণা ঝেটিয়ে বিদায় করে বাস্তবকে বুঝতে শিখুন।
‘বিজ্ঞানের জগতে বিচরণ করা প্রিয় নারীরা, আমরা সর্বত্র এবং কর্মজীবনের প্রতিটি পর্যায়ে যোগ্য! আমরা প্রতিটি জায়গায় সক্ষম। আমাদের আইডিয়াগুলো আমাদের পুরুষ সহকর্মীদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।’
নাসার অনুষ্ঠানে ঝলমলে পোশাকে বিজ্ঞানী রিটা জে কিং। ছবি: সংগৃহীত
নাসার অনুষ্ঠানে ঝলমলে পোশাক নিয়েও উঠেছিল বিতর্ক
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার একটি আয়োজনে সোনালি রঙয়ের উজ্জ্বল গাউন পরে বক্তৃতা দিয়ে বিতর্কে পড়েন নিউ ইয়র্কভিত্তিক স্ট্রেটেজিক কনসালটেন্সি ফার্ম-সায়েন্স হাউজের সহ-পরিচালক রিটা জে কিং। ঘটনাটি ২০১১ সালের।
বিজ্ঞানের মতো ‘গম্ভীর’ বিষয়ে বক্তব্য দেয়ার সময় ঝলমলে পোশাক পরার বিষয়টি বেশ আলোচিত হয়। বিষয়টি নিয়ে ২০১৯ সালে নভেম্বরে টুইটার হ্যান্ডেলে ওই পোশাকের ছবি শেয়ার করেন রিটা। ব্যাখ্যা দেন, আট বছর আগে এমন পোশাক পরার কারণ।
তিনি লেখেন, “অতীত নিয়ে ভাবছিলাম। তখন এ গাউনটি সামনে পাই। মনে পড়ল সেই ছোট্ট মেয়েদের কথা, যারা আমাকে নাসায় বক্তৃতা দেয়ার সময় উজ্জ্বল কিছু পরতে বলেছিল। ওরা এমনটা চেয়েছিল, কারণ তারা বিশ্বাস করছিল যে বিজ্ঞানীরাও উজ্জ্বল হতে পারেন।
Why should we have to chose between being a scientist and being sparkly? I was high heels shamed for years, "how can you work all day in the lab with those on your feet..." We present ourselves however we want to be, with or without lipstick. https://t.co/dKHYyZNQ6n
— Joana Lobo Antunes🔬💬 (@JoanaLoA) November 2, 2019টুইটের পর ব্যাপক সমর্থন পান রিটা। তার টুইটে ৪১ হাজারের বেশি লাইক পড়ে। ঝলমলে পোশাকের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো বিরোধ নেই বলে মন্তব্য করেন অনেকে। পুরুষশাসিত কর্মক্ষেত্রে ‘নারীত্ব’ তুলে ধরায় রিটার প্রশংসাও করা হয়।
একজন লেখেন, “হ্যাঁ! এ কারণেই আমি অনেক মায়ের মনে থাকা অ্যান্টি-পিঙ্ক ব্যাকল্যাশকে ঘৃণা করি। মেয়ে মানুষ হওয়াতে কোনো ভুল নেই এবং এটা পুরুষশাসিত জায়গায় কাজ করা থেকে আপনাকে বিরত রাখতে পারে না!
আরেকজন লেখেন, “নারীত্ব একটি শক্তি, দুর্বলতা নয়। আমাদের মেয়েদের জন্য একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হওয়ার জন্য ধন্যবাদ।”
This is so important. The idea that masculine is serious and feminine is frivolous limits the options girls see for themselves and their future lives. This shows them that they don't have to pick between their interests and their identities. Science is for everyone. Thank you!
— katie kawaii (@katiekawaii) November 4, 2019বাজফিড নিউজকে রিটা বলেন, ‘ওই অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষভাবে পোশাকটি কিনেছিলাম। এমন অবস্থান থেকে কখনোই সরে যাব না।
‘আমি সবচেয়ে ঝকমলে পোশাক বেছে নিই। আমি তাদের (যারা আমন্ত্রণ জানিয়েছিল) দেখাতে চেয়েছিলাম যে, স্কুলের বাচ্চাদের চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়েছি।’