নারীর পছন্দসই পোশাক বেছে নেয়ার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন তরুণের মানববন্ধনের মধ্যে সমালোচনা হলেও একই ধরনের কর্মসূচি ছড়িয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির পর এবার জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও পোশাকের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে নানা বক্তব্য লিখে প্ল্যাকার্ড তৈরি করে দাঁড়িয়েছেন কিছু তরুণ।
রোববার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে এক মানববন্ধনে তারা এ স্যালুট জানান।
একই দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশে হয় মানববন্ধন।
দুটি কর্মসূচিতেই পশ্চিমা পোশাক পরা নারীর শাস্তি দাবি করা হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, ‘ছোট’ পোশাক যৌন সুড়সুড়ি দেয়। এগুলো মানসিক ধর্ষণ।
নরসিংদীর রেলওয়ে স্টেশনে স্লিভলেস টপস পরার কারণে এক নারীকে হেনস্তার অভিযোগে আটক নারীর জামিন শুনানিতে হাইকোর্টে একজন বিচারক যে মন্তব্য করেছেন, তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রথমে গত বৃহস্পতিবার এমন কর্মসূচি পালিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তরুণরা তাদের ভাষায় ‘মূল্যবোধবিরোধী’ পোশাকের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় কয়েকজন।
এই তরুণদের দাবি, মেয়েদের পশ্চিমা পোশাক, তাদের মানসিক নিপীড়ন করে, তাদেরকে যৌন সুড়সুড়ি দেয়।
এই কর্মসূচি নিয়ে সমালোচনার মধ্যে শনিবার নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে কিছু তরুণ দাঁড়ায়। তাদের বক্তব্য ছিল, যে কারও দেহ তার। কিন্তু তিনি পোশাকের কারণে অন্যের বিরক্তির কারণ হতে পারেন না।
তবে এই তরুণরা মেয়েদের পশ্চিমা পোশাকের সমালোচনা করলেও নিজেরাই পশ্চিমা পোশাক পরে দাঁড়াচ্ছেন। স্কিন টাইট টি-শার্ট আর জিনসে নিজেদের দেহসৌষ্ঠব প্রকাশ হচ্ছে।
সমালোচনাকারীদের শাস্তি দাবি
জগন্নাথের কর্মসূচিতে এই মানববন্ধনের সমালোচকারীদের শাস্তি দাবি করা হয়।
শুভ খান নামে একজন বলেন, ‘উচ্চ আদালত পশ্চিমা অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে বলায়, অনেকে ফেসবুকে তা নিয়ে কটূক্তি করেছেন, এটা অন্যায়। যারা উচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে এ ধরনের অবমাননাকর কাজ করে, তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে।’
প্ল্যাকার্ডগুলোতে লেখা ছিল, ‘পাবলিক প্লেস আর প্রাইভেট প্লেসের পোশাক কখনও এক নয়’, ‘পৃথিবীর সর্বোচ্চ ধর্ষণপ্রবণ রাষ্ট্রগুলোতে নারীরা ছোট পোশাক পরে, ‘যাদের নাই কমনসেন্স, ছোট পোশাকে তারাই করে নুইসেন্স, ‘জ্ঞ্যান বিজ্ঞান আমদানি করুন, অশ্লীল পোশাক নয়’, ‘উচ্চ আদালত নিয়ে কটূক্তিকারীদের বিচার চাই’।
মানববন্ধনে হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যব্যবস্থা বিভাগের শিক্ষার্থী মুহম্মদ মাহদী হাসান বলেন, ‘গত ১৬ আগস্ট একটি মামলার পর্যবেক্ষণে উচ্চ আদালত পোশাকের স্বাধীনতার নাম দিয়ে যারা পশ্চিমা অপসংস্কৃতি আমদানি করছে, তাদের বিরুদ্ধে বলেছেন। আমরা উচ্চ আদালতের এ সুন্দর পর্যবেক্ষণ ও বক্তব্যকে স্যালুট জানাই।’
তিনি বলেন, ‘পাবলিক প্লেস আর প্রাইভেট প্লেসের পোশাক কখনও এক নয়। পাবলিক প্লেসে কেউ অশালীন পোশাক পরলে তা অনেকের জন্য বিরক্তি বা নুইসেন্সের কারণ হতে পারে। আর পাবলিক নুইসেন্স এক ধরনের ক্রাইম।’
মানববন্ধনে মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী আবু মুরসালিন বলেন, ‘পৃথিবীতে সর্বোচ্চ ধর্ষণপ্রবণ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইডেন, কোস্টারিকা, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি ইত্যাদি রাষ্ট্রগুলো রয়েছে। এ রাষ্ট্রগুলোতে অনেক নারীকেই তুলনামূলক ছোট পোশাক পরতে দেখা যায়। এ দুই বিষয়ের মধ্যে কোনো সম্পর্ক রয়েছে কি না, তা অবশ্যই গবেষণার বিষয়।’
মানববন্ধনে ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী শুভ খান বলেন, ‘পশ্চিমা রাষ্ট্র থেকে যদি কিছু আনতেই হয়, তবে জ্ঞান-বিজ্ঞান আনা উচিত, অপসংস্কৃতি নয়।’
‘ছোট পোশাক মানসিক ধর্ষণের মতো, বিচার করা উচিত’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচিতে দাবি করা হয়, যে মেয়েরা পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক পরে, তারা মানসিকভাবে ধর্ষণ করে।
বাংলা বিভাগের ৪৮তম আবর্তনের শাহরিয়ার ইমন বলেন, ‘পাবলিক প্লেসে মানুষকে সিডিউস বা যৌনতায় প্ররোচিত করে এমন পোশাক পরা অন্যায়। কাউকে যৌনতায় উদ্বুদ্ধ করতে অবশ্যই তার সম্মতি নেয়া বাধ্যতামূলক। কারও সম্মতি ব্যতিরেকে তাকে যৌন প্রলুব্ধ বা প্ররোচিত করা এক ধরনের মানসিক ধর্ষণ।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন
ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ৪৫তম আবর্তনের ইসমাইল হোসেন রাকিব বলেন, ‘যে অপরাধ করে আর যে ছোট পোশাক পরে অপরাধকে উসকে দেয় দুইজনই সমান অপরাধী। তাই যে অপরাধ করল, তার যেমন বিচার হচ্ছে আর যে ছোট পোশাক পরে অপরাধীকে উসকে দিচ্ছে তাকেও আইনের আওতায় এনে বিচার করা উচিত।’
প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের ৪৮তম আবর্তনের মশিউর রহমান বলেন, “অশালীন পোশাকের কথা উঠলে অনেকে বলে, ‘আমার শরীর আমার পছন্দ’। কিন্তু এ বক্তব্য যতটুকু সত্য, তার থেকে বড় সত্য হচ্ছে, একজনকে বিরক্ত করার অধিকার আরেকজনের নেই। সুতরাং পাবলিক প্লেসে কোনো পোশাক নুইসেন্স বা বিরক্তি তৈরি করছে কি না তা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।”
যে ঘটনায় এই মানববন্ধন
স্লিভলেস টপ পরা এক তরুণীকে নরসিংদী রেলস্টেশনে হেনস্তার অভিযোগে গ্রেপ্তার মার্জিয়া আক্তার শিলাকে জামিন দেয়ার সময় হাইকোর্টে এক বিচারকের মন্তব্য নিয়ে আলোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ১৬ আগস্ট মার্জিয়াকে ছয় মাসের জামিন দেয়।
মার্জিয়ার আইনজীবী মো. কামাল হোসেনের বরাতে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, শুনানির সময় আদালত দেশের কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে তরুণীর পোশাক সংগতিপূর্ণ কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছে। ওই তরুণী যে পোশাক পরেছিলেন, সেটি দেশের সবচেয়ে ‘ফাস্ট এরিয়া’ গুলশান-বনানীতেও কোনো মেয়ে পরে রাস্তায় বের হন না।
গণমাধ্যমে এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর তুমুল সমালোচনা হয়। আর ১৭ আগস্ট মার্জিয়ার আইনজীবী কামাল হোসেন ফেসবুকে সমালোচনার বিষয়টি হাইকোর্টের একই বেঞ্চের নজরে এনে সমালোচনাকারীদের শাস্তি দাবি করেন।
আদালত ফেসবুকে মন্তব্যকারীদের বিষয়ে আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে স্ক্রিনশট জমা দিতে বলেছে।
পাশাপাশি হাইকোর্ট বেঞ্চটির জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, ‘আমরা তো আদেশে পোশাক নিয়ে কিছুই লিখিনি, আমরা ভিডিও দেখে আইনজীবীদের কাছে শুধু জানতে চেয়েছি।
‘ভিডিও দেখে রাষ্ট্রের কাছে জানতে চেয়েছি, এমন ড্রেস পরে এমন গ্রাম এলাকায় যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ কি না।’
কামাল হোসেন জানান, জামিন শুনানির সময় তরুণী যে পোশাক পরেছিলেন, সেটি কোনো সভ্য দেশের পোশাক হতে পারে কি না, সেই প্রশ্ন আদালত তুলেছে। তবে তার মতে, বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে সমালোচনা করার সুযোগ নেই।
আর এই বেঞ্চ জামিন দিলেও সেই আদেশ চেম্বার আদালত স্থগিত করে দেয়ায় মার্জিয়া মুক্তি পাননি।