আফগান নারী, শিশু ও মানবাধিকার-বিষয়ক আমেরিকার বিশেষ দূত রিনা আমিরি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোকে আফগানিস্তানের নারী অধিকার ও মানবাধিকারের বিষয়ে উচ্চকণ্ঠে কথা বলার আহ্বান জানিয়েছেন।
সৌদি গেজেটে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আমিরি বলেছেন, তালেবানের ব্যাখ্যাকে (নারীবিষয়ক ধর্মীয় বিধিনিষেধ) মোকাবিলায় সৌদি আরবের নেতৃস্থানীয় উচ্চকণ্ঠ হওয়া উচিত। কারণ সামগ্রিকভাবে মুসলিম বিশ্ব সৌদি আরবের দিকেই তাকিয়ে থাকে।
তিনি বলেন, ‘আমি মুসলমান, আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা এবং ইতিহাস থেকে জানি যে ইসলামই প্রথম ধর্ম, যা নারীদের অধিকার দিয়েছে। আমি মুসলিম দেশগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি, যারা তালেবানের ব্যাখ্যাকে চ্যালেঞ্জ করবে এবং সেখানে সাধারণ আফগানদেরও সম্পৃক্ত করে তালেবানদের না বলবে।’
আমিরি আরও বলেন, ‘ইসলাম একটি ধর্ম, যা মানবাধিকার ও নারী অধিকারের সঙ্গে অনেক বেশি সমন্বিত।’
তালেবান ক্ষমতায় আসার আগে আফগানিস্তানে মেয়েদের ক্লাসরুম
তিনি বলেন, এ ছাড়া জিসিসি ও ওআইসির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো আফগানদের দেখাতে পারে যে তারা সাধারণ আফগানদের ত্যাগ করেনি এবং মুসলিম বিশ্বের ভাই ও বোনেরা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং ইসলামের কাঠামোর মধ্যে তাদের অধিকার রক্ষা হবে।
এ সময় তিনি ওআইসি ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত আফগানিস্তানের মানবিক ত্রাণ তহবিলে সৌদি আরবের ৩০ মিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রশংসা করেন।
আমিরি বলেন, ‘এই মুহূর্তে যেসব প্রকল্প রয়েছে তার জন্য আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। এই কাজটি আমাদের সবাইকে একসঙ্গে করতে হবে। মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই আফগান জনগণকে সমর্থন দিতে হবে।’
তালেবানদের ক্ষমতা দখলের এক বছর পর আফগানিস্তানের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে একটি বড় ট্র্যাজেডি হিসেবে আমিরি বর্ণনা করেছেন।
তালেবান বলছে, শিগগিরই চালু হবে মেয়েদের স্কুল
তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি যে আফগানিস্তানে ২০ বছরের প্রচেষ্টায় একটি প্রজন্ম তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে সেখানকার নারীরা, যারা সমাজের প্রতিটি স্তরে, সরকারের ঊর্ধ্বতন স্তরে, সংসদে, সুশীল সমাজের অগ্রভাগে ছিলেন। কর্মী হিসেবে, বিচারক থেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ সব পেশায় তাদের বিচরণ ছিল। তালেবানরা ক্ষমতা দখলের পর রাতারাতি জনগণের অধিকার কেড়ে নেয়।’
তিনি দাবি করেন, সেখানকার পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে, গত ২৩ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত নারীদের অধিকার ও চলাফেরাকে সীমাবদ্ধ করতে অন্তত ১৬টি ডিক্রি জারি করা হয়েছে।
অনেক সেক্টরেই মেয়েদের কাজ করতে বাধা দেয়া হচ্ছে। মাধ্যমিক শিক্ষা থেকে নারীদের নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাদের পোশাকের ক্ষেত্রেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তাদের প্রতিটি স্তরের স্বাধীনতা, এমনকি তাদের চলাফেরার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে।
তালেবানের ক্ষমতা দখলের আগে আফগান গণমাধ্যমে নারী উপস্থাপক
আমিরি বলেন, ‘সেখানকার নারীরা মনে করেন যে তাদের কারাগারে রাখা হয়েছে। তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা হারিয়ে ফেলছেন।’
বাইরে থেকে আফগান নারীদের অধিকারের বুলি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, এমন ধারণাকেও আমিরি উড়িয়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, আফগান নারীরা ২০ বছর ধরে নিজেদের অধিকারের বিষয়ে তাদের সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করেছেন, তারা ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের কাছেও গিয়েছিলেন এবং বয়স্কদের কাছেও পৌঁছেছিলেন।
তিনি বলেন, ‘তালেবানরা আফগান জনগণের চাওয়াকে সম্মান করে না। যদি তালেবানরা এখন যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকে চলতে থাকে। অর্থাৎ মেয়েদের অধিকার দিতে অস্বীকার করে, পরিবারগুলোকে তাদের মেয়েদের স্কুলে যেতে এবং কাজ করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করে, তাহলে ব্যাপকভাবে দেশত্যাগের ঘটনা ঘটবে। দেশটি আরও দরিদ্র হবে। শেষ পর্যন্ত দেশটি অস্থিতিশীলতার দিকে চলে যাবে। আশাহীন দেশে পরিণত হবে।
এমনকি মৌলবাদও বৃদ্ধি পাবে। ফলে এটি শুধু আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যাই থাকবে না, বিশ্বের জন্য একটি ঝুঁকি তৈরি করবে। সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে পড়বে।
আমিরির মতে, সন্ত্রাসবাদ আসে আশার অভাব থেকে এবং কট্টরপন্থি সমাজ থেকে।
তবে তিনি মনে করেন, কিছু তালেবান সদস্য আছে যারা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেন। তবে তা তালেবানের সামগ্রিক নীতি ও চিন্তার বৈচিত্র্যকে প্রতিফলিত করে না।
এদিকে তালেবান বলছে, নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে নয় তারা। গত জুলাইয়ে ইসলামিক আমিরাত আফগানিস্তানের ধর্মীয় পণ্ডিতদের প্রধান শেখ ফকিরুল্লাহ ফাইক বলেছিলেন, ইসলামিক আমিরাতের সর্বোচ্চ নেতা মাওলাবি হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা ষষ্ঠ শ্রেণির ঊর্ধ্বে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল পুনরায় খোলার বিপক্ষে নন।
ইসলামিক আমিরাত আফগানিস্তানের ধর্মীয় পণ্ডিতদের প্রধান শেখ ফকিরুল্লাহ ফাইক
তিনি সে সময় বলেছিলেন, মেয়েদের স্কুলগুলো পুনরায় খোলায় দেরি হওয়ার একমাত্র কারণ হলো তালেবান চাচ্ছে পুরুষ ও নারী শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুম আলাদা করতে। শিগগিরই মেয়েদের জন্য স্কুলগুলো আবার চালু হবে। আমাদের সব মন্ত্রী ও নেতা এ বিষয়ে একমত।
এর আগে তালেবানের পক্ষ থেকে এর আগে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ স্থগিত করে দেয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীদের নিরাপত্তা ও উপযুক্ত পরিবেশের অভাব থাকার কারণেই এমন পদক্ষেপ বলে জানায় তালেবান।
সেখানকার নারীরা মনে করেন যে তাদের কারাগারে রাখা হয়েছে। তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা হারিয়ে ফেলছেন।
আফগান নারী অধিকার কর্মী শাহলা আরেফি বলেন, ‘মেয়েদের স্কুলে যাওয়া আটকানো আফগানিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করবে।’
নারী অধিকার কর্মী মনিসা মুবারিজ বলেন, ‘এক বছর হয়ে গেল আমরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে বাস করছি। আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে? কেন আমাদের শিক্ষা কেড়ে নেয়া হয়েছে?’
এর আগেও শেখ ফকিরুল্লাহ ফাইক মেয়েদের স্কুল বন্ধ করার বিষয়ে তালেবান সরকারের সমালোচনা প্রকাশ করেছিলেন এবং ইসলামি কাঠামোর মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণির ঊর্ধ্বে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল পুনরায় চালু করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।