বসিলা থেকে উত্তরার কামারপাড়া রুটে চলা প্রজাপতি পরিবহনের একটি বাসে কল্যাণপুর স্টপেজ থেকে উঠে দেখা গেল সংরক্ষিত নারী আসনের একটিতে বসে আছেন পুরুষ যাত্রী। ওদিকে বেশ কয়েকজন নারী দাঁড়িয়ে।
সংরক্ষিত আসনে আপনি বসলেন কেন- প্রশ্ন করতেই তেলেবেগুনে ক্ষেপে উঠেন সেই যাত্রী। শুরু করেন তর্ক বিতর্ক।
নানা যুক্তি তুলে ধরে তার মোদ্দা কথা, ‘আমি আগে থেকেই বসে আছি। উঠব না। নিয়ম কেউ মানে না, আমি মানব কেন?’
বাসের আসনের ওপরেই তো লেখা আছে, এটি কেবল মেয়ে, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য। সেই আসনে পুরুষ যাত্রী বসে থাকার পরও আপনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন- বাসের চালককে প্রশ্ন রাখতেই তিনি বলেন, ‘কেন লিখছি সেইটা জানেন, কেন মানি না সেইটাও জানেন। এই সব কেউ মানে না।’
বাসে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আসন সংরক্ষণের বিষয়টি এক যুগেরও বেশি হয়ে গেল। সেই ২০০৮ সালে করা এই আইন অমান্য করলে বেশ কঠিন সাজার কথাও উল্লেখ আছে।
বাসে সংরক্ষিত নারী আসনে বসে আছেন পুরুষ যাত্রী। ছবি: নিউজবাংলা
সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮–এর ৯২(২) ধারা অনুযায়ী, যদি সংরক্ষিত আসনে অন্য কোনো যাত্রী বসেন, তাহলে ১ মাসের কারাদণ্ড অথবা ৫০০০ টাকা জরিমানার বিধান করা হয়েছে।
তবে অন্য অনেক আইনের মতো এই বিধানটিও কাজীর গরুর মতো হয়ে গেছে, যেটি আসলে কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই।
ভুক্তভোগী নারীরা এও জানান, তাদের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে অনেকাংশের কটূ কথা শুনতে হয়। দল বেঁধে তেড়ে আসে কিছু মানুষ। এ কারণে চুপ থাকেন তারা।
বাসে ভাড়াসহ শৃঙ্খলা কোনো বিষয়ে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে ব্যর্থ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর চেয়ারম্যানের কাছে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি অনুরোধ করেছেন ইতিবাচক সংবাদ লেখার। তবে বাসে বাসে এই অনিয়ম আর বিআরটিএর চোখ বন্ধ রাখার মধ্যে ইতিবাচক কী লেখা যায়, সেটি অবশ্য বলে দেননি তিনি।
সংরক্ষিত নারী আসনের বিষয়টি নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে বিভ্রান্তিও আছে। এ নিয়ে বাসে তর্ক বিতর্ক উঠলেই কেউ কেউ কথা তোলেন, তাহলে নারীরা পুরুষদের আসনে কেন বসবে।
তবে সংরক্ষিত নারী আসন মানে এই না যে সেই নয়টি আসনের বাইরের বাকি সব আসন পুরুষ যাত্রীদের জন্য। যিনি আগে আসবেন, তিনিই সেসব আসনে বসার অধিকারী। অন্যদিকে নারী বা শিশু এলেই সংরক্ষিত আসন ছেড়ে দিতে হবে।
প্রজাপতি পরিবহনের সেই বাসে নারী আসনে বসে থাকা যাত্রী যখন গোয়ার্তুমি করেই যাচ্ছিলেন, তখন অন্য কয়েকজন পুরুষ যাত্রী তার পক্ষেই কথা বললেন।
পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন পুরুষ যাত্রী টিপ্পনি কেটে বলে উঠেন, ‘বাসে উঠলেই সিট নিয়ে খালি নারীবাদী কথাবার্তা।’
বাসে চালকের সহকারী তখন তাকে বলেন, ‘আপনি আর কথা বাড়ায়েন না। যা উত্তর দেওনের, আমি তো দিয়া দিছি।’
কিন্তু কথা সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। টিপ্পনি কাটা সেই যাত্রীর সুরেই অন্য একজন বলে উঠলেন, ‘আমরা যে দাঁড়িয়ে আছি, আমাদের সিটে কেন নারীরা বসেছেন?'
অর্থাৎ তিনি বুঝেছেন, সংরক্ষিত নারী আসনের বাইরের সব আসন বুঝি পুরুষের।
তখন তাকে সংরক্ষিত আসনের মানে এবং বাকি আসনগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সবার বসার অধিকারের বিষয়টি বুঝিয়ে বললে তিনি আবার বলেন, 'তাহলে সব সিটেই নারীদের নিয়ে যেতে হবে। ছেলেদের গাড়িতে ওঠার দরকার কী?'
যুক্তি পাল্টা যুক্তি, তর্কাতর্কির মধ্যে চুপচাপ থাকা নারী যাত্রীরা ততক্ষণে মুখ খুলতে শুরু করেছেন।
দাঁড়িয়ে থাকা এক নারী বলেন, ‘আমি প্রতিদিন এই রুটে চলাচল করি। এসব বলে লাভ নাই এদের। ছেলেরা দাঁড়িয়ে থাকলে তাদের তো যৌন হেনস্তার শিকার হতে হয় না। আর আমাকে এবং আমার দেখা অনেককেই প্রতিনিয়ত গাড়িতে দাঁড়িয়ে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। এখনো ভিড়ের মাঝে সেই আতঙ্ক নিয়েই দাঁড়িয়ে আছি।’
তবে সব পুরুষই যে অসংবেদনশীল তেমন নন। কেউ কেউ নারী আসলে সংরক্ষিত আসন ছেড়ে দেন। বহু জন আছেন যারা নারী বা শিশু দেখলে নিজের আসন ছেড়ে বসতে দেন।
এমন এক সহমর্মী পুরুষকে দেখা গেল যিনি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নারীকে বসতে দিয়ে তার আসনটা ছেড়ে দেন।
যে যাত্রী যৌন হয়রানির শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তিনি যে তা শুধু কথার কথা বলেছেন, তেমনটি নয়। বেশ বড় আকারের নমুনা নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় গণপরিবহনে চলাচল করতে গিয়ে অন্তত ৬৩ দশমিক ৪ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন। এসব হয়রানির মধ্যে রয়েছে যৌন হয়রানি, বডি শেমিং, আপত্তিকর স্পর্শ, লিঙ্গ বৈষম্য।
দাঁড়িয়ে থাকা নারী যাত্রীর দুঃসহ অভিজ্ঞতা
বলাই বাহুল্য দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরাই এসব অস্বস্তিকর ও মানহানিকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন।
চলতি বছরের মাঝামাঝি আঁচল ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার করা সেই জরিপে দেখা গেছে যৌন নিপীড়নের শিকার নারীদের ৭৫ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদেরকে অন্যযাত্রীদের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে বেশি। ২০ দশমিক ৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদের হয়রানি করেছেন পরিবহনের সহকারী বা হেলপাররা।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ১১ দশমিক ৯ শতাংশ জানিয়েছেন, চলাচলের সময় তাদেরকে আপত্তিকরভাবে স্পর্শ করা হয়েছে। ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী জানিয়েছেন, বাসে যথেষ্ট জায়গা থাকা সত্ত্বেও অন্য যাত্রীরা ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। ইচ্ছাকৃতভাবে হালকা স্পর্শ করে গেছেন ১৭ দশমিক ৯ শতাংশকে।
এ ছাড়া ১৪ দশমিক ২ শতাংশ ইচ্ছাকৃত ধাক্কার শিকার হয়েছেন। ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী জানিয়েছেন, তারা বাজে মন্তব্যের শিকার হয়েছেন।
আসন সংরক্ষণ নেই অনেক বাসেই
এই পরিস্থিতিতেও সংরক্ষিত আসন নিশ্চিত করা নিয়ে সরকারি পরিবহন সংস্থা বিআরটিসি ছাড়া অন্য বাসের চালক ও সহকারীদের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না, এমনকি আসনের ওপর সংরক্ষিত কথাটি লিখে রাখতে মালিকপক্ষের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেটি পালনের গড়িমসি চোখে পড়ে।
মোহাম্মদপুর থেকে উত্তরা রুটে চলা আলিফ পরিবহনের একটি বাসে উঠে দেখা যায় ‘নারী শিশু, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত আসন’ লেখা উঠিয়ে ফেলা হয়েছে।
চালকের কাছে লেখা না থাকার কারণ জানতে চাইলে উত্তর দিতে চান না। পরে বলেন 'এই লেহা কতবার আয়ে আর যায়। উইঠ্যা গেছে আর লাগান অয় নাই। কোম্পানি লেইখ্যা দেয় এটা। না দিলে আমরা জানি না।’
আগারগাঁওয়ে স্টপে দাঁড়িয়ে বৈশাখী পরিবহনের একটি বাসেও সংরক্ষিত আসন লেখাটি দেখা যায়নি।
ইতিবাচক সংবাদ চান বিআরটিএ চেয়ারম্যান
কেন ১৪ বছরেও সংরক্ষিত নারী আসনের বিধান কার্যকর করা যায়নি- এমন প্রশ্নে সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ‘গণপরিবহনে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীর জন্য নয়টি আসন সংরক্ষণের নীতিমালা অনেক আগে থেকেই কার্যকর। কেউ যদি এটা না মানে, এই নীতি অনুযায়ী আমাদের মোবাইল কোর্ট তাকে জরিমানা করবে। সংরক্ষিত নয়টি আসনে তারা বসার পর বাকিগুলোতে নারী-পুরুষ সমঝোতা করে বসবে।’
বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন বাসের অভিজ্ঞতা জানিয়ে আইনের প্রয়োগ না থাকার বিষয়টি স্মরণ করালে তিনি সুনির্দিষ্ট জবাব না দিয়ে বলেন, ‘আসলে সব জায়গায় তো মোবাইল কোর্ট বসানো সম্ভব নয়। কেউ কেউ নিয়ম মানেন, কেউ কেউ মানেন না।’
সব শেষে বিআরটিএ চেয়ারম্যান একটি অনুরোধও করেন। বলেন, ‘আপনি রিপোর্টার। আপনি ইতিবাচক সংবাদ করবেন।’
‘নারীর প্রতি সমাজের অসংবেদনশীল মনোভাবের প্রকাশ বাসে’
বাসে সংরক্ষিত আসন নিশ্চিত করতে না পারা আর এ নিয়ে যেসব কথা কিছু যাত্রী তোলেন, সেগুলো নারীর প্রতি পুরুষের নেতিবাচক সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রকাশ বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শুভ্রা চৌধুরী। সেই সঙ্গে নারীদের জন্য সবচেয়ে কষ্টদায়ক আসনগুলো বাছাই করারও সমালোচনা করেছেন তিনি।
নিউজবাংলাকে এই নারী অধিকারকর্মী বলেন, ‘নারীর প্রতি সমাজ সংবেদনশীল হলে সুন্দর একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে বলে মনে করি।’
সংরক্ষিত আসন কেন, তা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে গণপরিবহনে নারীরা হলো সংখ্যালঘু। সংখ্যালঘুদের জন্য সাংবিধানিকভাবেই চাকরি কোটা, শিক্ষা কোটাসহ নানা ধরনের সুবিধা দেয়া হয়েছে। গণপরিবহনে নারী কম এবং নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তাই তাদের চলাফেরাকে মসৃণ করার জন্যই আসন সংরক্ষণ করতে হবে।’
নারীর প্রতি সংবেদনশীলতা না থাকার কারণে সবচেয়ে বাজে আসনগুলো তাদের জন্য সংরক্ষণ করা হয় বলেও মূল্যায়ন তার। তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সংরক্ষিত আসনগুলো থাকে ইঞ্জিনের পাশে। নারীকে এভাবে ইঞ্জিনের তাপে কয়লা বানানোর ষড়যন্ত্র প্রহসনমূলক।’
শুভ্রা চৌধুরী বলেন, ‘গণপরিবহন যত দিন পর্যন্ত পর্যাপ্ত না হচ্ছে এবং নারীদের নিরাপত্তা যত দিন পর্যন্ত নিশ্চিত না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত অবশ্যই সংরক্ষিত আসন থাকতে হবে, প্রয়োজনে সংখ্যাও বাড়াতে হবে। আর অন্যান্য আসনগুলোতে নারী ও পুরুষ উভয়েরই আসন গ্রহণ করবার সমান সুযোগ বা অধিকার রয়েছে’-এটিও বাস্তবায়ন করতেই হবে।