ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অবসর নেয়া ব্যবসায়ী মো. সাইদুজ্জামান। বয়স এখন ৬৮। স্ত্রীর মৃত্যুর পর থাকছেন ছেলে-মেয়েদের কাছে। কিন্তু একসময় তার মধ্যে যে স্বতঃস্ফূর্ত ভাব ছিল, সেটি এখন আর নেই। কেমন এক নিসঙ্গতা যেন ভর করেছে তার মধ্যে।
সাইদুজ্জামানের ছেলে সারোয়ার জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আম্মু মারা যাওয়ার পর থেকে আব্বুর কোনো চাহিদা নেই। আগে যেমন আম্মুকে নিজের পছন্দের খাবার রান্না করতে বলতেন, এখন কাউকে আর সে কথা বলেন না। পাশাপাশি তিনি ব্যবসা থেকে অবসর নেয়ার পর আত্মীয়দের মধ্যেও তার গুরুত্ব যেন দিন দিন কমছে। আগে যেমন পরিবারে কোনো সমস্যা হলেই সেটি সমাধানের জন্য তার ডাক পড়ত, এখন আর কেউ তেমনটা করে তাকে ডাকেন না। তার সময় কাটে বিছানায় শুয়ে থেকে বা টেলিভিশন দেখে। কেমন যেন এক নিঃসঙ্গতায় ভুগছেন।
‘বিভিন্ন সময় তিনি মানুষের সঙ্গে মোবাইল ফোনে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে থাকেন। পরিবারে কোনো অনুষ্ঠান হলে বলা হয়, তোমার আব্বু থাক, ওনাকে টানা-হেঁচড়া করার প্রয়োজন নেই। তিনি যে তার বিষয়গুলো মন খুলে বলবেন সে রকম কেউ তার চারপাশে নাই। সামাজিকভাবে তিনি তার গুরুত্ব যেন হারিয়ে ফেলেছেন। যাদের তিনি উপকার করেছেন, তাদের কাছ থেকেও। পরিবারের মধ্যে থেকেও তিনি পরিবার-বিচ্ছিন্ন।’
সাইদুজ্জামানের মতোই অবস্থা অবসরে যাওয়া বেশির ভাগ বাবাদের। মায়েরা যেমন স্বাভাবিকভাবে নিজেদের আদর আর ভালোবাসা প্রকাশ করেন, বাবারা যেন তার বিপরীত। বাবারা সহজে তাদের আদর-ভালোবাসা প্রকাশ করেন না। এ কারণে স্বাভাবিকভাবে সন্তানদের সঙ্গে তাদের একটি দূরত্ব তৈরি হয় বয়স হয়ে গেলে।
সন্তান যেমন মাকে মন খুলে সব কথা বলেন, বাবার ক্ষেত্রে এমনটা খুব কমই দেখা যায়। সে জায়গায় বরং সন্তানরা বাবাকে একটু ভয়ের চোখে দেখতেই অভ্যস্ত। পাশাপাশি সমাজ বাস্তবতায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উপার্জনের দায়িত্বটুকু বাবাদেরই পালন করতে হয়। আর এ কারণে বাবাদের বেশির ভাগ সময় কাটে ঘরের বাইরে। তাই ইচ্ছা থাকলেও যেন সন্তানের কাছে আসা তেমন একটা হয়ে ওঠে না।
কর্মস্থলের পেশাদারত্ব বজায় রাখতে গিয়ে তেমন কোনো বন্ধুও আর শেষ বয়সে গড়ে ওঠে না। এ কারণে প্রিয় সঙ্গিনীর অনুপস্থিতি যেন তাদের মধ্যে তৈরি করে গভীর একাকিত্ব বা বিচ্ছিন্নতা বোধ।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, ষাটোর্ধ্ব বাবাদের মধ্যে এই ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ বা একাকিত্বের হার বেশি।
সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, ‘আমাদের দেশে যেটা দেখা যায়, বাবাদের নিঃসঙ্গতা সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয়, যখন বাবারা কর্ম থেকে অবসর নেন। আরেকটি প্রেক্ষাপট হয়, যখন সন্তানদের কর্মব্যস্ততা বা কাজের প্রয়োজনে সন্তানরা দূরে অবস্থান করে। অথবা নিজেদের মধ্যে দূরত্ব যখন তৈরি হয়, তখন কাজ থেকে অবসরে যাওয়া বাবাদের মধ্যেও নিঃসঙ্গতা তৈরি হয়।
‘বাংলাদেশে যারা একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমা অতিক্রম করেছেন, প্রবীণ হয়েছেন, তাদের মধ্যেই এই নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব বেশি কাজ করে। আমাদের যে পর্যবেক্ষণ বা সমাজ বাস্তবতা, সেটা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সাধারণভাবে মনে করা হয় বাবা যখন প্রবীণ হবেন বা স্বাভাবিক কাজ থেকে অবসর নেবেন, তার বোধ হয় আর কিছু করার নেই। ধর্মকর্ম করা ও বাসায় অলস সময় কাটানো ছাড়া।’
তিনি বলেন, ‘তাদের কর্মস্পৃহাটা আমরা দুর্বল করে দেই। একটা সময় তিনি যেভাবে সন্তানকে দেখতে চান বা আগের মতো সব কিছুকে উপলব্ধি করতে চান বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নিতে চান, এই বিষয়গুলো থাকে না।
‘আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে যারা উচ্চশিক্ষিত, তারা হয়তো এই প্রচলিত ধারণা থেকে বের হয়ে আসবেন। কিন্তু আমরা এটা দেখছি না। বরং তাদের মধ্যে নতুন একটি বিষয় দেখা যাচ্ছে, সেটা হলো প্রবীণ কেন্দ্র বা সেবা নিবাসে বাবাদের পাঠিয়ে দেয়া, পারিবারিক সেবার পরিবর্তে। একেক জনের বাস্তবতা একেক রকম থাকে। যখন বাবারা আগের মতো আর রেসপন্স পান না, তখন তার মধ্যে নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব ভর করে।’
প্রবীণদের সমাজের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার সুযোগ তৈরি করে দিলে এ ধরনের সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সহজ হবে বলে মত এই সমাজ বিজ্ঞানীর। তৌহিদুল হক বলেন, ‘যেসব প্রবীণের আর্থিক অসংগতি রয়েছে বা অন্য কোনো ধরনের সম্পর্কজনিত সংকট রয়েছে বা পদমর্যাদার কারণে এই ঘটনা কারও সঙ্গে আলোচনাও করতে পারছেন না, এ ধরনের প্রবীণদের মধ্যে এই একাকিত্ব আরও বেড়ে যায়। প্রবীণবান্ধব সংস্কৃতি তৈরি না হলে এই সমস্যাগুলো থেকেই যাবে।
‘অনেক দেশ যে মডেলটি ব্যবহার করে প্রবীণদের এই একাকিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে, সেটা হলো এদের সক্রিয় রাখা। সেই কাজগুলো আমাদের এখানে অনুপস্থিত। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে দেখা যায় তাদের বিভিন্ন কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট কাজে অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। এগুলো আমাদের এখানে অনুপস্থিত।’
তিনি বলেন, ‘প্রবীণরা অবসরের পর একটি মর্যাদাপূর্ণ ও ক্রিয়াশীল জীবন প্রত্যাশা করেন। এ জায়গায় আত্মীয়, প্রতিষ্ঠান ও পরিবারকে তিনি কাছে পেতে চান। তিনি তার যৌবনে যেমন সবার জন্য করেছেন, এই সময়ে সবাই তার জন্য করবেন- এমন একটি প্রত্যাশা তিনি রাখতে চান।
‘এখন যখন সে রকম হয় না, তখন তার মধ্যে নিঃসঙ্গতার বোধ তৈরি হয় এবং অনেক জটিল হিসাব তিনি মেলাতে পারেন না। একপর্যায়ে তার কাছে মৃত্যুই মনে হয় একমাত্র নিশ্চিত ভবিষ্যৎ, সেদিকেই তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। এই অবস্থা থেকে তাকে বের করে আনতে সবার অংশগ্রহণ প্রয়োজন।’