নরসিংদী রেলস্টেশনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন একদল তরুণী। কারও পরনে জিন্স-টিশার্ট, কেউ পরেছেন ট্রাউজার-টপস। তারা সেলফি তুলছেন, কথা বলছেন স্টেশনের লোকজনের সঙ্গে, হইহুল্লোড়ে মাতিয়ে তুলছেন চারপাশ।
রেলস্টেশনে এই দৃশ্য দেখা গেছে শুক্রবার সকালে। স্টেশনেই আড়াই ঘণ্টা ঘুরে ট্রেনে চেপে চলে যায় দলটি।
এই রেলস্টেশনেই ৯ দিন আগে জিন্সের প্যান্ট আর টপস পরার কারণে হেনস্তার শিকার হন এক তরুণী। সেই ভিডিও ভাইরাল হলে দেশজুড়ে সমালোচনা চলে। সংবাদমাধ্যমগুলো হেনস্তার খবর প্রকাশ করতে শুরু করলে ঘটনার দুদিন পর পুলিশ ও স্টেশন কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে; হেনস্তাকারীদের গ্রেপ্তারে তৎপর হয়।
ওই ঘটনার প্রতিবাদে শুক্রবার সকালে ইচ্ছেমতো পোশাক পরে রেলস্টেশনে ঘুরতে যায় তরুণীদের দলটি। ফেসবুকে নানা গ্রুপ যুক্ত এই নারীরা পরিকল্পনা করেই ঘুরতে যান সেখানে। তাদের ঘুরে বেড়ানোর ছবি এখন ভাইরাল ফেসবুকে।
নরসিংদী রেলস্টেশনের ভারপ্রাপ্ত স্টেশন মাস্টার এ টি এম মুছা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আজ (শুক্রবার) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে স্টেশনের ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে নামেন তরুণীরা। তখন আমি বসে ছিলাম রেল সিগন্যাল মাস্টারের কক্ষে। এ সময় তারা এসে জানান যে তারা বিভিন্ন সংগঠনের সদস্য। হেনস্তার ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে তারা এসেছেন।
‘তারা ওই তরুণীর হেনস্তার ঘটনার বিষয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। আমরা তাদের সঙ্গে ছবিও তুলেছি। স্টেশনে থাকা লোকজনদের সঙ্গে তারা কথা বলেন। আমিও বেশ কিছুক্ষণ সময় দিয়েছি।’
স্টেশন মাস্টার জানান, বেলা ১১টায় উপকূল ট্রেনে চড়ে ঢাকায় চলে যায় দলটি।
ফেসবুক ঘেঁটে জানা গেছে, অগ্নি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠনের সভাপতি তৃষিয়া নাশতারানের উদ্যোগে ২০ জনের দলটি সেখানে ঘুরেছে। সঙ্গে কয়েকজন তরুণও ছিলেন।
ওই দলের সদস্য অপরাজিতা সংগীতা তার ফেসবুক আইডিতে দেয়া পোস্টে লিখেছেন, ‘নরসিংদী স্টেশনে একজন নারী পোশাকের কারণে কুৎসিত আক্রমণ ও সহিংসতার শিকার হন গত ১৮ মে। আমরা তার পাশে দাঁড়াতে চেয়েছি। তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আজ (২৭ মে) আমরা ২০ জন গেছিলাম নরসিংদী স্টেশনে।
‘আমরা জায়গাটা এবং সেখানকার মানুষগুলোকে দেখতে গেছি। তাদের সঙ্গে মানবিক যোগাযোগ স্থাপন করতে গেছি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল শান্তিপূর্ণভাবে জনপরিসরে শরীর ও পোশাকের স্বাধীনতার জায়গা রিক্লেইম করা। আমাদের বৈচিত্র্যময় শারীরিক উপস্থিতিই আমাদের বক্তব্য।’
পোস্টে তিনি আরও জানান, রেলস্টেশন ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা মেয়ে নেটওয়ার্ক নামের ফেসবুক পেজে লাইভে এসে জানানো হবে শুক্রবার রাত ১১টায়।
যা ঘটেছিল
ফেসবুকে হেনস্তার ভিডিওটি ভাইরাল হয় ১৯ মে- বৃহস্পতিবার সকাল থেকে। ঘটনাটি নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনে তার আগের দিন ভোরে ঘটে।
স্টেশন ঘুরে ১৯ ও ২০ মে দুই দোকানদার মো. আমিনুল ও ইখলাস উদ্দিন এবং ভাসমান পণ্য বিক্রেতা মো. মেহেদীর সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার। পুরো ঘটনা তারা দেখেছেন।
তারা জানান, ভোরে ঢাকামুখী ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন ওই দুই যুবক ও তরুণী। হঠাৎ পাশ দিয়ে যাওয়া এক বৃদ্ধ তরুণীকে দেখে বলে ওঠেন, ‘আপনার বাড়ি কই? কাল রাতেও এখানে এসেছেন। আজকেও আসছেন। এসব পোশাক পরে কেউ স্টেশনে আসে নাকি?’
মেয়েটির সঙ্গে থাকা হলুদ রঙের টি-শার্ট পরা তরুণ ওই বৃদ্ধকে তখন বলেন, ‘আপনি এসব কেন জিজ্ঞেস করছেন? আপনি এভাবে প্রশ্ন করতে পারেন না।’
এ নিয়ে বৃদ্ধের সঙ্গে ওই যুবকের বাগ্বিতণ্ডার মধ্যে আরেক নারী এসে মেয়েটির পোশাক নিয়ে কটাক্ষ ও গালমন্দ করতে থাকেন। ততক্ষণে চারপাশে কিছু লোক জড়ো হয়ে যায়।
ওই বৃদ্ধ ও নারীর সঙ্গে আরও কয়েকজন যোগ হয়ে তরুণী ও যুবককে গালমন্দ করতে থাকেন। ওই যুবকও তাদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে যান। একপর্যায়ে আরেক ব্যক্তি যুবককে ধাক্কা দেন। মেয়েটি তখন যুবককে নিয়ে সরে যেতে চেষ্টা করলে ওই নারী মেয়েটিকে টানাহেঁচড়া করতে থাকেন।
তরুণী ও সঙ্গে থাকা দুই যুবক সরে গিয়ে স্টেশন মাস্টারের কক্ষে আশ্রয় নেন।
প্রত্যক্ষদর্শী দুই দোকানদার আরও জানান, তখনই ঢাকাগামী চট্টগ্রাম মেইল ট্রেন চলে আসায় ওই তরুণী ও সঙ্গে থাকা প্রতিবাদকারী যুবক তাতে উঠে চলে যান। সব মিলিয়ে পুরো ঘটনাটি মিনিট দশেকের।
ভাসমান দোকানদার মেহেদী নিউজবাংলাকে জানান, ঘটনার সূত্রপাত এক নারীর কটাক্ষের জেরে।
তিনি জানান, ওই যুবক ও তরুণীকে গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকার ট্রেনে করে নরসিংদী নামতে দেখেছেন। বুধবার ভোরে তারা আবার ঢাকা যাওয়ার ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলেন। সে সময় এক নারী মেয়েটির পোশাক নিয়ে প্রথম মন্তব্য করেন।
মেহেদী বলেন, ‘ওই নারী মেয়েটাকে বলতে থাকে যে, এসব পোশাক পরে কেন ঘোরাঘুরি করছে, তার বাড়ি কই। ওই নারী মেয়েটার ভিডিও করতে নেয়। তখন মেয়েটার সঙ্গে থাকা একটা ছেলে প্রতিবাদ করতে থাকে।
‘সে সময় কালো শার্ট পরা একটা লোক ওই ছেলেকে ধাক্কা দেয়। মেয়েটা তখন মোবাইল বের করে কাউকে কল করতে থাকে। এসবের মধ্যে ওই নারী মেয়েটার দিকে তেড়ে যায়।’
ঘটনার সময় স্টেশন মাস্টারের দায়িত্বে ছিলেন নাইয়ুম মিয়া।
তিনি বলেন, ‘ভোরে আমি কন্ট্রোল রুমে বসে ছিলাম। সিলেটগামী উপবন এক্সপ্রেসকে সিগন্যাল দিচ্ছিলাম। তখন দেখি বাইরে কিছু লোক জড়ো হয়ে আছে।
‘আমি গেটের সামনে আসতেই বাঁচাও বাঁচাও করে আধুনিক পোশাক পরা এক তরুণী ও আরেক তরুণ আমার কক্ষে আসে। তাদের কাউকে ফোন দিতে দেখলাম। অল্প সময়ের মধ্যে স্টেশন ও থানা পুলিশ এসে হাজির।’
তিনি আরও বলেন, “তখন মেয়েটি বলছিল, ‘আমি এসব পোশাক পরাতে এদের সমস্যা কী? তারা আমাদের হেনস্তা করছে। বাংলাদেশের সবাই শাড়ি পরে বেড়াবে নাকি?” পুলিশ তাদের সঙ্গে কথা বলে। আমি চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা মেইল ট্রেন থামানোর জন্য সিগন্যাল দিতে ব্যস্ত হয়ে যাই।’
প্রশাসনের তৎপরতা
ঘটনা ১৮ তারিখ ভোরে ঘটে, সে সময় মডেল থানা পুলিশের এক এএসআই সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি সামলে নেন। তবে হেনস্তাকারীদের কাউকেও সে সময় আটক করা হয়নি।
এএসআই ইকবাল হোসেন পরে জানান, তিনি কারও নাম-পরিচয়ও নেননি। রেলস্টেশন কর্তৃপক্ষও সে সময় হেনস্তাকারীদের আটক করেনি, কোনো তথ্যও রাখেনি। যদিও একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী নিউজবাংলাকে জানান, এএসআইকে তারা হেনস্তার শিকার তরুণী-তরুণ ও হেনস্তাকারীদের নাম-ফোন নাম্বার টুকে রেখেছিলেন।
ঘটনার পরদিন হেনস্তার ঘটনার মোবাইল ফোনে ধারণ করা ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। নিউজবাংলাসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সে খবর প্রকাশিত হয়। তারও এক দিন পর পুলিশ ও রেলস্টেশন কর্তৃপক্ষ ঘটনাটিকে গুরুত্ব দেয় ও হেনস্তাকারীদের খুঁজতে তৎপর হয়।
তারা জানায়, ঘটনায় জড়িতদের কাউকেই শনাক্ত করা যাচ্ছে না।
পরে ২০ মে রাতে হেনস্তাকারী সন্দেহে একজনকে আটক করে ডিবি পুলিশ। পরদিন ভৈরব রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাস জানান, আটক ব্যক্তির নাম ইসমাইল হোসেন। তার বাড়ি নরসিংদী সদরের নজরপুর ইউনিয়নের বুদিয়ামাড়া গ্রামে। তিনি একজন রাজমিস্ত্রি।
সেদিনই আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদাউস আহমেদ বিশ্বাস নিউজবাংলাকে জানান, এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ২১ মে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ও ৩০ ধারা এবং দণ্ডবিধির ১৪৩, ৩২৩ ও ৫০৬ ধারায় মামলা করে। তাতে ইসমাইলকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
তবে হেনস্তাকারী নারীর কোনো খোঁজ এখনও পায়নি পুলিশ।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ভৈরব থানার উপপরিদর্শক হারুনুজ্জামান রুমেল জানান, ওই নারীর নাম শিলা আক্তার, বাড়ি সদর উপজেলা পরিষদে বলে এজাহারে লেখা হয়েছে। তবে সেই ঠিকানায় গিয়ে শিলা নামে কাউকে পাওয়া যায়নি। এলাকার কেউ তাকে চেনেনি।
ভৈরব রেলওয়ে থানার ওসি ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাসের জানান, ওই নারীকে গ্রেপ্তারে তৎপরতার কমতি নেই। তদন্তের স্বার্থে কোনো তথ্য দিতে চাননি তিনি।