তালেবান গত গ্রীষ্মে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলে নেয়। শুরু হয় নারীদের বিরুদ্ধে একের পর এক বিধিনিষেধ। নারীর স্বাধীনতাকে সীমিত করার সবশেষ ডিক্রিটি জারি হয় শনিবার। তাতে বলা হয়, এখন থেকে আপাদমস্তক বোরকা পরতে হবে আফগান নারীদের। এই খবরে তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানাচ্ছেন আফগান নারী ও অধিকারকর্মীরা।
কাবুলের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্জিয়া (ছদ্মনাম) বলেন, ‘কেন তারা নারীদের যৌনতার বস্তু হিসেবে দেখছে?
‘আমি একজন অনুশীলনকারী মুসলিম। ইসলাম আমাকে যা শিখিয়েছে তার মূল্য দেই। বোরকা নিয়ে যদি মুসলিম পুরুষের সমস্যা হয়, তবে তাদের নিজেদেরই বোরকা পরা উচিত, দৃষ্টিও নামিয়ে রাখতে হবে।’
৫০ বছরের ওই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘কেন আমাদের সঙ্গে তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো আচরণ করা হবে? এর কারণ তারা ইসলাম পালন করতে পারে না। তারা কি যৌন ইচ্ছা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না?’
অধ্যাপক মার্জিয়া অবিবাহিত। বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই। বৃদ্ধ মায়ের দেখাশোনা তিনিই করেন।
তিনি বলেন, ‘১৮ বছর আগে তালেবান আমার ভাই, আমার একমাত্র মাহরামকে একটি হামলায় হত্যা করে। তারা কি এখন আমাকে আরও শাস্তি দেয়ার জন্য একজন মাহরাম ধার দেবে?’
বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতে যাওয়ার সময় বার বার তালেবান ওই অধ্যাপককে বাধা দিয়েছে। তালেবান বলছে, একা ভ্রমণ আদেশের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
মার্জিয়া বলেন, ‘ট্যাক্সিওয়ালারা সব সময় আমাকে জিজ্ঞেস করে যে আমার মাহরাম কোথায়। যখন আমি তালেবানকে বলি আমার মাহরাম নেই, তারা মানতে চায় না। আমি একজন সম্মানিত অধ্যাপক। কিন্তু তারা (তালেবান) একটুও পাত্তা দেয় না। আমাকে রাস্তায় নামিয়ে দিতে চালকদের নির্দেশ দেয় তারা।
‘কোনো অনুষ্ঠান কিংবা ক্লাসে যেতে আমাকে কয়েক কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতে হয়েছে।’
নতুন বিধিনিষেধ আরোপের পর কাবুলের ওই অধ্যাপকের বক্তব্য আফগানিস্তানের পাশাপাশি গোটা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছে।
তালেবানের কাবুল দখলের প্রতিবাদে শুরু থেকেই সোচ্চার ছিলেন মানবাধিকারকর্মী হুদা খামোশ। গত ফেব্রুয়ারিতে নারী বিক্ষোভকারীদের ওপর তালেবানের দমন অভিযানের মুখে তিনি পালিয়ে যান নরওয়েতে। সেখানে তিনি তালেবান নেতাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। দাবি জানিয়েছিলেন নারী বিক্ষোভকারীদের অবিলম্বে মুক্তির।
তিনি বলেন, ‘তালেবান শাসন আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের স্ব-আরোপিত নিয়মের আইনগত ভিত্তি নেই। আফগানিস্তানের এই প্রজন্মের তরুণীদের কাছে ভুল বার্তা পাঠাচ্ছে তারা। এসবের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। কখনোই চুপ থাকব না।’
‘কেবল স্বামী বেছে নেয়া এবং বিয়ে করার সুযোগের চেয়েও নারীকে বেশি কিছু অধিকার দেয়া হয়েছে ইসলামে। তালেবান কেবল এই ইস্যুতে মনোযোগী। ইসলামে শিক্ষা এবং কাজের বিষয়ে যা বলা হয়েছে সেসব কিছুই তারা বলছে না।
‘২০ বছরের অর্জন রাতারাতি হারিয়েছি। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা জয় পেয়েছিলাম। সমাজ থেকে কেউ আমাদের সরাতে পারবে না।’
আফগানিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বের নীরব অবস্থানের সমালোচনা করেছেন অনেক মানবাধিকারকর্মী।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আফগান কর্মী এবং সিনিয়র গবেষক সামিরা হামিদি। তিনি বলেন, ‘গত আগস্টে তালেবানের ক্ষমতা দখলের পরও আফগান নারীদের বিশ্বাস ছিল আন্তর্জাতিক সহায়তায় নারীদের অধিকার বজায় থাকবে। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আফগান নারীদের আবারও ব্যর্থ করেছে।’
হামিদি বলেন, ‘তালেবানের সঙ্গে যারা শান্তি আলোচনায় বসেছিলেন, তাদের অনেক আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, তালেবান ক্ষমতায় এলে নারীদের ভাগ্যে কী ঘটবে তা স্পষ্ট করতে। আফসোস, আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি বোঝার সক্ষমতার অভাব ছিল তাদের।’
হামিদির সঙ্গে একমত খামোশ। তিনি বলেন, ‘বিশ্ব তাদের নীরবতা দিয়ে একটি পুরো প্রজন্মের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। একটি দেশকে তার অর্ধেক জনসংখ্যার জন্য কারাগারে পরিণত করার অনুমতি দেয়া মানবতাবিরোধী অপরাধ।’
অধ্যাপক মার্জিয়া একই ধরনের হতাশার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এমন একটি জাতি, যারা অনেক নারী নেতা তৈরি করেছে। আমি আমার ছাত্রদের বলতাম তারা যেন সব সময় নারীদের সম্মান ও সমর্থন করে।’
“প্রতিটি ‘নতুন আইন’ আমার হৃদয়কে টুকরো টুকরো করে ফেলে। যেগুলো ইসলাম এবং আফগান মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।”