সন্তান জন্মদানের মধ্য দিয়ে মাতৃত্বের জটিল অধ্যায় শুরু হয় নারীর। প্রক্রিয়াটি প্রাকৃতিক হলেও গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদান-পরবর্তী সময়গুলো একজন নারীর সামনে তৈরি করে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে প্রথমবার মা হওয়া নারীর জন্য জটিলতাগুলো বেশি প্রকট।
নতুন মা হওয়া নারীরা তাদের স্বজন, বন্ধু এমনকি অপরিচিতজনের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত পান নানান পরামর্শ ও উপদেশ। এগুলো তাদের আরও ভারাক্রান্ত করে ফেলতে পারে। নিজের মাতৃত্বের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সভিত্তিক সাইট ভাইসে এ বিষয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছেন ওয়ানা নিনেচিউ। আন্তর্জাতিক মা দিবস উপলক্ষে নিবন্ধটি বাংলায় ভাষান্তর করেছেন নুসরাত জাবীন বিভা।
সন্তান জন্মদান একটি ভীষণ একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। আমি আগে এ বিষয়ে প্রচুর পড়েছি, কথা বলেছি। এর পরও সন্তান জন্ম দেয়ার দিনটিতে আচ্ছন্ন করে রাখা উত্তেজনা, ভয় ও পরম মমতাবোধের অনুভূতির জন্য আমি তৈরি ছিলাম না। বিষয়টি চমৎকার, কিন্তু একই সঙ্গে ভীতিকর ও তীব্র একাকিত্বের।
প্রথমবার মা হওয়ার সময় আপনার প্রচুর বন্ধুসুলভ সমর্থন প্রয়োজন। কারণ আপনাকে তখন অনেক কিছু মোকাবিলা করতে হবে। তবে বাস্তবে এমনটি ঘটে না। প্রচুর মানুষ আপনাকে বলবে কী করা উচিত এবং কী উচিত নয়। তাদের অনেকে হয়তো আপনার পরিস্থিতি জানেনও না।
রাস্তার অপরিচিত লোক থেকে শুরু করে আপনার ভালো চান এমন বন্ধু, আত্মীয়, ফেসবুকের প্যারেন্টিং গ্রুপের অপরিচিত সদস্য- সবার কাছ থেকে সন্তানের পরিচর্যা, খেলনা, খাবার চিকিৎসা, অভ্যাস নিয়ে প্রচুর পরামর্শ পাবেন। আমি যখন এমন অতিরিক্ত উপদেশ পাচ্ছিলাম তখন সেগুলোর মানে বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল। সঠিক কাজটা করতে আমাকে প্রচুর ধকলও পোহাতে হয়েছে।
আমার ক্ষেত্রে তখন থেরাপি ছিল একমাত্র সমাধান। এটি সন্তান জন্মদান-পরবর্তী সময়ে আমার ও আমার সন্তানের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। আমি বুঝতে শিখেছি পারফেক্ট মা বলে কিছু নেই, বরং সন্তানের জন্য ভালো মা হওয়াটিই বেশি জরুরি। ভালো মা হওয়া মানে হলো সন্তান ও নিজের মধ্যে একটি ছন্দময় জীবন গড়ে তোলা।
মাতৃত্বের এই সময়ে আমি বেশ কিছু বিষয় শিখেছি, যা আমাকে সেই ছন্দ তৈরিতে সাহায্য করেছে।
গর্ভাবস্থা এবং সুন্দরের মানদণ্ড
গর্ভাবস্থা চলার সময় আমি মোটামুটি ভালোই ছিলাম। কোনো বমি বমি ভাব বা ব্যথা ছিল না। আমার সন্তান যখন পেটে লাথি দেয়া শুরু করল তখন শারীরিকভাবে বুঝতে পারি আমি গর্ভবতী। পুরোটা সময় খুব সক্রিয় ছিলাম। খেলাধুলা করেছি, প্রচুর হেঁটেছি, প্রায় সবকিছু খেয়েছি এবং কখনও কখনও এক গ্লাস রেড ওয়াইনও খেয়েছি। একটি জিনিসই আমি বাদ দিয়েছিলাম, সেটি হলো সিগারেট। আমি খুব ভাগ্যবান ছিলাম, কারণ আমার অতিরিক্ত ওজন বাড়েনি। যদিও মানুষ আমাকে প্রথম প্রশ্নই করত, ওজন কত বেড়েছে?
আমার ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষের মন্তব্য ছিল তুষ্টিমূলক। মানুষ বলেছে আমাকে কতটা সুন্দর দেখাচ্ছে, আর এই কথা শুনে আমার মুখ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠত। তবে দয়া করে আপনারা একজন গর্ভবতী নারীর শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে মন্তব্য করবেন না।
স্বাভাবিকভাবে জন্মদান বনাম সিজার
গর্ভে আমার সন্তানের অবস্থান বদলে যাওয়ায় প্রাকৃতিকভাবে প্রসব সম্ভব ছিল না। তাই সিজার করতে হয়েছিল। এটি আমার কাছে ছিল একটি ধাক্কা। আমি স্বাভাবিকভাবে প্রসবের জন্য সংকল্পবদ্ধ ছিলাম। সবাই আমাকে বলত এটি একটি চমৎকার সিদ্ধান্ত, অনেক সহজ এবং সন্তানের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ভালো। তাই যখন শুনলাম এটি সম্ভব নয় তখন ভেঙে পড়েছিলাম। আমি কেঁদেছি এবং প্রচুর দুশ্চিন্তা করেছি। তবে আসলে এটি কোনো বিষয়ই ছিল না। অপারেশন ঠিকঠাক হয়েছিল, আমি দ্রুত সেরে উঠেছিলাম এবং সন্তান সুস্থ ছিল।
কে কীভাবে সন্তানের জন্ম দেবে, সেটি আপনার বলার কথা নয়। ‘প্রাকৃতিকভাবে জন্মদানের আশ্চর্য’ অভিজ্ঞতা না পেলে খারাপ কিছু ঘটবে না। বিষয়টি নিয়ে আমারও একদম কোনো অনুশোচনা ছিল না।
স্তন্যদান
আমার কাছে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো জাদুর মতো ছিল। ছোট্ট মেয়েটার ওজন বাড়ছিল না, কারণ সে আমার স্তন চুষতে পারত না। তাই ডাক্তার আমাকে কৌটার দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দেন।
আমি সবভাবে অনেক চেষ্টা করেছি, তবে ওর বয়স যখন পাঁচ মাস তখন একেবারে চোষা বন্ধ করে দেয়। আমার শরীরে দুধ তৈরিও বন্ধ হয়ে যায়। আমি আমার ডাক্তারকে এর জন্য দোষ দিই, আমার কম বয়সকে দোষ দিই। মাথায় গেঁথে যাওয়া তথাকথিত ব্যর্থতাকে ব্যাখ্যা করার সব রকম চেষ্টা করেছি। তবে বিষয়টির সমাপ্তি ঘটায় গোপনে খুশিও হয়েছিলাম।
ওই সময়টা আমার জন্য খুব কঠিন ছিল। নিজেকে ভীষণ অসম্পূর্ণ মনে হতো। তবে ছয় মাস বয়সে যখন বাচ্চাকে নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার খাওয়ানোর কথা, তখন ওকে যা খেতে দিয়েছি তাই খেয়েছে। সে কখনোই বুকের দুধের ওপর নির্ভরশীল ছিল না।
আমি একা নই। আমার অনেক বন্ধু এবং পরিচিতজনও একই সমস্যার মধ্য দিয়ে গেছেন। তাদের সবসময় বলা হয়েছে, ‘স্তন্যদান বিশেষজ্ঞকে ডাকো’, ‘হাল ছেড়ে দিয়ো না’, ‘দুধ ফ্রিজে রেখে দাও’ এবং ‘আরও অত্যাধুনিক ব্রেস্ট পাম্প কেনো।’
যেসব মা তাদের সন্তানদের অন্তত ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ান না, মানুষ তাদের ধিক্কার জানান এবং গুঁড়া দুধ সম্পর্কে ভীতির জন্ম দেন। এসব মানুষের উদ্দেশে আমার একটাই কথা, আপনারা নিজের চরকায় তেল দিন।
বুকের দুধ খাওয়ানো বাধ্যতামূলক নয়। এটি সেসব মায়েদের জন্য যারা বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন এবং খাওয়াতে চান। আমরা জানি বিষয়টি স্বাস্থ্যকর। আমরা এটাও জানি, গবেষণায় দেখা গেছে, এতে শিশুরা কিছু বাড়তি সুবিধা পায়। তবে অনেক সময় এটি সম্ভব হয় না এবং কৌটার দুধ খাওয়াতে সমস্যা নেই।
শিশুর খাবার
সবজির ভেতরে আমি আমার বাচ্চাকে প্রথমে গাজর খেতে দিয়েছিলাম। সে আধ চামচ খেয়ে ফেলেছিল। তবে ঘটনাটি বলার পর সবার যেন প্রশ্নের শেষ ছিল না। ‘গাজরগুলো কোথায় থেকে কিনেছিলে?’, ‘এগুলো কি অর্গানিক ছিল?’, ‘তুমি কি এগুলো গ্রামের দিক থেকে এনেছিলে?’
কেউ কেউ যেকোনো খাবার নিয়েই খোঁচার ভঙ্গিতে এসব বলেছেন। সত্যি বলতে, আমার দামি অর্গানিক দোকানে দোকানে যাওয়ার মতো সময় ছিল না। আর আমি বেশিদিন এগুলো কিনতেও পারতাম না। এই আলোচনাগুলো খুবই অর্থহীন এবং এগুলো কোনো কাজে আসে না।
আমার এক বন্ধু একবার ফেসবুকে পোস্ট করেছিল, ‘যদি একজন দরিদ্র গর্ভবতী নারী কলের পানি খায় এবং তার কোনো ক্ষতি না হয় তাহলে আমি বোতলের পানি কেন কিনব?’ কেউ যখন বিরক্তিকরভাবে অযাচিত বড়লোকি উপদেশ দিত তখন আমি এটি নিয়ে ভাবতাম। এটি আমাকে বাস্তবে টিকে থাকতে সাহায্য করত।
শিশুর পোশাক
আপনি নতুন মা হিসেবে অনলাইনে ঢোকামাত্র বাচ্চাদের হালকা বাদামি, সাদা ও প্যাস্টেল রঙের পোশাক পরা হাজারও ছবি দেখবেন। কিন্তু আপনি তিন মাসের একটি বাচ্চার জন্য উলের দামি টাইটস কেন কিনবেন, যা কি না আর তিন মাস পরই ছোট হয়ে যাবে? তার ওপর হালকা বাদামি! এটি তো এক মিনিটেই নোংরা হয়ে যাবে।
আরেকটি কথা, কিছু মানুষ আছে যাদের জীবনের সম্ভবত একমাত্র লক্ষ্য আপনি আপনার বাচ্চাকে কী পরাচ্ছেন তা দেখভাল করা। ‘মাথায় একটি টুপি পরাও,’ ‘এখন শীতকাল, মুখ আর গলা অবশ্যই ঢাকতে হবে,’ ‘মেয়ে বাবু? গোলাপি রঙের জামা পরাওনি কেন?’
দয়া করে এ ধরনের অযাচিত উপদেশ থামান।
শিশুর ঘুম
আমার বাচ্চার বয়স এখন ছয় বছর। সে সবসময় মোটামুটি একাই ঘুমায়, আঙুল চোষে না। পার্কের বেঞ্চে অথবা তার স্কুলে সহজেই দুই ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতে পারে। অথচ ওর বেড়ে ওঠার সময় দোল দিয়ে ঘুম পাড়ানো থেকে শুরু করে, চুষনি দেয়া অথবা বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে একা রাখলে ভয় পাবে এবং সারা জীবনের মতো ঘুমের স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যাবে- এমন নানান বিষয় আমাকে বিশ্বাস করানো হয়েছিল।
ঠিক আছে, যখন আমরা শিশু ছিলাম তখন এই সাধারণ অভ্যাসগুলো আমাদের করানো হয়েছে। তবে ঘুম বিষয়টি জটিল। দুটি বাচ্চা যেমন এক নয়, তেমন অভ্যাসও নয়। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে কোন অভ্যাসটি বাচ্চার জন্য উপযোগী। কীভাবে ঘুম পাড়ানো হচ্ছে সেটি নয়, বরং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাচ্চার যতটা প্রয়োজন ততটা ঘুমাতে দেয়া।
শুরুতে আমার বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানো কঠিন ছিল। মাঝে মাঝে আমাকে রাত ৩টার সময় মেয়েকে প্র্যামে শুইয়ে ঘুম পাড়ানোর জন্য নিয়ে বের হতে হতো। শিশুর ঘুমের ধরন একজন মায়ের জীবনে প্রচুর সমস্যা তৈরি করতে পারে, তাই এ বিষয়ে নাক গলাতে আসবেন না। নতুন বাবা-মা হিসেবে আপনি নানা রকম চেষ্টা করুন। যদি বিষয়গুলো কঠিন হয়ে ওঠে তাহলে মনে রাখতে হবে আপনার পেশাদার কারও কাছে যেতে হতে পারে।
অযাচিত উপদেশ বন্ধের বিষয়টি আমাকেও শিখতে হয়েছে
সম্প্রতি এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। মাত্র সন্তান প্রসব করায় সে তখনও হাসপাতালে। আমি তাকে বলছিলাম বাচ্চাকে নার্সদের কাছে দিয়ে পেইনকিলার খেতে। তাহলে সে অন্তত দুই ঘণ্টা ঘুমাতে পারবে। তাকে এমন বলার কারণ হলো, আমি ভেবেছিলাম হাসপাতাল ছাড়ার পর সে ঘুমানোর সুযোগ পাবে না। আমি এটা বলেছিলাম কারণ ওই পরিস্থিতিতে আমিও এটা করতাম বলে মনে হয়েছিল।
তারপর আমার মনে হলো হয়তো সে বাচ্চাকে পাশে শুইয়ে তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে চায়, যেমনটা আমি করেছিলাম। হয়তো আমি যা বলেছি তা নির্বোধের মতো ছিল। সম্ভবত সে আমার উপদেশে খুশি হয়নি। আমার এই নতুন উপলব্ধিটি তৈরি হয়েছে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে।
মানুষের নিজের সিদ্ধান্ত নিজের নেয়ার স্বাধীনতা আছে। সেগুলো সবচেয়ে ভালো যদি নাও হয় বা অন্যদের থেকে আলাদা কিছুও যদি হয়, তাহলেও এই ব্যক্তির স্বাধীনতা বজায় থাকা উচিত। আমরা মায়েদের এত বেশি চাপ দেই যে, মাঝে মাঝে এই সত্যটি আমরা ভুলে যাই।