‘আব্বায় কইছইন পড়ালেখা পরে করলে অইবো, আগে ধান বাঁচানি দরকার। তাই সকাল থাকি ধান কাটতে আইছি’- এ বক্তব্য শিহাব মিয়ার। ধল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ধল গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, হাওরে বাবার সঙ্গে ধান কাটছে শিহাব মিয়া। ধান কাটার ফাঁকেই কথা হয় তার সঙ্গে।
শিহাব বলে, ‘এখন তো স্কুল বন্ধ। তাই প্রত্যেক দিন ঘুম থেকে উঠেই ধান কাটতে চলে আসি। এখন পড়ার সময় পাই না।’
শিহাবের পাশেই ধান কাটছিলেন তার বাবা মনসুর মিয়া। ছেলেকে পড়ার বদলে ধান কাটায় নিয়ে আসা প্রসঙ্গে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘শিলাবৃষ্টিতে অনেক ধান নষ্ট হয়ে গেছে। আবার ঢলের ভয়ও আছে। এখন যা ধান আছে, সেগুলো বাঁচানোটা জরুরি। তাই বাড়ির সবাই মিলে ধান কাটতে নামছি। ধান কাটা শেষ হলে সে (শিহাব) আবার পড়ালেখা শুরু করবে।’
সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় এখন ধান কাটার ধুম পড়েছে। ঢলে অনেক হাওরের ধানই তলিয়ে গেছে। ফের ঢলে নামলে আরও ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া প্রায় সুনামগঞ্জে ঝড় হচ্ছে, হচ্ছে শিলাবৃষ্টিও। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ধান। তাই তাড়াতাড়ি ধান কাটতে মরিয়া কৃষকরা। ফসল ঘরে তুলতে ঘরের শিশুদেরও মাঠে নামিয়েছেন তারা। তাই হাওরের প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়া ফেলে কর্মমুখী করে তুলেছেন শিশুদের।
গত বুধ ও বৃহস্পতিবার সুনামগঞ্জের আটটি উপজেলার বিভিন্ন হাওর ঘুরে দেখা গেছে শিশুশ্রমের চিত্র। হাওরে ধান কাটা, ধান বয়ে নিয়ে আসা, ধান শুকানো, মাড়াই করা- সব কাজেই নিয়োজিত রয়েছে শিশুরা। ছেলে ও মেয়েশিশু- উভয়েই কাজ করছে হাওরে।
ধলে শিহাবের পাশের জমিতেই ধান কাটছিল আবদুল মুকিত। স্থানীয় একটি মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সে। মুকিত বলে, ‘এখন মাদ্রাসা বন্ধ। পড়ালেখার চাপ নেই। তাই ধান কাটতে আসছি।’
তবে ধল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুয়েবুর রহমান জানিয়েছেন, এপ্রিলের শুরু থেকেই স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমেছে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই হাওরের ধান কাটতে পরিবারকে সহযোগিতা করতে লেগে যাওয়ায় স্কুলে উপস্থিতি কমে আসে।
সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক দিয়ে গোবিন্দগঞ্জ পেরোতেই দেখা যায়, দুই পাশে সড়কের ওপরই ধান মাড়াই ও শুকানোর কাজ চলছে। আর পাশের হাওরগুলোয় চলছে ধান কাটার কাজ।ছাতকের কৈতক এলাকায় সড়কের পাশে কুলোয় করে ধান বাছাইয়ের কাজ করছিল দুই বোন নিলুফা ও সরুফা। স্থানীয় পাড়াই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম ও তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী তারা।
নিলুফা বলে, ‘বাবা মাঠে ধান কাটছে। আর আমরা এখানে মায়ের সঙ্গে ধান শুকানো ও বাছাইয়ের কাজ করছি।’
এখন প্রতিদিনই এই কাজ করতে হয় জানিয়ে নিলুফা বলে, ‘এখন পড়ালেখা করতে হয় না। কাজ করে সন্ধ্যায় ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।’
আরেকটু এগোনোর পর সড়কে পড়ে থাকা ধান কুড়িয়ে ব্যাগে ভরছে শিশু রিয়াদ। স্থানীয় একটি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সে। রিয়াদ বলে, ‘ধান বেচে মজা কিনমু। এর লাগি ধান তুকাইরাম (কুড়াচ্ছি)।’
রিয়াদ যার কাছ থেকে মজা কিনবে সেই ‘মজাওয়ালাও’ একজন শিশু। দেলোয়ার নামের এ শিশু পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে। সে বলে, ‘বাজার থেকে চানাচুর, চকোলেট, বাদাম কিনে এনে এইখানে ধানের বিনিময়ে বিক্রি করি। পরে ধান আবার বাজারে বিক্রি করে দিই।’
হাওর এলাকার যত ভেতরে যাওয়া যায়, ততই ধান কাটার কাজে শিশুদের অংশগ্রহণ আরও বেশি চোখে পড়ে। যত দুর্গম এলাকা, শিশুশ্রমিক তত বেশি দেখা যায়।
তাহিরপুরের শনির হাওরে নিজের ছেলেকে নিয়ে ধান কাটছিলেন মাখন মিয়া। ছেলে আরাফাত আনোয়ারপুর স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। মাখন মিয়া বলেন, ‘ধান ভাসিয়ে নিলে তো পড়ার সঙ্গে খাওয়াও বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এখন ধান বাঁচাতে হবে। ধান মিললে পড়াও চলবে।
‘একে তো ঢলের ভয়, তার ওপর আছে শ্রমিক সংকট। তাই বাসার নারী-পুরুষ-শিশু সবাই মিলে এখন হাওরে কাজ করছি।’
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিটি দুর্যোগেই হাওরে শিশুশ্রমের হার বাড়ে। দুর্যোগে সংকটে পড়া পরিবারকে সাহায্য করতে শিশুরা কাজে যুক্ত হয়। বাড়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হারও।
কেবল ধান কাটা, পরিবহন ও মাড়াই-ই নয়, দুদিন হাওরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে শিশুদের বিল ও নদী থেকে নৌকায় করে মাছ ধরার কাজ করতেও দেখা গেছে।
তবে তাহিরপুরের সুলতানপুর গ্রামের প্রবীণ আলতাফুর রহমান জানান, বোরো মৌসুমে সব সময়ই হাওরের শিশুরা পরিবারকে সাহায্য করতে কাজে নামে। কারণ প্রতিবারই ফসল তলিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। তাই পরিবারের সব সদস্যকেই কাজে নামতে হয়। আর যে বছয় বন্যা বেশি হয়, সে বছর এই হার আরও বাড়ে।
তিনি বলেন, ‘এতে পড়ালেখা কিছুটা বিঘ্নিত হলেও হাওরবাসীর কাছে ধান রক্ষাই তখন প্রধান লক্ষ্য থাকে। কারণ এটিই তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।’
হাওর নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হাওর ও পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা এ প্রসঙ্গে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ধানের মৌসুমে হাওর এলাকার আবালবৃদ্ধবনিতাই কাজে যুক্ত হয় এটা সত্য, তবে স্বাভাবিক সময়ে শিশুরা শৌখিনভাবে কাজে যুক্ত হয়। হালকা সাহায্য করে। কিন্তু যখন দুর্যোগ আসে তখন তাড়াতাড়ি ধান কাটা ও শুকানোর চাপ তৈরি হয়। তখন শিশুদের ওপরও কাজের চাপ পড়ে। কারা ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে যুক্ত হয়।’
হাওরের দুর্যোগের কারণে কিছু শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পড়তে পারে- এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে সুনামগঞ্জের জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বোরো ধান হচ্ছে এই এলাকার মানুষের একমাত্র ফসল। এটি তলিয়ে গেলে মানুষজন সংকটে পড়ে। ফলে শিশুদেরও তারা পড়ালেখা ছাড়িয়ে কাজে লাগিয়ে দেয়। কেউ কেউ জীবিকার তাগিদে এলাকা ছেড়ে চলে যায়। ফলে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বাড়ে।
‘২০১৭ সালে বন্যায় ফসলহানির পর ঝরে পড়ার হার মারাত্মক বেড়ে গিয়েছিল। এবার সে রকম হবে না। তবে কিছু শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পারে।’ যোগ করেন তিনি।