বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মহামারিতে স্কুল হারিয়েছে হাজারও ছেলেশিশু

  •    
  • ২৭ এপ্রিল, ২০২২ ১৯:৩৯

কোভিড মহামারির আগে রাফি ছিল উচ্ছ্বসিত, সারাক্ষণ বকবক করা এক শিশু। বাবা-মার ভাষায়, শক্তিতে পরিপূর্ণ একটি বলের মতো, যা সারাক্ষণ অশান্ত এবং খুব কমই স্থির। আজকাল সে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে, ফেটে পড়ে আবেগ। মাকে বলে, ‘তোমার কারণে আমার জীবনের সব শেষ।’

কোভিড ১৯ মহামারির কারণে প্রায় দুই বছর বন্ধ ছিল দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম টাইমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সময়ের পর বাংলাদেশে স্কুলে ফেরেনি হাজার হাজার ছেলেশিশু। তাদের বেশির ভাগই শিশুশ্রমে যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছে। আর্থিক অনটনের কারণে অনেক পরিবার তাদের সন্তানকে আর স্কুলমুখী করতে পারেনি। টাইমের প্রতিবেদনটি ভাষান্তর করেছেন সঞ্জয় দে।

রাজধানী ঢাকায় সূর্য তখন অস্তগামী। দুই সন্তানের জননী ৩৪ বছরের রেখা মন অচঞ্চল রাখার লড়াই করছেন। হাতের প্লাস্টিকের চুড়িগুলো মুচড়ে চলছেন রেখা। ১২ বছর বয়সী ছেলে ফোন করেছিল কি না নিশ্চিত হতে বারবার হাতের মোবাইলটি দেখছেন। আরও আধা ঘণ্টা আগেই ছেলের বাসায় ফেরার কথা।

রেখা সামনের দরজা দিয়ে বাইরে নজর বোলান, তার মুখজুড়ে উদ্বেগের ছাপ। ভ্রূ কুঁচকে বলেন, “কাজটি খুবই বিপজ্জনক। প্রতিদিন সকালে ওকে বিদায় জানাই আর প্রার্থনা করি, ‘আল্লাহ রাতে ঠিকঠাক বাসায় ফিরিয়ে এনো।'”

রেখার দুশ্চিন্তায় ভোগার কারণ আছে। তার বড় ছেলে রাফি স্থানীয় কাচের কারখানায় ১৮ মাস হলো কাজ শুরু করেছে। এরই মধ্যে একাধিকবার ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত হয়ে বাসায় ফিরেছে সে। একদিন বিকেলে ধারালো ব্লেড দিয়ে জানালার কাচ কাটার সময় ও নিজের হাতের তালুও বাজেভাবে কেটে ফেলে। শিশুটির টি-শার্ট রক্তে ভিজে যাওয়ায় নিয়োগকারীরা জরুরি কক্ষে নিয়ে যান, কিন্তু রেখাকে কেউ খবর দেননি।

অনুতাপ ভরা গলায় রেখা বলেন, ‘আমি নিজের ভেতরে অনেক খারাপ বোধ করি, আমি একজন খারাপ মা। আমি জানি রাফি কাজ করতে চায় না। ও স্কুলে থাকতে চায়।’

২০২০ সালের মার্চে কর্তৃপক্ষ যখন প্রথম বাংলাদেশের স্কুল বন্ধ করে দেয়, তখন কেউ অনুমান করতে পারেনি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরবর্তী ১৮ মাস বন্ধ থাকবে। বিধিনিষেধের আওতায় এটি বিশ্বে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে স্কুল বন্ধের অন্যতম ঘটনায় পরিণত হবে সেটাও ভাবা যায়নি।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ক্লাসগুলো পর্যায়ক্রমিক খোলা রাখার সূচিতে ফিরলেও ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের কারণে কোভিড সংক্রমণ বাড়ায় জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে চার সপ্তাহের জন্য স্কুল ফের বন্ধ হয়ে যায়। এখন প্রথম লকডাউনের দুই বছর পর শিশু-অধিকার কর্মীরা বলছেন, সারা দেশে হাজারও শিক্ষার্থী আর স্কুলে ফিরে আসেনি। তারা বলছেন, এদের বেশির ভাগই ১২ বছর বা তার বেশি বয়সী ছেলেশিশু। স্কুল বন্ধের ওই অন্তর্বর্তী সময়কাল তাদের ঠেলে দিয়েছে পূর্ণাঙ্গ শ্রমজীবনে।

২০২০ সালের মার্চে সরকার দেশব্যাপী লকডাউন জারির আগে রাফি ঢাকার শান্তিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিল। ওই স্কুলে ৫ বছর থেকে ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থী ছিল ১১০০-এর বেশি। ঢাকার ব্যস্ত রাস্তার পাশের স্কুলটির বন্ধ দরজা ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে আবার খুলে দেয়া হয়। শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন, তবে ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ডগুলোতে এখনও স্যাঁতসেঁতে ভাব।

স্কুল খোলার পর মাত্র ৭০০ শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত হয়। পরের মাসগুলোতে এই সংখ্যা আর বাড়েনি। ডিসেম্বরের মধ্যে অনেক কাঠের বেঞ্চ এবং ডেস্ক খাঁখাঁ করতে দেখা যায়। একপর্যায়ে সেগুলো ভাঙারি হিসেবে বিক্রি করে দেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ।

ক্লাসে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের দুই-তৃতীয়াংশই ছেলেশিশু। প্রধান শিক্ষক বিপ্লব কুমার সাহা বলেন, ‘তারা এখন নিজেদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী।’

মহামারি শুরুর পর থেকে বাংলাদেশে ঠিক কত শিশু শ্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তা জানা অসম্ভব। টাইম ম্যাগাজিন সারা দেশের ২০টি স্কুলের উপস্থিতির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখেছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ড্রপআউট শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছেলেশিশুর সংখ্যা অন্তত ৫৯ শতাংশ। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের তথ্যও এই পরিসংখ্যানকে সমর্থন করছে।

ক্রমবর্ধমান এই সংকট মার্চে শিশুশ্রমসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘কনভেনশন ১৩৮’ অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে প্ররোচিত করেছিল। তারা ঘোষণা করে, ১৪ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুকে কোনো শিল্পে নিয়োগ করা উচিত নয়। আগামী তিন বছরের মধ্যে শিশুশ্রম সম্পূর্ণ বিলোপের প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়। তবে মহামারির প্রথম ১৮ মাসে সারা দেশে খানা আয় গড়ে ২৩ শতাংশ কমেছে। অনেক বাবা-মা বলেছেন, তাদের সামনে কোনো বিকল্প নেই। তাদের ছেলে কাজ করতে না গেলে অন্য সন্তানসন্ততি খেতে পারবে না।

দুই বছর আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না। যখন প্রথম স্কুল বন্ধ হয়ে যায়, রাফির বাবা-মা তাদের ছেলেদের শিক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। রাফির ছোট ভাই বয়স মাত্র আট বছর। লকডাউনের শুরুতে তাদের পরিবার আশপাশের কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল, যাতে করে স্থানীয় এক ডজন শিশুকে প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে একজন গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে পড়ানো যায়। তবে সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাংলাদেশে লকডাউন থাকায় পরিবারগুলোর আর্থিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হয়।

রেখার স্বামী তাজুল ছিলেন একজন সফল উদ্যোক্তা। তবে ২০২০ সালের গ্রীষ্মের মধ্যে তার পোশাক ব্যবসায় ধস নামে। এরপর তিনি দিনের বেলা রাস্তার পাশে একটি ছোট স্টল চালানো এবং রাতে বাজারে নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ শুরু করেন। তার কর্মঘণ্টার কোনো সীমা ছিল না। তবে এরপরেও ঋণের অর্থ ও বাড়ি ভাড়া পরিশোধের মতো পর্যাপ্ত আয় হতো না। ঋণদাতারা বাসার দরজায় হাজির হতে শুরু করেন। ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে ভোগা রেখাকে তারা হুমকি দেন। একপর্যায়ে হতাশা নিয়ে তাজুল তার সন্তান রাফিকে কাজে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।

সে সময়ের কথা স্মরণ করে রেখা বলেন, ‘এটি কোনো পরিকল্পনা ছিল না; কিন্তু অবস্থা সত্যিই খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল।’

রেখা কখনও কল্পনাও করেননি নিজের ছেলেকে তিনি কাচের কারখানায় দিনে ১২ ঘণ্টার কাজের দিকে ঠেলে দেবেন। নিজেদের শূন্য ইটের ঘরের দিকে ইশারা করে তিনি বলেন, ‘কিন্তু এখন আমরা একটি বিপর্যস্ত জীবনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি।’

মহামারি আঘাতের শুরুতে প্রাথমিক উদ্বেগের বিষয় ছিল মেয়েদের জোর করে বিয়ে দেয়ার ঘটনা। পরিস্থিতির সঙ্গে যুদ্ধ করা অনেক পরিবার খরচ কমানোর উপায় হিসেবে অল্পবয়সী মেয়েদের তাদের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি বয়সী পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছিল।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন পরিচালিত একটি সমীক্ষায় লকডাউনের প্রথম ছয় মাসে দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় প্রায় ১৪ হাজার বাল্যবিয়ের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এসব মেয়ের অর্ধেকের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছর।

রাফি যেখানে পড়ত সেই শান্তিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের ছাত্রীদের বিষয়ে খোঁজখবর রাখতেন। তারা জানেন, স্কুল থেকে বাদ পড়া মেয়েদের বেশির ভাগ গ্রামে চলে গেছে এবং শহরের বাইরে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। অন্তত ১৫ জন মেয়েকে বাল্যবিয়েতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষক বিপ্লব কুমার সাহা বলছেন, ‘১৫ সংখ্যাটি অনেক, তবে এটি আমাদের আশঙ্কার চেয়ে কম।’

তিনি যা প্রত্যাশা করেননি তা হলো মহামারি ছেলে শিক্ষার্থীদের ওপরেও প্রভাব ফেলবে। বিপ্লব কুমার বলেন, ‘এটি আমাদের প্রত্যাশা এবং কল্পনার বাইরে ছিল।’

বাংলাদেশে মাধ্যমিক শিক্ষা বিনা মূল্যে নয় এবং টিউশন ফি বছরে গড়ে প্রায় তিন হাজার টাকা। এই দেশে মহামারির আগে যেখানে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন ১৬৫ টাকার (১.৯০ ডলার) চেয়ে কম খরচে দিনযাপন করতেন, সেখানে মহামারির সময়ে স্টেশনারি, পাঠ্যবই এবং ইউনিফর্মের খরচও দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাল্যবিয়ের ঝুঁকি মোকাবিলা এবং স্কুলে যাওয়ায় উৎসাহ দিতে সরকার প্রতি বছর ১১ থেকে ১৬ বছর বয়সী মেয়েদের উপবৃত্তি এবং টিউশন ভর্তুকি হিসেবে ৩৫০০ টাকা পর্যন্ত সহায়তা দেয়। ব্র্যাকের শিক্ষা পরিচালক সাফি খান বলেন, তবে ছেলে-মেয়েদের পরিবারের জন্য শিক্ষা আরও বিভিন্নভাবে উল্লেখযোগ্য খরচ তৈরি করে। এটি একটি অসম্ভব পরিস্থিতি এবং স্কুলে পাঠানো বজায় রাখার ক্ষেত্রে খুব কম সহায়তা আছে।

আইএলওর বাংলাদেশ ডিরেক্টর তুওমো পাউটিয়াইনেন বলছেন, অর্থনৈতিক সংকটের প্রথম লক্ষণগুলোর একটি হলো বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া। স্কুল বন্ধের সময় বেশির ভাগ পরিবার মনে করেছিল, তাদের মেয়েদের কাজে পাঠানো অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, তবে ছেলেরা তাদের জন্য আয়ের একটি জরুরি সংস্থান করতে পারে।

মেয়েদের শিক্ষার জন্য লাখ লাখ ডলারের বৈদেশিক সাহায্য এলেও বাংলাদেশে শিশু-অধিকার কর্মীরা বলেছেন, তারা কোভিডের প্রাদুর্ভাবের পর স্কুল ছেড়ে দেয়া লাখো ছেলেশিশু-কিশোরের সমান সহায়তার আহ্বান জানিয়ে লড়াই করছেন।

ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের পরিচালক টনি মাইকেল গোমস বলছেন, “দাতারা যেন শিশুশ্রমের বিষয়ে ‘ইচ্ছাকৃতভাবে অন্ধ’। আমি একটি বিশাল বিচ্ছিন্নতা দেখতে পাচ্ছি … আপনি যদি সত্যিই জিজ্ঞাসা করেন তারা ঠিক কী অর্থায়ন করছে এবং তাদের সহায়তা শিশুদের জীবনকে প্রভাবিত করে কি না, তবে উত্তরটি ‘না’ হতে পারে।”

এই বক্তব্যের সঙ্গে বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েটও একমত। তিনি বলেন, ‘মেয়েদের ঝুঁকির বিষয়টিতে আমি কম জোর দিতে চাই না, তবে ছেলেদের নির্দিষ্ট চাহিদার প্রতিও আমাদের দৃষ্টি হারানো উচিত নয়।’

অনেক বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান ঋণগ্রস্ততার সঙ্গে তাদের সন্তানদের শিক্ষার খরচ বাড়তি বোঝা তৈরি করেছে। এ কারণে তাদের ছেলেদের পড়াশোনার ইতি ঘটানো ছাড়া আর কোনো উপায় সামনে নেই।

আমেনা যখন তার ১১ বছরের ছেলে আলমগীরকে আর স্কুলে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানান, ছেলেটি তখন তার সব বই ভাগাড়ে ফেলে দেয়। আমেনা বলেন, ‘আমার সেই সময়ের অনুভূতি ছিল অনেক কষ্টের।’

কিছুদিন পর আলমগীরের বন্ধুরা যখন গ্রাম ছেড়ে আবার স্কুলে ফিরে যায়, আমেনা দেখতে পান তার ছেলে কুঁড়েঘরের আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। আমেনা বলেন, ‘ওকে কাঁদতে দেখে আমিও কেঁদেছি।’

ছেলের কষ্ট আমেনা বুঝতে পারেন। ছোটবেলায় আমেনা তার ক্লাসের শীর্ষে ছিলেন, ১২ বছর বয়সে তার ভাই তাকে স্কুল ছাড়তে বাধ্য করেন। এরপর তাকে একজন বয়স্ক লোকের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়।

আমেনা এর আগেও তার আরেক ছেলেকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করতে বাধ্য হয়েছেন। পাঁচ বছর আগে স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়লে আলমগীরের ভাইকে ইটের ভাটায় কাজ করতে পাঠানো হয়। ছেলেটির বয়স তখন ১১ বছর, ইটভাটায় দিনে তার উপার্জন ৩০০ টাকা। আমেনা বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম আমাদের বাকি ছেলেরা শিক্ষিত হবে।’

তবে ২০২০ সালের মার্চে দেশব্যাপী লকডাউন শুরুর পর ইটভাটাটি চার মাসের জন্য বন্ধ ছিল। পরিবারের চাল ও চিকিৎসার জন্য ৪০ হাজার টাকা ঋণ করতে হয়। দুই বছর পর এখনও ৩০ হাজার টাকা ঋণ রয়েছে। আমেনার ভয়, এই ঋণ পরিশোধের জন্য আলমগীরেরও কাজ করে যেতে হবে।

বাংলাদেশে শিশুশ্রম বিষয়ক তথ্য খুবই অপ্রতুল। আইএলওর মতে, মহামারির আগে শিশুশ্রমের হার কমেছে বলে মনে হয়। তবে ২০১৩ সাল থেকে শিশুশ্রম নিয়ে দেশব্যাপী সরকারের নেতৃত্বে কোনো সমীক্ষা হয়নি।

২০১৯ সালে ইউনিসেফ একটি সমীক্ষা চালায়। এতে দেখা যায়, ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রতি ১০ জন ছেলেশিশুর মধ্যে একজন পূর্ণকালীন শ্রমে জড়িত। গবেষণায় দেখা গেছে, আয়ের পরিমাণে হেরফের থাকলেও ১৪ বছরের কম বয়সী বেশির ভাগ ছেলে প্রতি মাসে ৪০ ডলারের (৩৪৭৫ টাকা) কম আয় করে।

ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, ‘মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে আমাদের কাছে আপডেট পরিসংখ্যান নেই। তাই আমরা জানি না শিশুশ্রমের ওপর এর প্রভাব কী হতে চলেছে। তবে ধারণা করছি, প্রভাবটি অনেক খারাপ।’

বাংলাদেশ আইএলও কনভেনশনটি অনুমোদন করার আগেই দেশটির সংবিধানে ‘বিপজ্জনক’ শিশুশ্রম, যেমন ইট ভাঙা বা চামড়া ট্যানিংয়ের মতো কাজ বেআইনি ছিল। তবে বর্তমান আইনে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের অনানুষ্ঠানিক খাত- যেমন ঘরোয়া কাজ বা কৃষিতে তাদের পরিবারের প্রয়োজনে কাজ করা নিষিদ্ধ নয়।

শিশু অধিকার কর্মীরা বলছেন, যারা শিশুদের কোনো শিল্পে নিয়োগ করেন তাদের শাস্তি পাওয়ার ঘটনা বিরল। উদাহরণ হিসেবে তারা একটি জুস কারখানায় আগুনে কমপক্ষে ৫২ শ্রমিক নিহত হওয়ার তথ্য দিয়েছেন, যাদের মধ্যে ১১ বছরের মতো বয়সী শিশুর সংখ্যা কমপক্ষে ১৬। কারখানার মালিকদের অল্প সময়ের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তারা জামিনে মুক্তি পান। তবে আদালতের মামলা এখনও বিচারাধীন।

অনেক কারখানামালিক বলেছেন, গত দুই বছরে প্রচুর বাবা-মা তাদের ছোট ছেলেদের কাজে নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। নারায়ণগঞ্জের একজন ব্যবসায়ী বলেছেন, মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে তিনি তার পোশাক কারখানায় প্রায় ১০ শিশুকে নিয়োগ দিয়েছেন। সবচেয়ে ছোটটির বয়স ছিল আট বছর।

এই ব্যবসায়ীর যুক্তি, সরকার ব্যর্থ হওয়ায় তিনি অসহায় পরিবারগুলোকে সাহায্য করছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এই দেশে অনেক মানুষ এবং সম্পদ সীমিত। শিক্ষা (শিশুদের) ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চয়তা দেয় না।’

তিনি যখন কথা বলছিলেন অদূরেই তুলার মেঘের মধ্যে নকঅফ অ্যাডিডাস (অ্যাডিডাসের নকল) ট্র্যাকসুট ভাঁজ করতে ব্যস্ত ১২ ও ১৩ বছর বয়সী দুটি ছেলে কাশির দমকে অস্থির ছিল।

বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট মনে করছেন, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া এবং আরও বেশি পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে পতিত হওয়ায় বাংলাদেশি শিশুদের কর্মক্ষেত্র থেকে বের করে স্কুলে ফিরিয়ে আনার কাজটি দীর্ঘায়িত হবে।

তিনি বলেন, ‘এখানে কোনো একক ম্যাজিক বুলেট নেই। কনভেনশনের (আইএলও কনভেনশন) অনুসমর্থন গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিষয় আছে, যেমন বাধ্যতামূলক শিক্ষার সীমা কেবল ১০ বছর বয়স পর্যন্ত। আবার আর্থিকভাবে অসহায় পরিবারগুলোর জন্য তেমন কোনো সামাজিক সহায়তা নেই।’

এর পরেও সেপ্টেম্বরে স্কুলগুলো আংশিকভাবে ফের খোলার পর অনেক শিক্ষক ছাত্রদের বাড়িতে যেতে শুরু করেছেন। তাদের বামা-মাকে সন্তানদের ক্লাসে ফিরিয়ে দেয়ার অনুরোধ করেছেন।

শান্তিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিপ্লব কুমার সাহা বলেন, ‘আমরা তাদের (ঝরে পড়া ছেলে শিক্ষার্থী) পছন্দ করতাম। একসময়ের উপচে পড়া শ্রেণিকক্ষগুলোর খালি ডেস্ক দেখতে পেয়ে কিছু শিক্ষক ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন।’

আলমগীর শেষবার স্কুলে গিয়েছে দুই বছর আগে। শিশুটি চুপচাপ তাদের পাঁচটি ছাগলের দেখভাল করছিল, সকালে কাটা ঘাসের স্তূপের দিকে ছাগলগুলো নিয়ে যাওয়ার সময় সে একটির কান চুলকে দেয়।

তার বাবা-মা চান না আলমগীর তার বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে ইটের ভাটায় কাজ করুক। পরিবারের খামারে প্রচুর কাজ রয়েছে। আমেনারও আশা, ভবিষ্যতে ছেলেকে স্কুলে পাঠানোর টাকা জোগাড় করা যাবেই। তিনি বলেন, ‘আমাকে বিশ্বাস করতে হবে, আমি এটা ঘটাতে পারবই।’

তবে অন্য পরিবারগুলো কম আশাবাদী। রাফি যেখানে তার নিয়োগকর্তার সজাগ দৃষ্টির মাঝে কাচের কারখানার মেঝে পরিষ্কার করে, সেখান থেকে মাত্র ১০ মিনিটের দূরত্বের স্কুলে তার সাবেক সহপাঠীরা ইংরেজি ও ইতিহাস অধ্যয়ন করছে। মহামারির আগে রাফি ছিল উচ্ছ্বসিত, সারাক্ষণ বকবক করা এক শিশু। বাবা-মার ভাষায়, শক্তিতে পরিপূর্ণ একটি বলের মতো, যা সারাক্ষণ অশান্ত এবং খুব কমই স্থির।

আজকাল সে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে, ফেটে পড়ে আবেগ। মাকে বলে, ‘তোমার কারণে আমার জীবনের সব শেষ।’

রেখা জানেন না ছেলেকে কী করে সান্ত্বনা দেবেন, এই অনুতাপ তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। চোখের জলে ভেসে রেখা বলেন, ‘আমরাই ওর ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিয়েছি।’

এ বিভাগের আরো খবর