তালেবানের কাবুল দখলের মুখে আফগানিস্তান ছেড়ে পালান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানিসহ দেশটির অনেক রাজনীতিবিদ। বিপরীতে হাতেগোনো কয়েকজন রাজনীতিবিদ মাতৃভূমি রক্ষায় সবকিছু ঝুঁকিতে ফেলে তালেবানবিরোধীদের সংঘবদ্ধ করছেন লড়াইয়ের জন্য। এতে নেতৃস্থানে আছেন কয়েকজন নারী রাজনীতিকও।
রাজধানী কাবুলে গত রোববার প্রবেশ করে তালেবান যোদ্ধারা। এর মাধ্যমে কার্যত আফগানিস্তানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এখন সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠীটির হাতে। তাও বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে তালেবানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। মানবাধিকার রক্ষায় তালবানবিরোধী লড়াইয়ে অংশ নিচ্ছেন নারীরা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক সংবাদমাধ্যম এনপিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু দেশ আর জাতিকে বাঁচানোই লক্ষ্য নয়, জীবন ও স্বাধীনতা ঝুঁকিতে ফেলা এই নারী আমলাদের। নারী ও মেয়ে শিশু-কিশোরীদের অধিকার রক্ষা, তাদের স্বস্তিতে বাঁচার মতো পরিবেশ তৈরি করার জন্যেও লড়ছেন তারা।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রথম দফায় আফগানিস্তান শাসন করেছিল তালেবান। সে সময় শিক্ষাগ্রহণ, জীবিকা উপার্জন, ভ্রমণসহ সব ধরনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন আফগান নারীরা।
চলতি সপ্তাহে দ্বিতীয় দফায় দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর এক সংবাদ সম্মেলনে নারীর অধিকার রক্ষা ও তাদের নতুন সরকারে অংশ নিতে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিল তালেবান। কিন্তু সে আশ্বাস তারা কতটা রক্ষা করবে, তা নিয়ে সন্দিহান আফগান নারীরা।
এরই মধ্যে অনেক জায়গায় তালেবান যোদ্ধারা নারীদের জোরপূর্বক বিয়ে ও প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করছে বলে খবর মিলছে। হেরাত প্রদেশে পার্লামেন্টের নারী আইনপ্রণেতাদের খোঁজে তাদের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছে তালেবান, জব্দ করেছে তাদের গাড়ি।
এমন পরিস্থিতিতে নিশ্চিত মৃত্যুর শঙ্কা উপেক্ষা করে তালেবানের বিরুদ্ধে তৎপর হয়েছেন, এমন তিন নারীর উপাখ্যান তুলে ধরেছে এনপিআর।
সেলিমা মাজারি, গভর্নর
আফগানিস্তানে জেলা পর্যায়ে তিন নারী গভর্নরের একজন সেলিমা মাজারি।
চারকিন্ত জেলার গভর্নর সেলিমা মাজারির শৈশব কেটেছে ইরানের শরণার্থী শিবিরে। ছবি: এএফপি
তালেবানের বিরুদ্ধে মাজারির লড়াই চলছে ২০১৯ সাল থেকে। তালেবানের বিরুদ্ধে নিজের জেলা চারকিন্তকে রক্ষায় স্থানীয়দের সংঘবদ্ধ করেছেন তিনি।
আফগানিস্তানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়ার আগেই মাজারির জেলার অর্ধেক দখল করে ফেলেছিল তালেবান।
বার্তা সংস্থা এএফপিকে গত ৬ আগস্ট মাজারি বলেছিলেন, ‘মানবাধিকারের যম তালেবান। আমাদের জেলার বাসিন্দাদের কাছে অস্ত্র ছিল না। অস্ত্র কিনতে নিজেদের গরু, ভেড়া, জমি সব বিক্রি করে দিয়েছে তারা।
‘কোনো বেতন বা অর্থ ছাড়াই দিনরাত এখনও মানুষগুলো তালেবানের বিরুদ্ধে প্রথম সারি থেকে লড়াই করে যাচ্ছে।’
ইরানে শরণার্থী হিসেবে বেড়ে ওঠা মাজারি গত শনিবার (১৫ আগস্ট) বার্তা সংস্থা এপিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তালেবান দেশ দখল করলে নেতৃস্থানে কোনো নারীকে কখনোই সহ্য করবে না তারা।
তিনি বলেছিলেন, ‘তালেবানশাসিত প্রদেশগুলোতে নারীদের আর দেখবেন না আপনারা। গ্রামাঞ্চলেও না। তারা সবাই গৃহবন্দি।’
মাজারি সঠিক ছিলেন। তার জেলা দখলের পরই তাকে তালেবান অপহরণ করেছে বলে জানা গেছে।
জারিফা ঘাফারি, মেয়র
আফগানিস্তানের সর্বকনিষ্ঠ মেয়র জারিফা ঘাফারি। রোববার তালেবানের দেশ দখলের খবর পেয়ে তিনি জানান, তালেবান যোদ্ধাদের হাতে প্রাণ দেয়ার অপেক্ষায় আছেন তিনি।
নারী অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সোচ্চার মাইদান শার শহরের মেয়র জারিফা ঘাফারি। ছবি: এএফপি
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম আইকে তিনি বলেন, ‘আমি বসে আছি। তালেবানের জন্য অপেক্ষা করছি। আমাকে বা আমার পরিবারকে সাহায্য করার জন্য কেউ নেই। আমরা সবাই অপেক্ষা করছি।
‘পরিবারকে ছেড়ে যেতে পারব না। যাবই বা কোথায়? আমার মতো সবাইকে তারা খুঁজে খুঁজে বের করবে।’
২০১৮ সাল থেকে মাইদান শার শহরের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ঘাফারি। মাত্র তিন সপ্তাহ আগেই দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী ছিলেন তিনি।
সে সময় বলেছিলেন, ‘আমাদের তরুণরা জানেন দেশ কী ঘটছে। তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আছে। তারা যোগাযোগ ধরে রাখতে জানেন। আমি মনে করি যে তারা আমাদের অধিকার ও উন্নয়নের জন্য লড়াই করবেন। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের দেশের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।’
নারী অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আফগানিস্তানে কাজ করছেন পেশায় আইনজীবী ঘাফারি। রেডিওতে একটি অনুষ্ঠানের নিয়মিত উপস্থাপক তিনি। একটি সংগঠন দাঁড় করিয়েছেন নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে।
বেশ কয়েকটি হত্যাচেষ্টা থেকে জারিফা ঘাফারি নিজে প্রাণে বাঁচলেও গত বছর হামলায় নিহত হয়েছেন তার বাবা। হামলার জন্য তালেবানকে দায়ী করেছেন ঘাফারি।
গত ১৪ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে তিনি লেখেন, ‘আমার প্রিয় মাতৃভূমি, তোমার কষ্ট আর দুর্দশা আমি বুঝি… তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাওয়া তোমার প্রকৃত সন্তানরা হাতেগোনা। কিন্তু তারা এই খারাপ দিনে ইতি টানতে সাহসের সবটা ঢেলে দিচ্ছে, করছে কঠোর পরিশ্রম।’
ফৌজিয়া কুফি, পার্লামেন্টের দ্বিতীয় ডেপুটি স্পিকার
এক বছর আগে উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ পারওয়ান থেকে বোন মরিয়মের সঙ্গে ফিরছিলেন ফৌজিয়া কুফি। কাবুলের কাছেই অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের গুলিতে আহত হন তিনি। বন্দুকধারীদের উদ্দেশ্য ছিল তাকে হত্যা করা।
তালেবানের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় আফগান সরকারের অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন ফৌজিয়া কুফি। ছবি: এনপিআর
গত বছর তালেবানের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অংশ নেয়া আফগান সরকারের কয়েকজন নারী প্রতিনিধির এক জন ছিলেন কুফি। বর্তমানে কাবুলে পার্লামেন্টের দ্বিতীয় ডেপুটি স্পিকার তিনি। জানিয়েছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলে যাবেন তিনি।
কুফি বলেন, ‘নারীরা এখনও নিজেদের সাধ্য মতো চেষ্টা করছেন। সারা দেশের নারীরা বাকিদের প্রতিনিধি হয়ে সংবাদমাধ্যমে কথা বলার চেষ্টা করছে। তাদের সঙ্গে কী ঘটছে, তাদের আশপাশের মানুষের বিপর্যয়- সব তুলে ধরার চেষ্টা করছে তারা।
নারী ও শিশুদের খাদ্য, বস্ত্র, স্যানিটারি পণ্য ও সাবানের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করার পরিকল্পনা রয়েছে তার।