লেখাটির শুরুতেই দুটি অভিজ্ঞতার উল্লেখ করতে চাই। প্রথমটি শৈশবের। তখন দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। মফস্বল শহর শেরপুরে দুরন্ত শৈশব উদযাপন করছি। আশির দশকের শেষাশেষি। পাড়ায় ওয়ার্ল্ড ভিশন অফ বাংলাদেশের স্কুল স্থাপিত হলো। মান্দি নৃগোষ্ঠির লোকজন স্কুলটি পরিচালনা করতেন। সেই সুবাদে আমার প্রথম পরিচিতি ও সাক্ষাৎ ঘটে বাঙালি ভিন্ন অন্য কোনো নৃগোষ্ঠীর সঙ্গে।
এ সময় পাড়ায় মান্দি জনগোষ্ঠীর আনাগোনা বেড়ে যায়। লক্ষ্য করতাম, সমবয়সী আমরাসহ চারপাশের সবার মধ্যেই নতুন পরিচয় ঘটা এই নৃগোষ্ঠী সম্পর্কে ব্যাপক ফিসফিসানি, কৌতুহল, আলোচনা এবং সমালোচনা। আমরা যারা একসঙ্গে খেলতাম কোত্থেকে যেন কিছু ছড়াও আয়ত্ব করে ফেলি। দুটি ছড়া এই মহূর্তে মনে পড়ছে-
ছড়া: এক
গারো গান্নি এগারো
ধইরা ফালা পাগারো।
ছড়া: দুই
গারো আছে গান্নি নাই
শীতল আলু তুলে নাই।
ছড়া দুটিতে ‘গারো’ বলতে পুরুষ মান্দি এবং ‘গান্নি’ বলতে নারী মান্দি ব্যক্তিকে বোঝানো হচ্ছে, যা এখনও স্থানীয়ভাবে মান্দি নৃগোষ্ঠীর লিঙ্গীয় ভিন্নতা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
এক্ষেত্রে প্রথম ছড়াটিতে ১১ জন মান্দি ব্যক্তিকে ‘পাগার’ (স্থানীয়ভাবে ব্যবহৃত শব্দ) বা মজাপুকুরে ময়লার মতো ফেলে দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। একভাবে বলা যায়, এখানে মান্দি জনগোষ্ঠীকে ময়লার সঙ্গে তুলনীয় এবং উচ্ছিষ্ট হিসেবে দেখা হচ্ছে।
দ্বিতীয় ছড়াটি সম্পর্কে শৈশবে কেউ একজন বলেছিলেন, ‘গারোরা তো শুধু শীতল আলু (এক প্রকার স্থানীয় আলু) খায়, গান্নি বাড়িতে না থাকায় তা তোলা হয় নাই এবং তারা না খেয়ে আছে।’
এই ভাবনাটি মূলত মান্দি নৃগোষ্ঠীর মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করে, যেখানে নারী গৃহস্থালির সর্বময় অধিকারী। নির্দিষ্ট একপ্রকার আলুই তাদের প্রাত্যহিক খাবার এবং এই জনগোষ্ঠীর খাদ্যতালিকা যে খুব একটা সমৃদ্ধ নয়, সেদিকেও মনোযোগ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
বেশির ভাগ সময়েই আমরা সমবয়সীরা রাস্তায় কোনো মান্দি ব্যক্তিকে দেখলেই জোরেজোরে ছড়াগুলো আওড়াতাম, তবে অসচেতনভাবে হলেও একটি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করতাম এই ভেবে যে, যদি ওরা মারতে আসে!
বিষয়টি আমাদের খেলার অংশে পরিণত হয়। একদিন একজন ষাটোর্ধ্ব মান্দি ব্যক্তি আমার ছড়া শুনে এমন ভাবে তেড়ে আসেন যে, আমি দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়ে পালাই।
পুরো এলাকা তাড়া করে বয়সের কারণেই হোক, তিনি আমাকে ধরতে ব্যর্থ হন। এরপর থেকে তাকে দূর থেকে দেখতে পেলেই সরে পড়তাম এবং ভুলেও আর কখনও ছড়াগুলো মুখে আনিনি।
শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে এ পর্যায়ে এসেও মাঝেমধ্যে ভাই-বোনেরা ঠাট্টাচ্ছলে ওই তাড়ার কথা আমাকে মনে করিয়ে দিয়ে হাসাহাসি করে। আমিও স্মৃতিকাতর হই।
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসার পরের। আমার একজন অন্তরঙ্গ সহপাঠী এবং রুমমেট উভয়েই ছিলেন চাকমা জনগোষ্ঠীর। দুজনের সঙ্গেই আমার সখ্য গড়ে ওঠে খুব অল্প সময়েই।
একদিন আমার রুমমেট দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে জানায়, ওর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর রুমমেট তার বন্ধুটির কাছে জানতে চেয়েছে, ‘চাকমা মেয়েটার সঙ্গে মেশো কীভাবে? গন্ধ পাও না?’
অন্য একদিন আমার সহপাঠী বন্ধুটি জানায়, তার পাশের রুমের এক মেয়ে জানতে চেয়েছে, ‘তোমরা কি গাছে থাকো? সাপ-ব্যাঙ খাও?’
এটা শুনে ও নাকি স্তব্ধ হয়ে নিজের কক্ষে চলে আসে।
ব্যক্তিগত এই অভিজ্ঞতাগুলো উল্লেখ করার কারণ মূলত কিছু প্রশ্ন উত্থাপনের জন্যে। এক. প্রথম অভিজ্ঞতায় বয়স্ক একজন মান্দি ব্যক্তি কেন অচেনা এক বাঙালি শিশুকে তাড়া করেছিলেন?
দুই. উচ্চশিক্ষার পরিসরে সমগোত্রীয় (অধ্যয়নরত হিসাবে) অথচ ভিন্ন নৃগোষ্ঠী সম্পর্কে ধারণাকে নিছক ‘ধারণা’ হিসেবে বিবেচনা করা সম্ভব কিনা?
একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে উপরে উল্লেখ করা দুটি অভিজ্ঞতারই অর্ন্তনিহিত সাযুজ্য বিদ্যমান; সমতলের বাঙালির বিষমতলের (পাহাড়ি) নৃগোষ্ঠী সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ। সেটি শিশুর ছড়ার মাধ্যমেই হোক, আর উচ্চশিক্ষার প্রাণকেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরেই হোক।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ‘মনোভঙ্গী’ এবং কে, কার প্রতি সেটি প্রকাশ করে? বিস্তর আলোচনার সুযোগ এখানে না থাকলেও মনোভঙ্গী এবং এর ক্রিয়াশীলতার সঙ্গে ‘অপরায়ন’ (otherness) এর সম্পর্ক নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।
মনোভঙ্গী মূলত একটি দশা বা পর্যায় যা হুট করে বা এক মহূর্তে দৃশ্যমান হয় না বা প্রতিষ্ঠিত হয় না। নানাবিধ কর্তা (actor), প্রক্রিয়া এবং বিচরণশীলতার মধ্যে দিয়ে এর ক্রমাগত বিস্তার ঘটে। ফলে এটি নবায়নযোগ্য ও পুনরুৎপাদনশীল।
যেমন, আমরা হরদম ব্যবহার করি আনকালচারড, ক্ষ্যাত বা গেঁয়ো-ভূত। এ বিষয়গুলোর মাধ্যমে আমরা মূলত কী বোঝাতে চাই? মামুলি শব্দবন্ধ বা পদ হিসাবে কি এদের ছেড়ে দেয়া যায়?
শব্দবন্ধ বা পদের চাইতে এরা কয়েকগুণ বেশিই ক্ষমতাধর। কেননা আনকালচারড, ক্ষ্যাত বা গেঁয়ো-ভূত বলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দ্বৈতবাদী ভাবনার শিকার হই। যেমন, কালচার-আনকালচার, শহুরে-গ্রামীণ অথবা স্মার্ট-আনস্মার্ট। সর্বোপরি একটি আদর্শ-মান (standard) বিরাজ করে আমাদের চেতনায়। আর এই আদর্শ-মান আমরা শুধু চেতনাতেই স্থান দেই না, নিজেদের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে তার পুনরুৎপাদন ঘটাই।
‘অপরায়ন’ তেমনি একটি মনোভঙ্গী, বোধ বা দশা। যা ‘নিজ’ সাপেক্ষে ‘অপর’ প্রতিষ্ঠা করে বৈপরীত্যের মধ্যে দিয়ে। এক্ষেত্রে ‘অপর’ মূলত সেই সত্তা বা পরিচিতি যা ‘নিজ’ দ্বারা নির্মিত, পরিবেশিত এবং অবধারিতভাবেই ‘নিজ’ এর তুলনায় দুর্বল এবং ‘অপর’ দ্বারা পরিবেশিতকরণের আওতার ঊর্ধ্বে।
এই পরিবেশিতকরণ সবসময়ই ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যেহেতু দুর্বল, মোটের উপর সবলের সঙ্গে পেরে ওঠে না, তার এই দৃশ্যমান ব্যর্থতা সবলকে শক্তি প্রদান করে দুর্বলের ক্ষয়িঞ্চু, ভঙ্গুর এবং বিকৃত প্রতিকৃতি নির্মাণের এবং ক্ষমতা কাঠামোর জন্যেই এই প্রতিকৃতি নির্মাণ বৈধতা পায়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘সবল’ কর্তৃক ‘দুর্বল’-এর পরিবেশন হয় মনগড়া, কাল্পনিক এবং আরোপিত। একটির সাপেক্ষে অপর সত্তাটিকে তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্ব প্রদান, উপেক্ষা করা অথবা বাদ দেয়ার মধ্যে দিয়ে সম্পন্ন হয় অপরায়ন।
সবলের স্বজাত্যবোধ দুর্বলের সম্পদ-অর্জন-ঐতিহ্য-পরম্পরাকে ভুলুণ্ঠিত করে একদিকে মেকি প্রতিমূর্তি তৈরি করে, অন্যদিকে সবলকে সর্বোচ্চ-সর্বোৎকৃষ্ট-সর্বোন্নত বলে প্রতিষ্ঠিত করে।
রাষ্ট্র এবং এর নানাবিধ মেকানিজম এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা দেয়। এই সম্মিলিত শক্তি পর্যায়ক্রমে সমাজ মানসে প্রবল মনোভঙ্গী তৈরিতেও প্রণোদনা জোগায়। আর এ কারণেই শৈশবে আমার মতো অনেকেই হয়তো ছড়া আওড়ায় কিংবা সর্বোচ্চ বিদ্যাপঠে এসেও বাঙালি ভিন্ন অন্য নৃগোষ্ঠীকে ‘জংলি’ ভেবে নিতে সংকোচে ভোগে না।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণের বিষয়টি উপেক্ষা করে মূলধারার লেখালেখি বা আলাপচারিতায় প্রায়শই বাঙালির কৃতিত্বকেই একমাত্র অর্জন ধরে নেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। প্রায়শই আরও বড় যে ভুলটি আমরা করে বসি তা হলো, বাংলাদেশকে শুধু বাঙালি জাতির দাবিকৃত বাসস্থান হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলি।
বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশ সরকারের পার্বত্য অঞ্চলে বাঙালি জনগোষ্ঠীর বাস্তুসংস্থান প্রকল্পের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যায়। নির্বিচারে ‘পাহাড়ি’ জনগোষ্ঠীর ভূমি দখল, ভূমি হতে উচ্ছেদ চলছে রাষ্ট্রের সম্মতিতে। বাস্তবে তাই দেখা যায় রাষ্ট্রের ‘প্রবল’ জনগোষ্ঠীর বিপরীতে ‘ক্ষুদ্র’ জনগোষ্ঠীর মেরুকরণ ঘটে ‘উপজাতি’, ‘ট্রাইব’ প্রভৃতি ভগ্নাংশে। অভিন্ন রাষ্ট্রে প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকত্বের প্রতিষ্ঠা হয় সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে।
মেরুকরণকৃত নাগরিকত্ববোধ অধিবাসীদের মনোভঙ্গীরও মেরুকরণ ঘটায়। ফলে ‘প্রথম’ ও প্রবল শ্রেণির মনোভঙ্গী ও নাগরিকত্ববোধের সাপেক্ষে বাদবাকিরা ‘অপরায়নের’ শিকার হন।
এরই ধারাবাহিকতায় উচ্চতর বিদ্যাপীঠে বাঙালি কর্তৃক পার্বত্য জনগোষ্ঠীর ‘জংলি’ প্রতিকৃতি অংকনকে ভিন্ন দুটি জনগোষ্ঠীর সহজাত আলাপচারিতা কিংবা শৈশবে মান্দি ব্যক্তি কর্তৃক আমার তাড়া খাওয়ার ঘটনাকে নিছক স্মৃতি হিসেবে চালিয়ে দেয়া যায় না। ষাটোর্ধ্ব একজন মান্দি ব্যক্তি যখন একটি বাঙালি শিশুকে অকস্মাৎ তাড়া করেন তার পেছনে নিশ্চয়ই রয়েছে দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্রোধ, ক্ষোভ এবং যন্ত্রণা।
ঘটনাটি মনে পড়লে আজও আমি অপরাধবোধে তাড়িত হই। মানসপটে দেখতে পাই ময়লা পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি পরা একজন বয়স্ক মান্দি ব্যক্তি পথ ধরে হাঁটছেন আর পাশেই কিছু বাঙালি শিশু আস্পর্ধা দেখাচ্ছে খেলাচ্ছলে তাকে অপমান করার। চারপাশের ফিসফিসানি, কৌতুহল, আলোচনা এবং সমালোচনা তাদেরকে প্রশিক্ষিত করেছে, সাহস জুগিয়েছে আচরণটি করার জন্য। অপদস্ত ব্যক্তিটির তৎক্ষণাৎ আর কী-ই বা করার থাকে তাড়া করা ছাড়া?
জাতিগত পরিচয়ের যে ভগ্নাংশ তিনি বহন করছিলেন বা করেন সেজন্য তিনি অপমানের বিচারের আর্জি জানাবেন কার কাছে? প্রশাসন? সরকার? রাষ্ট্র? কথায় বলে, সর্ষে ভূত তাড়ায়, কিন্তু সর্ষের ভূত তাড়াবে কে?
লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক