‘ভাইরে বিষ খেয়ে মরা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। তাই ভাবছি, একেকজন করে বিষ খাব, আর একেকজন করে মরব। কী করব বলেন, পেটের যন্ত্রণা এমন যন্ত্রণা, তা আপনি বুঝবেন না। পেটের যন্ত্রণার চেয়ে বিষ খেয়ে মরার যন্ত্রণা অনেক কম। মৃত্যু ছাড়া আমাদের আর কোনো গতি নাই, ভাই।’
হতাশা আর আক্ষেপ নিয়ে নিউজবাংলাকে এসব কথা বলছিলেন ময়মনসিংহ শহরের কাচারিঘাট এলাকার ‘হিজড়া সম্প্রদায়ের’ গুরুমা (গোষ্ঠীপ্রধান) আনিসুর রহমান তনু, যিনি সবার কাছে ‘তনু হিজড়া’ নামে পরিচিত।
তিনি জানান, করোনা মহামারির প্রকোপ প্রতিরোধে একের পর এক লকডাউনে ট্রান্সজেন্ডারদের আয়-রোজগার প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তারা কেমন আছেন, তা মুখের ভাষায় বলে বোঝানো সম্ভব না।
তনু বলেন, ‘এককথায় আমরা খুবই খারাপ আছি, ভাই। এই দেড়টা বছর আমরা যে কীভাবে বেঁচে আছি, তা মুখে বলে বোঝাতে পারব না। আমরা একটা বিয়ে হলে নাচগান করি, বাচ্চা নাচাই, বাজারে তরিতরকারি, টাকা-পয়সা তুলি। এখন করোনার কারণে সবকিছুই বন্ধ। তাই আমাদের আয়-রোজগার প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।’
করোনায় ময়মনসিংহের তনুর মতো দেশের অসংখ্য ট্রান্সজেন্ডার কোনো রকমে খেয়ে না-খেয়ে দিন পার করছেন বলে নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন।
তারা বলছেন, সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তেমন সহায়তা মেলেনি। বেসরকারি সংগঠন থেকে কিছু সাহায্য পেলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই কম। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, হটলাইন নম্বরে ফোন করে সাধারণ মানুষের মতো ট্রান্সজেন্ডাররাও খাদ্যসহায়তা পাচ্ছেন।
গুরুমা তনুর অভিযোগ, এবার সরকারি-বেসরকারিভাবে তারা ওইভাবে সাহায্য-সহযোগিতাও পাননি।
তিনি বলেন, ‘গত বছর আমরা ডিসির কাছ থেকে ১০ কেজি চাল, ১০ কেজি আলু ও ১ কেজি তেল পাইছিলাম। এবার পাইছি শুধু ১০ কেজি চাল। আর বেসরকারিভাবে কিছু সাহায্য পেয়েছি। এখন আপনিই বলেন, এই দেড় বছরে এসব সাহায্যে কি পেট চলে?’
তনু জানান, তার সঙ্গে প্রায় আড়াই শ ট্রান্সজেন্ডার আছেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন। কিন্তু সেখানেও সমস্যা।
তিনি বলেন, ‘বাড়ির লোকজন বা আশপাশের মানুষ বলে হিজড়া কেন আসছে? ওদের কেন রাখছ? এ রকম নানা ধরনের কথা বলে। মানে বাড়িতে গিয়েও শান্তি নাই। তাই অনেকে বাড়ি গিয়েও চলে আসছে।’
তনু বলেন, ‘এখন হাটবাজারেও চাল-ডাল, আলু-তেল চাইতে গেলে দোকানদাররা আগের মতো দেয় না। বলে এখন আমাদেরই চলে না, আবার তোমাদের কী দেব?’
তিনি বলেন, ‘এখন এমন একটা পরিবেশ চলছে যে, আরেকজনের কাছে যাব, তার কাছ থেকে কিছু চাইব, সেই পরিবেশটাও নাই। এখন আমরা কীভাবে চলব, সেটা বুঝতেছি না। আর ছিনিয়ে নিয়ে যে কিছু কামাই করব, তাও তো পারছি না। কারণ লকডাউনে মানুষ তো রাস্তায় বের হচ্ছে না।’
তনু জানান, তার আড়াই শ শিষ্যের মধ্যে ২৫ জন বাসা ভাড়া দিয়ে বাজার করে চলতে না পেরে তার কাছে চলে এসেছেন, যাদের ডাল-ভাতের বেশি কিছু দিতে পারছেন না তিনি।
এই পরিস্থিতিকে মরণদশার সঙ্গে তুলনা করেছেন ময়মনসিংহ শহরের কাচারিঘাট এলাকার ট্রান্সজেন্ডারদের এই গুরুমা।
তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের মরতে হবে। কারণ পরিবারে আমরা ঠাঁই পাই না; বাড়িতে গেলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। আর যেসব পরিবার আশ্রয় দেয়, তারাও বলে শাড়ি পরতে পারবা না। চুল কেটে ছেলেদের মতো করো, নখ কাটো, মেয়ের পোশাক পরা চলবে না, ছেলের পোশাক পরো; ঘর থেকে বের হবে না, বের হলেও বাইরের মানুষের সামনে যাবে না।
‘আমি তো একটা মানুষ ভাই। ঘরে বন্দি হয়ে কি সব সময় থাকতে পারি? আশপাশের মানুষের সঙ্গে কথা না বললে আমি কি বাঁচব, ভাইয়া?’
রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার ট্রান্সজেন্ডার রূপকথা বলেন, ‘করোনার শুরু থেকেই আয়-রোজগার বন্ধ। এখন মানুষের বাচ্চাকাচ্চা হলেও করোনার কারণে আমাদের বাসায় ঢুকতে দেয় না। পাড়া-মহল্লায় মানুষের কাছ থেকে যে সাহায্য পেতাম, এখন তাও পাই না।
‘সবারই অভাব। কে কাকে সাহায্য করবে? জমানো কিছু টাকা আর গুরুমার সাহায্যে এখনও দুই বেলা খেয়ে বেঁচে আছি। তবে বাসা ভাড়া দিতে পারতেছি না। এভাবে আর কত দিন চলতে পারব জানি না ভাই।’
রাজধানীর সায়েদাবাদ এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন ট্রান্সজেন্ডার কোয়েল। করোনায় আয়-উপার্জন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চার মাসের ভাড়া বকেয়া রেখেই বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন তিনি।
কোয়েল বলেন, ‘আমার মতো এই রকম অনেকে আছে, যারা এই করোনার সময় কাজকাম না পেয়ে অভাবে দেশের বাড়ি চলে গিয়েছিল। কিন্তু বেশির ভাগই আবার শহরে চলে আসছে। তাদের কেউ পরিবারে জায়গা পায়নি। আবার কেউ পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি।
‘আমাদের তো কেউ কোনো কাজেও নেয় না যে আমরা কাজ করে খাব। এখন কী করব সেটাই বুঝতে পারছি না। কোনো উপায় না পেয়ে দুই মাস আগে গুরুমা অনু হিজড়ার বাসায় উঠছি।’
কোয়েল নিউজবাংলাকে জানান, তিনি একা নন; বাসা ভাড়া টানতে না পেরে লাভলী, মধু শাহনাজ, আলিশাসহ ১০ থেকে ১২ জন ট্রান্সজেন্ডার গুরুমা অনুর বাসায় থাকছেন।
তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে কারও বাচ্চাকাচ্চা হলে আমাদের বাসাবাড়িতে ঢুকতে দেয় না। আবার বিয়েশাদির অনুষ্ঠান সবকিছুই বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানেও আমাদের যেতে দেয় না।
‘তাই কোনো রকম খেয়ে না-খেয়ে বেঁচে আছি। জীবনে যা রোজগার করছিলাম, করোনার এক বছর তা দিয়ে চলছি। আর চলতে পরতেছি না। বাড়িতেও যেতে পারি না। কোনো উপায় না পেয়ে গুরুমার কাছে উঠছি। এখানেই দুবেলা দুটো ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে আছি।’
পল্টন-ওয়ারী এলাকার ট্রান্সজেন্ডারদের গুরুমা অনু নিউজবাংলাকে জানান, তার শিষ্য আছে প্রায় ২০০। তাদের আয়-রোজগার বলতে গেলে একদমই নেই। দুই-একজন ছাড়া বেশির ভাগেরই অবস্থা ভালো নয়।
তিনি বলেন, ‘তারা কোনো রকম খেয়ে-পরে বেঁচে আছে। ১০-১৫ জন আর কোনোভাবেই বাসা ভাড়া দিয়ে ঢাকা শহরে চলতে পারতেছিল না। আমি তাদের আমার বাসায় নিয়ে আসছি। আমি যা খাই, তাদেরও তা খাওয়াই। কিন্তু আর কত দিন এভাবে চলব, বলেন?’
২০১৪ সালে বাংলাদেশে ট্রান্সজেন্ডারদের স্বতন্ত্র লিঙ্গ হিসেবে সাংবিধানিক ও আইনি স্বীকৃতি দেয়া হয় ৷ ভোটাধিকারও পেয়েছেন তারা। সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাবে বাংলাদেশে ট্রান্সজেন্ডারের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার।
তবে অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা এর দ্বিগুণের বেশি। ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারি সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে তাদের সংখ্যা দেড় লাখ।
তবে গুরুমা অনুর দাবি, ‘ঢাকা শহরেই ট্রান্সজেন্ডারের সংখ্যা প্রায় এক লাখ। খোঁজ নিয়ে দেখেন তারা সবাই খুবই খারাপ অবস্থায় আছে।’
পল্টন-ওয়ারী এলাকার ট্রান্সজেন্ডারদের গুরুমা অনু। ছবি: নিউজবাংলা
তিনি বলেন, ‘আর কার কাছে আমরা সাহায্য চাব বলেন। সবাই তো এখন অভাবী। সব মিলিয়েই খুব খারাপ আছি, ভাই। পোলাপাইনের মুখের দিকে তাকাতে পারি না।’
সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বেশ কিছু সাহায্য পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন পুরান ঢাকার ট্রান্সজেন্ডার মিতু।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘গত দেড় বছরে ঢাকার জেলা প্রশাসক, সিটি করপোরেশন, বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, উত্তরণ ফাউন্ডেশন আর পুলিশের ডিআইজি হাবিব ভাই আমাদের সাহায্য করেছেন।’
বেসরকারি সংগঠন বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির ম্যানেজার (ট্রেইনিং অ্যান্ড ক্যাপাসিটি বিল্ডিং) মেসবাহ ইউ আহমেদ বিরাজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের হিসাবে সারা দেশে প্রায় দেড় লাখ ট্রান্সজেন্ডার আছে। করোনাকালে আমরা সাধ্যমতো তাদের সাহায্য করে যাচ্ছি। ৩৭টি সংগঠনের মাধ্যমে আমরা সারা দেশে সাত থেকে আটবার রিলিফ দিয়েছি। ইউএনডিপির ত্রাণও আমাদের মাধ্যমে তাদের কাছে পৌঁছেছে।’
তিনি বলেন, ‘সর্বশেষ ১৫ দিনে হয়তো ওদের অবস্থা একটু খারাপ হয়েছে। কারণ হয়তো ওরা ত্রাণের সদ্ব্যবহার করতে পারে নাই।’
ট্রান্সজেন্ডারদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা) সাব্বির ইমাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের তালিকায় যারা আছেন, তাদের ভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি ও ট্রেনিং চালিয়ে যাচ্ছি। ত্রাণের কাজটা আমরা করি না; এটা করে ত্রাণ মন্ত্রণালয়।’
এ বিষয়ে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা সেলিম হোসেন বলেন, ‘আসলে তাদের জন্য আলাদা করে আমাদের কোনো সাহায্য কর্মসূচি নেই। সাধারণ মানুষ যেমন আমাদের হটলাইন (৩৩৩) নম্বরে ফোন করে খাদ্যসহায়তা পাচ্ছেন, তেমন তারাও পাচ্ছেন।’