৩৫ বছর বয়সী পাকিস্তানি নারী বুশরা শাহের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল মুসলিমদের সর্ববৃহৎ মিলনমেলা হিসেবে হজে অংশ নেয়া। এ বছর সৌদি আরবের নতুন নিয়মে পুরুষ ‘অভিভাবক’ ছাড়াই হজ করেছেন তিনি।
চলতি বছর প্রথমবারের মতো সব বয়সী নারীদের ‘মাহরাম’ বা পুরুষ ‘অভিভাবক’ ছাড়া হজ পালনে অনুমোদন দেয় সৌদি আরবের হজ মন্ত্রণালয়। তবে এ ক্ষেত্রে কয়েকজন নারীকে দলবদ্ধভাবে হজ করার শর্ত বেঁধে দেয়া হয়।
বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সামাজিক সংস্কারমূলক পদক্ষেপের অংশ এটি। তেলনির্ভর অর্থনীতির দেশটিতে নির্ভরতা বিকেন্দ্রীকরণ ও রাজতন্ত্রের কঠোর ভাবমূর্তি শিথিলে সমাজ সংস্কারের উদ্যোগ নেন তিনি।
তিনি যুবরাজ হওয়ার পর রক্ষণশীল দেশটিতে নারীরা গাড়ি চালানো, পুরুষ অভিভাবক ছাড়া বিদেশযাত্রাসহ ইতিহাসে প্রথমবার পেয়েছেন বেশ কিছু অধিকার।
যদিও একই সঙ্গে বিরোধী মতাদর্শীদের দমনের জন্য ব্যাপক সমালোচনাও কুড়িয়েছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। এই বিরোধী মতাদর্শীর মধ্যে আছে অনেক নারী অধিকারকর্মীও।
জেদ্দায় বসবাসরত বুশরা শাহের হজ শেষে মক্কা ছাড়ার সময় এএফপিকে বলেন, ‘আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। হজ পালনের ইচ্ছা ছিল সেই শৈশব থেকে।’
ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম হলো হজ। শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম সব মুসলিমের জন্য জীবনে কমপক্ষে একবার হজ করা বাধ্যতামূলক।
ছোট্ট শিশু সন্তানের মা বুশরা জানান, স্বামীর সঙ্গে হজ করতে এলে কোলের সন্তানকেও সঙ্গে আনতে হতো। এতে নিষ্ঠার সঙ্গে ধর্মীয় আচার পালনে মনোযোগ দেয়া কঠিন হয়ে যেত।
চলতি বছর হজে অংশ নেয়া ৬০ হাজার মুসল্লির একজন বুশরা। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে টানা দ্বিতীয় বছর সীমিত পরিসরে হজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এতে সাড়ে পাঁচ লাখের বেশি আবেদনকারীর মধ্যে লটারির মাধ্যমে অংশ নিয়েছেন নাগরিক, অভিবাসীসহ শুধু সৌদি আরবে বসবাসরত মুসলিমরা।
এ বছর হজ পালন করা ৪০ শতাংশই নারী বলে জানিয়েছে সৌদি প্রশাসন।
‘আল্লাহর উপহার’
বুশরা বলেন, ‘আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন নারী এসেছেন। আজ আমরা স্বাধীন, আমাদের অভিভাবকের দরকার নেই। আমি গর্বিত।’
বুশরার অবর্তমানে তার সন্তানের দেখাশোনার জন্য জেদ্দাতেই থেকে গিয়েছিলেন স্বামী আলি মুর্তাদা। তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানান, একা হজে অংশ নেয়ার জন্য স্ত্রীকে উৎসাহ দিয়েছেন তিনি।
মহামারির কারণে এ বছর হজে বয়সসীমা বেঁধে দেয়া হয়। শুধু ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সীরাই আবেদন করতে পেরেছেন।
শিশুদের এ বছর হজে অংশ নিতে দেয়া হবে না বলে সৌদি সরকার সিদ্ধান্ত দেয়ার পরই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেকোনো একজন হজ করবেন বলে ঠিক করেন বুশরা-আলি দম্পতি।
৩৮ বছর বয়সী আলি বলেন, ‘যেকোনো একজনের যাওয়া উচিত বলে মনে করেছি আমরা। পরের বছর আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হতে পারেন কিংবা আগামী বছরও শিশুরা হজের অনুমতি না-ও পেতে পারে। তাই সময় থাকতে স্ত্রীরই আগে হজ পালন করা দরকার ছিল।’
শিশুদের হজে নিষেধাজ্ঞা কবে নাগাদ শিথিল হবে, তা স্পষ্ট নয়।
এদিকে সৌদি সরকার অনুমতি দিলেও অনেক ট্রাভেল এজেন্সি তথাকথিত পুরুষ অভিভাবক ছাড়া নারীদের হজের আবেদন জমা দিতে চায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।
অনেক প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দিয়ে নারীদের একা আবেদন করতে নিষেধ করেছে।
বিষয়টিকে রক্ষণশীল রাজতন্ত্রের দেশে সামাজিক পরিবর্তন ও সমাজ সংস্কার প্রতিরোধের চেষ্টা হিসেবে দেখছেন সমালোচকরা।
পুরোনো নিয়মে সৌদি আরবে ৪৫ বছরের কমবয়সী নারীদের জন্য পুরুষ অভিভাবকের উপস্থিতি ছাড়া হজ পালন নিষিদ্ধ ছিল। এর ফলে সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বহু নারী হজে অংশ নিতে পারতেন না।
এমনই একজন মিসরীয় নারী মারওয়া শাকার। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে থাকেন তিনি।
পেশায় একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা ৪২ বছর বয়সী মারওয়া বলেন, ‘অভিভাবক ছাড়া হজের অনুমতি পাওয়া যেন অলৌকিক কোনো উপহার ছিল।’
তিন বান্ধবীর সঙ্গে মক্কায় আসা মারওয়া তিন সন্তানের জননী। মহামারির আগে বেশ কয়েকবার হজে আসার উদ্যোগ নিয়েও সফল হননি তিনি। তার স্বামী আগেই একবার হজ করেছেন এবং শিগগিরই আরেকবার হজ করবেন না বলে মারওয়ার হজও আটকে ছিল।
তিনি বলেন, ‘আমি খুব আনন্দিত। এত বাধার মধ্যেও আল্লাহ তাঁর কাছে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন আমাকে।’
ব্রিটিশ-পাকিস্তানি চিকিৎসক সাদাফ গফুর জানান, পুরুষ অভিভাবকের সঙ্গে হজের কোনো উপায়ই ছিল না তার।
তিন সন্তানের মা ৪০ বছর বয়সী এই নারী বলেন, ‘তিন সন্তানকে একা ফেলে কোনোভাবেই স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে আসতে পারতাম না। একা আসার সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ ছিল না। কিন্তু এটাকে আল্লাহর রহমত ভেবে চলে এসেছি।’
সাদাফের স্বামী বাড়িতে থেকে গেছেন। সাদাফ মক্কায় এসেছেন এক নারী প্রতিবেশীর সঙ্গে।